মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধারে পুলিশমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী। আন্দাজ হয়, চিকিৎসক নিগ্রহ করিয়া পুলিশ তাঁহাকে বিলক্ষণ সঙ্কটে ফেলিয়াছে। আগাইলে পুলিশ চটিবে, পিছাইলে চিকিৎসকেরা। উভয়পক্ষই যথেষ্ট পরাক্রান্ত। গ্রামবাসীর চিকিৎসার স্বার্থে জেলায় কর্মরত চিকিৎসকদের ছুটিতে রাশ টানিয়াও হার মানিয়াছেন মুখ্যমন্ত্রী। দুইটি আদালতে মামলা চালাইবার পর সম্প্রতি নিজের বাসভবনে চিকিৎসকদের ডাকিয়া উচ্চশিক্ষার্থে ছুটির দাবি মঞ্জুর করিয়াছেন। আর পুলিশের উপর তৃণমূল সরকারের নির্ভরতা কত দূর, তাহা প্রশাসনে পুলিশের ক্রমবর্ধমান ভূমিকাটি দেখিলেই স্পষ্ট হয়। মিড ডে মিলের ব্যবস্থাপনা হইতে গাছ লাগাইবার পরিকল্পনা, সকল কাজেই প্রশাসনের ভরসা পুলিশ। দুর্জনে বলিয়া থাকে, শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামলাইতে এবং নির্বাচন বৈতরণি পার করিতেও পুলিশই ভরসা। এখন পুলিশ-চিকিৎসক দ্বন্দ্বে সরকারের ‘শ্যাম রাখি কি কুল রাখি’ অবস্থা। সেই কারণেই রাজধর্ম বিস্মৃত হইয়াছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। চিকিৎসক নিগৃহীত, কিন্তু স্বাস্থ্যভবন নীরব। আইনরক্ষক আইন ভাঙিয়াছে, পুলিশ তাহাকে গ্রেফতার করে নাই। উপরন্তু কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজে অভিযুক্তের বয়ান প্রকাশিত হইয়াছে। তাহা এই রূপ, সম্মুখের ব্যক্তিটি ডাক্তার বলিয়া তিনি চিনিতে পারেন নাই, মনে করিয়াছিলেন বুঝি ফার্মাসিস্ট। তাই একটু ধাক্কা দিয়াছেন শুধু, চড় কদাপি মারেন নাই। এই বিবরণ পড়িয়া রাজ্যবাসী নিশ্চয়ই স্বস্তি পাইয়াছেন। আহা বেচারি ভুল করিয়া চিকিৎসক ঠ্যাঙাইয়াছে। তাহার জন্য শাস্তি?
ঘটনাটি এক গভীরতর অসুখের ইঙ্গিত করিতেছে। এ রাজ্যে এখন অপরাধের গুরুত্ব আইনের ধারা দিয়া বিচার হয় না। আক্রান্ত এবং অভিযুক্তের কে কতটা পরাক্রান্ত, সরকারের উপর কে কতটা চাপ সৃষ্টি করিতে পারে, তাহার দ্বারা নির্দিষ্ট হয়। তাই ফার্মাসির কর্মীকে মারধর ‘তুচ্ছ’ মনে হইতে থাকে। অচিকিৎসক কর্মীদের সংগঠন তেমন প্রভাবশালী নয় বলিয়াই কি? ডাক্তারদের প্রতিনিধিদল ডিসি (সাউথ)-এর নিকট গিয়া নালিশ ঠুকিয়াছেন, চিকিৎসক সংগঠনের নেতারা মিডিয়াতে শোরগোল তুলিয়াছেন। এই জোর ফার্মাসিস্ট বা অন্যান্য চিকিৎসাকর্মীর নাই। আশঙ্কা হয়, পুলিশ মারধর করিলে তাঁহাদের নিঃশব্দে হজম করিতে বলিত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও। কারণ দ্বন্দ্বটি ন্যায় ও অন্যায়ের নহে, ক্ষমতার সহিত ক্ষমতার। যাহার জোর, আজ শুধু সে-ই ন্যায় দাবি করিতে পারে। কিন্তু জবাবদিহির দায় তাহার নাই। সরকারি চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ‘তদন্ত’ যে শেষ হয় না, তাহা অভিযোগের জটিলতার জন্য নহে। চিকিৎসক সংগঠনের দাপটে।
নেতারা এই সত্যটি শিখাইয়াছেন। কেহ কোনও প্রশ্ন করিলেই নেতা-মন্ত্রীরা প্রশ্ন করিয়া থাকেন, ‘তুমি কে?’ প্রশ্নকর্তার ক্ষমতার জোর দিয়া তাঁহার উত্তর পাইবার অধিকার নির্ধারিত হয়। ঔদ্ধত্যের সেই শিক্ষার ফল ফলিতেছে নানা দিকে। তাই চিকিৎসক যখন রোগের ইতিহাস জানিতে চাহিয়া বার বার প্রশ্ন করেন, তাহা পুলিশকর্তার কাছে অসহনীয় বোধ হয়। উত্তর না দিলে নিজেই বিপন্ন হইবেন, তাহা ভুলিয়া যান। প্রশ্নকারীকে আঘাত করিয়া চুপ করাইতে চান। এই রাজ্য, এই দেশ, আজ এই ভুলই করিতেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy