Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

কী করে বাংলা শেখাই

নতুন প্রজন্ম দিদু-ঠাম্মার সঙ্গে বাড়িতে বাংলায় দু’চারটে কথা বললেও, আদতে ইংরেজি আর হিন্দিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ।

ইন্দ্রজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না! এমন কথা শুধু লন্ডন-আমেরিকা বা মুম্বই-বেঙ্গালুরুর প্রবাসীদের নয়, খাস কলকাতা শহরের বুকে বাস করা বাবা-মায়েদেরও। নতুন প্রজন্ম দিদু-ঠাম্মার সঙ্গে বাড়িতে বাংলায় দু’চারটে কথা বললেও, আদতে ইংরেজি আর হিন্দিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। মাতৃভাষাটা বুঝতে, বলতে পারলেও, ছেলেমেয়েগুলো আমাদের এত গর্বের বাংলা সাহিত্য নিজের ভাষায় পড়তে শিখল না, এই ভেবেই আমরা, বাবা-মায়েরা আক্ষেপ করি।

বাংলায় ‘লেখাপড়া’ না শেখার জন্য কিন্তু বাবা-মায়েদের অপারগতা, আমাদের সন্তানদের অনীহা অথবা ইংরেজি মাধ্যমকে দোষারোপ করা ঠিক হবে না। মূল কারণ হল বাংলা ভাষা শেখানোর পদ্ধতি ও সরঞ্জামহীনতা। এই ভাষা শেখানোর আধুনিক কোনও পদ্ধতি আমাদের মতো প্রবাসী, এমনকী কোনও কলকাতাবাসী অভিভাবকের জানা নেই। আমরা আজও শতাব্দীপ্রাচীন পদ্ধতি ও বই ব্যবহার করে চলেছি। দেশে-বিদেশে বাঙালির জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস, আচার-আচরণ, মুখের ভাষা গত দুই শতকে আমূল বদলে গিয়েছে। তবু, প্রবাসে হোক বা দেশের মাটিতে বসে, ছোটদের বাংলা ভাষা শেখানোর জন্য আমাদের হাতে আজও সেই ‘বর্ণপরিচয়’, সেই ‘হাসিখুশি’, সেই ‘সহজ পাঠ’!

তুলনায়, পাশ্চাত্যে শিশুরা (ইংরেজি বা অন্য ইউরোপীয় ভাষার) বই পড়তে শেখে এক সুচিন্তিত, ধারাবাহিক, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে; সঙ্গে থাকে ছবি, জিগ্স পাজ়ল, কার্ড ইত্যাদি অজস্র সরঞ্জামের প্রয়োগ। পাশ্চাত্যের এই ধারাগুলি আমরা আজকাল নকল করে ইংরেজি শেখাচ্ছি। কিন্তু দুয়োরানি বাংলাকে আধুনিক পদ্ধতিতে কী ভাবে শেখাব, তা নিয়ে কোনও ভাবনাচিন্তা করিনি, ‘সহজ পাঠ’ বর্জনের তো প্রশ্নই ওঠে না!

আজ থেকে ১৭০ বছর আগে শিশুদের বর্ণপরিচয়ের উদ্দেশ্য আর পদ্ধতি ছিল ভিন্ন। বর্তমানের বিশ্বায়িত বাঙালি শিশুকে বাংলা ভাষা শেখানোর উদ্দেশ্য বদলেছে। অতএব, পদ্ধতিটাও হওয়া উচিত আধুনিক। ‘সহজ পাঠ’ অবশ্য পাঠ্য, সব প্রজন্মেরই উচিত এই বইয়ের সব লেখা পড়া। তবে, ভুললে চলবে না, শিশুদের ভাষা শেখানো আর ছোটদের জন্য সাহিত্য রচনা এই দুটো কাজ কিন্তু আলাদা। সমস্যাটা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে একেবারেই ভাবেননি তা নয়। বাংলা শেখানোর কথা মাথায় রেখেই তিনি নানা সহজ ‘পাঠ’ লিখেছিলেন; তবে, ওইটুকুই। বিশেষ কোনও ‘বৈজ্ঞানিক’ পদ্ধতি মেনে নয়। ভাষা শেখানোর পদ্ধতি সনাতন হতেই হবে, তেমন কোনও সঙ্গত কারণ নেই। আর, এই বৈজ্ঞানিক কাজটা কোনও সাহিত্যিককেই করতে হবে, এমন মাথার দিব্যিও কেউ দেয়নি। তা হলে, নতুন বর্ণপরিচয় আমরা লিখি না কেন? এক সম্ভাব্য পদ্ধতির বিবরণ নীচে দিলাম।

ইংরেজি বা অন্য অনেক ইউরোপীয় ভাষার তুলনায় বাংলা পড়তে ও লিখতে শেখানো অনেকার্থে সহজ। কারণ, বাংলা কথার (ব্যঞ্জন ও স্বর)-ধ্বনিগুলিই লেখার (ব্যঞ্জন ও স্বর)-বর্ণ। বস্তুত, ধ্বনি হিসেবে আমাদের স্বরবর্ণগুলোর আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্যও নেই। শব্দের মধ্যে যেমন ক, তেমনই ই। অর্থাৎ, কলা-র মধ্যে যেমন ‘ক’ বলি, ইলা-র মধ্যে তেমনই ‘ই’। তবে, আমাদের ভাষা শেখানোয় একটা বড় সুবিধে হল, ধ্বনির সঙ্গে স্বরবর্ণ যোগে শব্দ তৈরি। অঙ্কের পরিভাষায় বললে, আ বা ই-র মতো স্বরবর্ণগুলো এক-একটা অপারেটর বা ফাংশান-এর কাজ করে; ল-য়ে আকার দিলে লা, ই-কার যোগে লি। ক(+অ)+ল+আ হল কলা, ক+আ+ল+ই হল কালি। কোনও লিখিত শব্দকে পড়তে বা উচ্চারণ করার সময় আমাদের মস্তিষ্ক এই আঙ্কিক সূত্র ধরে কম্পিউটারের মতো কাজ করে। তার প্রমাণ পেতে হলে যে কোনও আনকোরা শিক্ষার্থীকে পড়তে দিন, দেখবেন, তিনি ধীরে ধীরে আ-কার ই-কার ভেঙে ভেঙে পড়ছেন! ছোটদের ভাষা শেখানোয় তাই এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে।

ধ্বনির মাধ্যমে শব্দ চেনানোর এই পদ্ধতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল শব্দচয়ন। আধুনিক প্রথম ভাগের জন্য বাছা শব্দগুলো অবশ্যই হতে হবে সাধারণ, বহু-ব্যবহৃত, সহজবোধ্য ও যুক্তাক্ষরবর্জিত; বিজ্ঞানের পরিভাষায়, যার ‘কমপ্লেক্সিটি’ ন্যূনতম। প্রথম ধাপে, এ রকম সহজতম শব্দ তৈরি হতে পারে দু’টি ব্যঞ্জনধ্বনি ও একটি স্বরধ্বনি, ধরা যাক আ-কার, সহযোগে। আমাদের নিত্যব্যবহার্য জিনিস, খাবার, শরীরের অঙ্গ ইত্যাদিতে এ রকম শব্দের ছড়াছড়ি। প্রথম তালিকা হতে পারে— কান, খাট, গাছ, ঘাস, চান, জামা, ঝাল, টাকা, ডাল, ঢাকা, তারা, থালা, দাদা, নাক, পাতা, ফাটা, বাবা ইত্যাদি। একই পদ্ধতিতে তৈরি এর ঠিক উপরে, আর এক ধাপ বেশি ‘কমপ্লেক্স’ শব্দ হবে দু’টি ভিন্ন স্বর বা অপারেটরের প্রয়োগে। যেমন, হাসি, দিদু, কালো, জুতো। এই ভাবে ধাপে ধাপে শব্দের জটিলতা বাড়বে।

এই পদ্ধতির আবশ্যিক শর্ত হল একসঙ্গে পাতে সব না দেওয়া। কিছুটা পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মতো; পিয়ানো শিখতে গেলে দেখা যায়, একটা একটা করে নোট দেওয়া হচ্ছে। উপরের রীতি মেনে বাংলা শেখালে সব বর্ণ একত্রে শেখানোর কোনও দরকার নেই; বর্গীয় বর্ণক্রমও অপ্রয়োজনীয়। ঙ, ঞ, ড়, ঢ়, ইত্যাদি ধ্বনি তো আরও পরে শেখানো হবে।

শব্দ শেখানোর সঙ্গে সঙ্গে এই জাতীয় শব্দ দিয়ে ছবি-ভরা বই তৈরি করতে হবে। তবে, এই বইগুলো লেখার উদ্দেশ্য সাহিত্যসৃষ্টি নয়। পাতাজোড়া ছবিই এখানে প্রাধান্য পাবে, লেখা থাকবে নামমাত্র। এই বইগুলোর মাধ্যমেই বাংলা শব্দ চেনা, লেখা ও পড়া এবং গোটা বই নিজে নিজে পড়ার প্রথম ধাপটি সহজেই পার করা যাবে। এই জাতীয় প্রয়াস এর আগে হয়েছে বইকি। সম্পূর্ণ না হলেও, মহাশ্বেতা দেবী ও গণেশ বাগচী-র ‘আনন্দ পাঠ’-এর শুরুতে ক্রম না মেনে বিভিন্ন ধ্বনি শেখানো হয়েছে। এই প্রসঙ্গে গৌরব কর ও সুব্রত ঘোষের ‘এক’ বইটিরও উল্লেখ করতে হয়। যদিও বইটির উদ্দেশ্য সামান্য পৃথক, যার শেষের কয়েকটি পাতা বাদ দিলে, পদ্ধতিটা সাধুবাদার্হ। প্রাইমার তৈরি অথবা সাহিত্যসৃষ্টি নয়, ‘বর্ণপরিচয়’ বা ‘সহজ পাঠ’-এর বিকল্প খোঁজার তাগিদেও নয়, শুধুমাত্র আধুনিক পদ্ধতিতে বাংলা ভাষা শেখানোর সরঞ্জাম হিসেবেই চাই এই রকম অজস্র বই। আয়তনে ছোট, অল্প কয়েক পাতার, পাতাজোড়া ছবি-সহ।

এই ভাবেই আমরা পরের প্রজন্মকে আমাদের মুখের বাংলা ভাষাকে পড়তে ও লিখতে শিখিয়ে যেতে পারব। নয়তো ভয় হয়, কয়েক দশক পরে ভাষাটা হারিয়েই যাবে হয়তো!

ব্রিটেনে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Language Bengali Culture
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE