Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
ইতিহাসের সরণি বেয়ে দিঘার আধুনিকা হয়ে ওঠার গল্প বললেন সমীর দাস

প্রাচ্যের ব্রাইটন বীরকুল আজকের সুন্দরী দিঘা

দিঘার সমুদ্র সৈকতের পরিচিতি প্রায় ৫০০ বছরের। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে রাজা সাগর রায় ছিলেন এখানকার অধিপতি। রায় রাজবংশ প্রায় ২০০ বছর রাজত্ব করেছিল। তখন দিঘা নাম ছিল না।

মোহময়ী: সৈকতে ভিড় লেগেই থাকে দিঘায়। নিজস্ব চিত্র

মোহময়ী: সৈকতে ভিড় লেগেই থাকে দিঘায়। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:০১
Share: Save:

ভ্রমণ পিপাসুদের মুখে এখন প্রায়ই শোনা যায় একটি শব্দবন্ধ ‘দিপুদি’। অর্থাৎ দিঘা, পুরী, দার্জিলিং। দিঘা এখন দার্জিলিংকে ছাড়িয়ে পুরীকেও চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। গত বছর ২৬ লক্ষ পর্যটক দিঘায় গিয়েছেন। দিঘা ঢোকার মুখে দর্শনীয় বিশ্ব বাংলা গেট। নিউ দিঘায় নিউ দিঘা গেট। নীচ দিয়ে ঝাঁ চকচকে চওড়া রাস্তা। তারই দক্ষিণের গার্ড ওয়ালে সশব্দে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের ঢেউ। উত্তরে সারি সারি হোটেল। রাতে রাস্তার দু’দিকের বাতিস্তম্ভের আলোয় দিঘা আজ সত্যই মোহময়ী। আর আছে দেখার ও বিনোদনের নানা ব্যবস্থা। সায়েন্স সেন্টার, মেরিন অ্যাকোয়ারিয়াম, অমরাবতী পার্ক, টয় ট্রেন, ফিশ হারবার, আইস প্ল্যান্ট, ছোট বড় এগারোটা মার্কেট, নিউ দিঘা, উদয়পুর, শঙ্করপুর, তালসারি সৈকত। অদূরে ওড়িশা সীমানায় প্রাচীন শিবমন্দির, সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ ভেঙে নানা রকম সি স্পোর্টস, শঙ্করপুর মৎস্য বন্দর।

১৯৫৬ সালে দিঘার উন্নয়নের জন্য প্রথম গঠিত হয় একটি আলাদা সংস্থা। তারপর দিঘা-শঙ্করপুরের ৩৭ কিলোমিটার এলাকা উন্নয়নের জন্য ১৯৯০ সালে তৈরি হয় দিঘা-শঙ্করপুর ডেভেলপমেন্ট অথরিটি। তারা ২০০৯-১০ সালে যেখানে বিভিন্ন প্রকল্পে খরচ করেছিল ২,০৪,২৫,৭৩৯ টাকা, সেখানে গত চার বছরে ৬৯ কোটি ১০ লক্ষ টাকার প্রকল্পের কাজ চলছে বা ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। সুতরাং পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে দিঘাকে সরকার এখন কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। অতি সাম্প্রতিক সফরে মুখ্যমন্ত্রী দিঘা সাজাতে একগুচ্ছ পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন।

তবে দিঘার সমুদ্র সৈকতের পরিচিতি প্রায় ৫০০ বছরের। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে রাজা সাগর রায় ছিলেন এখানকার অধিপতি। রায় রাজবংশ প্রায় ২০০ বছর রাজত্ব করেছিল। তখন দিঘা নাম ছিল না। ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দের ভ্যালেন্তিনের মানচিত্রে জায়গাটি নরিকুল নামে চিহ্নিত। পাশ দিয়ে বয়ে যেত বীরকুল নদী। ১৭০৩ সালের পাইলট মানচিত্রে এই স্থানের নাম বীরকুল। ব্রিটিশ সেটেলমেন্ট রেকর্ডে বীরকুল হল একটি লবণ পরগনা। এই বীরকুল গ্রামের সমুদ্র সৈকতেই গড়ে উঠেছে আধুনিক দিঘা। বীরকুল নদীর মোহনাই এখন দিঘা মোহনা।

সালটা ১৭৭২। শীতের দেশ ইংল্যান্ড থেকে গভর্নর হয়ে এসেছেন ওয়ারেন হেস্টিংস। এসেই বাংলার গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। গ্রীষ্মকালীন আবাসস্থল হিসাবে তখনও দার্জিলিংয়ের পরিচিতি ঘটেনি। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে সাগর সঙ্গমে হিজলি নগরীর ৯ মাইল এলাকা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। বিকল্প হিসাবে খেজুরিতে বন্দর তৈরি হয়েছে বটে। কিন্তু সেখানেও গরম থেকে নিস্তার নেই। খুঁজতে খুঁজতে ভাগীরথীর মোহনা থেকে সমুদ্রের তীর ধরে আরও ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে এগিয়ে বীরকুল সৈকতে গ্রীষ্মাবাস তৈরির উপযুক্ত জায়গা পাওয়া গেল। শুধু থাকাই আরামদায়ক নয়, সমুদ্রে মাছ, পাশের অরণ্যে বন্য হরিণ ও অন্যান্য পশু শিকার, আমোদপ্রমোদের আদর্শ জায়গা। সৈকতভূমি বরাবর রাস্তা তৈরি করে পণ্য পরিবহণেরও সুবিধা। হেস্টিংস বীরকুলকে ‘প্রাচ্যের ব্রাইটন’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।

গভর্নর বাস করার ফলে জায়গার উন্নতি হল দ্রুত। অন্যান্য ইংরেজ কর্মীদেরও যাতায়াত শুরু করল। তাই ১৭৭৮ সালে এলাকা উন্নয়নের জন্য রচিত হল পরিকল্পনা। কিন্তু খুব বেশি বাস্তবায়িত হল না। হেস্টিংস চলে যাওয়ার পর তাঁর বসতবাড়িটাও নষ্ট হয়ে যায়। ১৭৯৬ সালে চার্লস চ্যাপম্যান বীরকুলে গিয়ে হেস্টিংসের বাড়ি দেখতে পাননি। স্থানীয় বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসা করায় তাঁরা জায়গাটি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁরও জায়গাটি ভাল লেগেছিল যায়। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী পুরো গ্রীষ্মকালটাই সেখানে কাটিয়ে দেন। তিনি লেখেন, বীরকুলের সৈকত পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর। যদি ভারতে থাকেন তবে পরের গ্রীষ্মেও তিনি সেখানে আসবেন।

কিন্তু এরপর বীরকুলকে নিয়ে আলোচনা থেমে যায় প্রায় ১০০ বছর। ১৮৫২ সালে বেলি সাহেব বীরকুলে আসেন। তিনিও সৈকতের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যান। সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ জলোচ্ছ্বাসের মতো বালিয়াড়ির পাদদেশে আছড়ে পড়ছে। সমুদ্র থেকে বয়ে আসা নাতিশীতোষ্ণ বাতাসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ তিনি। অবশ্য তখন বীরকুল ‘দিঘা’ নামের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। কিন্তু এরপরও প্রায় ৭০ বছর দিঘা থেকে গেল আড়ালে। ১৯২৩ সালে মূলত লবণ ও মাছ ব্যবসার কারণে এক ব্যবসায়ী দিঘার উন্নয়নের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু সে প্রস্তাবও ফলপ্রসূ হল না। ১৯৩৪ সালে মেদিনীপুরের জেলাশাসক দিঘার উন্নয়নের জন্য একটি বড় পরিকল্পনা রচনা করেন। সেটাও বাস্তবায়িত হয়নি।

স্বাধীনতা লাভের পর তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী বাংলার রূপকার বিধানচন্দ্র রায়ের হাত ধরে দিঘা আবার প্রচারের আলোয় আসে। মূলত তিনটি সম্ভাবনার জন্য দিঘা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এক, ভাগীরথী নদীর নাব্যতা কমে আসায় কলকাতা বন্দরের বিকল্প বন্দর তৈরি। দুই, সমুদ্রের নীচে প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডার। তিন, পর্যটন শিল্পের বিকাশ। নানা সমীক্ষা ও অনুসন্ধানের পর প্রথম দু’টি সম্ভাবনা বাতিল হলেও তৃতীয়টি গৃহীত হয়। তারই ফলশ্রুতি আজকের রূপসী দিঘা।

কলকাতা থেকে বাসে ১৮৮ কিলোমিটার। আবার খড়্গপুর থেকে ট্রেনে পাঁশকুড়া এসে বা হাওড়া-দিঘা ট্রেনে মেচেদা এসে ১০৩ কিমি বাসে এলেই দিঘার সৈকত। কলকাতা থেকে সরাসরি ট্রেনেও আসা যায়। স্থায়ীভাবে হেলিকপ্টার চালু করার চেষ্টা হচ্ছে। নন্দকুমার থেকে বাস রাস্তা চওড়া করার কাজ শুরু হয়েছে। রেলেও ডবল লাইন পাতার কাজ শুরু হয়েছে। সবকিছু নিয়ে দিঘা হয়ে উঠছে আরও সুগম।

এখন সাধারণত দু’রাত তিন দিন দিঘার জন্য বরাদ্দ পর্যটকদের। কিন্তু দিঘার সঙ্গে যদি কাঁথির কপালকুণ্ডলা মন্দির, দরিয়াপুরের লাইট হাউস ও বঙ্কিমচন্দ্রের স্মৃতিধন্য কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের প্রেক্ষাপট রসুলপুর নদীর মোহনা, প্রাচীন নগরী হিজলির হিন্দু-মুসলিম তীর্থস্থান তাজ খাঁ মসনদ-ই-আলার মাজার ও মসজিদ, প্রাচীন বন্দর-শহর খেজুরির বাতিঘর, বিপ্লবীদের পদধূলিধন্য জেলখানা ইত্যাদি ঐতিহাসিক স্থানগুলি দেখার জন্য ‘কন্ডাক্টেড ট্যুর’ চালু হয় তাহলে পর্যটকদেরদের আরও একদিন বাড়াতে হবে।

৫০০ বছরের ইতিহাসের সরণি বেয়ে দিঘা আজ পশ্চিমবঙ্গের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ পর্যটন কেন্দ্র। দিঘাকে ঘিরে যে পূর্ব মেদিনীপুরের দক্ষিণ অঞ্চলের অর্থনীতি খুব দ্রুত বিকাশ লাভ করছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

(লেখক পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সহ সচিব)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Digha History
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE