Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক এক পরিবার

লাভপুরে এক যুগান্তরের সূচনা করেছিলেন যাদবলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। স্কুল, দাতব্য চিকিৎসালয় থেকে থিয়েটারের মঞ্চ। লাভপুরের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের কর্মকাণ্ড সুবিস্তৃত। ওই স্কুলে পড়েছেন স্বয়ং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নানা লেখায় তাই সশ্রদ্ধ উল্লেখ আছে যাদবলালের। মনে করালেন সুনীল পাল। জমিদার যাদবলাল। কৈশোরে কোলিয়ারিতে সামান্য চাকরিজীবন শুরু করে পরে কয়েকটি কোলিয়ারি এবং লাভপুরের জমিদারি কিনেছিলেন। বিলাস-ব্যসনে নয়, জমিদারির আয় কাজে লাগিয়েছিলেন লাভপুরের উন্নয়নে।

স্মৃতি: এই স্কুলের মাটি মাথায় ছোঁয়াতেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।

স্মৃতি: এই স্কুলের মাটি মাথায় ছোঁয়াতেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।

শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ০১:১০
Share: Save:

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৬৩ সালে তাঁর ‘গ্রামের চিঠি’তে লাভপুরের জমিদার পরিবার সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘... এই বন্দ্যোপাধ্যায় বংশের যাদবলাল— এখানকার বিশ্বকর্মা। তিনিই উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয় স্থাপন করেন ১৯০১ সালে। এ গ্রাম প্রকৃতপক্ষে তাঁর গড়া। ইস্কুল, দাতব্য চিকিৎসালয়, বালিকা বিদ্যালয়, টোল— নয় কি! তাঁহার পৌত্র পিতামহের পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন। সত্যনারায়ণ দীর্ঘজীবী হোন। তিনি উচ্চ ইংরাজী বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করিলেন। কলেজের তিনি উত্তরসাধক।’

তারাশঙ্কর তাঁর ‘কৈশোর স্মৃতি’তেও লিখেছেন, ‘যত লোকজন আমাদের গ্রামে আসতেন তাঁদের একশো জনের মধ্যে আশি জন আসতেন পশ্চিম দিক থেকে। প্রথমেই তাঁদের চোখে পড়ত ইস্কুল, ডিসপেন্সারী, বোর্ডিং-এর শোভা। সকলে মুগ্ধ হয়ে যেতেন, মনে হত তাঁদের যে কোন শহরে এসেছেন।’

লাভপুরে এই যুগান্তরের সূচনা করেছিলেন যাদবলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। জমিদার যাদবলাল। কৈশোরে কোলিয়ারিতে সামান্য চাকরিজীবন শুরু করে পরে কয়েকটি কোলিয়ারি এবং লাভপুরের জমিদারি কিনেছিলেন। বিলাস-ব্যসনে নয়, জমিদারির আয় কাজে লাগিয়েছিলেন লাভপুরের উন্নয়নে। আপার প্রাইমারি স্কুল স্থাপনের পরে ১৯০১ সালে তিনি যখন হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, তখন সারা বীরভূমে সিউড়ির জেলা স্কুল-সহ মোট হাইস্কুলের সংখ্যা ছিল সাকুল্যে সাত। ফলে স্থানীয় ছেলেরা ছাড়াও বীরভূমের নানা প্রান্তের এবং জেলার বাইরের বহু ছেলেও এই স্কুলের বোর্ডিংয়ে থেকে শিক্ষালাভ করেছে। অনেকে বৃত্তিও পেত জমিদারের কাছ থেকে। তারাশঙ্কর নিজেও এই স্কুল থেকে ১৯১৬ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। আজীবন এই স্কুলের প্রতি একটা শ্রদ্ধার আসন ছিল তাঁর মনে। এক অনুষ্ঠানে তারাশঙ্করের ভাইপো বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘বৃদ্ধ জ্যাঠামশাইকে স্কুলের সিঁড়ি দিয়ে ওঠার আগে মাটিতে হাত ছুঁইয়ে প্রণাম করতে দেখেছি।’’

তারাশঙ্করের নানা লেখায় সশ্রদ্ধ উল্লেখ আছে যাদবলালের। এ ছাড়া সাপ্তাহিক অমৃত পত্রিকায় ‘বিচিত্র চরিত্র’ সিরিজে যাদবলালকে নিয়ে লিখেছিলেন ‘বাবুমশাই’ নামে একটি নিবন্ধ। যাদবলালের তিন ছেলের মধ্যে বড় ষষ্ঠীকিঙ্কর প্রধানত ব্যবসার দিকটা দেখাশোনা করতেন। মেজ অতুলশিব এবং ছোট নির্মলশিবের উৎসাহ ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতিতে। নির্মলশিবের নেতৃত্বেই লাভপুরে সর্বপ্রথম গড়ে ওঠে বন্দেমাতরম থিয়েটার ও লাইব্রেরি। ‘রাজরোষ’-এর ভয়ে সে থিয়েটারের নাম বদলে হয় অন্নপূর্ণা থিয়েটার। লাইব্রেরির বই থেকেও ‘বন্দেমাতরম’ নামটি কালি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। অতুলশিবের অকালমৃত্যুর পরে সে থিয়েটার ও লাইব্রেরি ১৯১৭ সালে পরিণতি পায় অতুলশিব ক্লাবে।

কলকাতার পার্সি করিন্থিয়ান থিয়েটারের অনুকরণে ক্লাবের পাকা হলে ১৯২১ সালে রাসপূর্ণিমার সময় স্টেজ উদ্বোধন করেন রসরাজ অমৃতলাল বসু। এসেছিলেন ‘ভারতবর্ষ’-এর সম্পাদক জলধর সেন, বিখ্যাত নাট্যকার ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ। পরেও এসেছেন শিশির ভাদুড়ি, অপরেশ মুখোপাধ্যায়, নরেশ মিত্র, তিনকড়ি চক্রবর্তীর মতো থিয়েটার জগতের দিকপালেরা। কলকাতার সে-কালের নাট্যজগতের অনেকেই অভিনয় করেছেন এই মঞ্চে। তারাশঙ্করও তাঁর প্রথম জীবনে বহু স্ত্রী ও পুরুষ চরিত্রে রূপদান করেছেন এই মঞ্চটিতে। এই স্টেজে বসেই সাহিত্য সম্মেলন করেছেন সজনীকান্ত, বনফুল, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ, হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, শিবরতন মিত্র প্রমুখেরা। তারাশঙ্কর নিজে তো ছিলেনই।

ক্লাবের আশ্রয় ছেড়ে গ্রন্থাগারটি এখন পাশেই নিজস্ব গৃহে স্থানান্তরিত হয়েছে, পরিবর্তিত হয়েছে টাউন লাইব্রেরিতে। অবশ্য সে জায়গাও দিয়েছেন অতুলশিব ক্লাব এবং যাদবলাল দেবোত্তর ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লাইব্রেরির পরিদর্শন বইয়ে লিখেছিলেন, এই ক্লাব এবং লাইব্রেরি পঁচিশ বছরের মধ্যে লাভপুরে পাঁচ জন সাহিত্যিকের জন্ম দিয়েছে।

সু-অভিনেতা এবং নাট্যকার নির্মলশিবের লেখা প্রায় সমস্ত নাটকই অভিনীত হয়েছিল কলকাতার স্টার, মিনার্ভা, মনমোহন প্রভৃতি থিয়েটারে। ‘রাতকানা’ নামে তাঁর একটি প্রহসন মঞ্চেও চলেছিল অনেক বছর, ছাপা বইটিও দ্বাদশ সংস্করণের মুখ দেখেছিল। প্রহসনটির জনপ্রিয়তায় আকৃষ্ট হয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্ম কোম্পানি এটির চিত্ররূপ দেয়। ১৯৩৫ সালের অগস্টে সেটি মুক্তি পায় রূপবাণী চিত্রগৃহে।

নির্মলশিবের জ্যেষ্ঠপুত্র সত্যনারায়ণের উদ্যোগে লাভপুর থেকে প্রকাশ পায় মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘পূর্ণিমা’, এক সময় যার সম্পাদক ছিলেন নির্মলশিব, সহ-সম্পাদক তারাশঙ্কর। পরবর্তীকালে সত্যনারায়ণের সম্পাদনায় সিউড়ি থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘বীরভূম বাণী’ ও ‘শিক্ষা ও কৃষি’ নামে দুটি পত্রিকা। সত্যনারায়ণও সু-অভিনেতা ছিলেন। অসংখ্য পুরুষ ও স্ত্রী চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছিলেন। কংগ্রেসি রাজনীতি করেছেন। ৭-৮ বছর জেলা স্কুলবোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সিউড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণ শিল্প বিদ্যাপীঠ স্থাপনে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। মূক-বধিরদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপনায় সাহায্য করেছিলেন, বহুদিন তার সম্পাদকও ছিলেন। তাঁর প্রয়াত স্ত্রীর নামে সিউড়ি ও লাভপুরে স্থাপন করেছিলেন প্রাথমিক স্তরের বিদ্যালয় সরোজবাসিনী শিশু ভবন, লাভপুরে নির্মলশিব নিম্ন-বুনিয়াদি বিদ্যালয় এবং একটি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়— সত্যনারায়ণ শিক্ষানিকেতন। তাঁদের আত্মীয় এবং কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শম্ভুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন লাভপুর শম্ভুনাথ কলেজ। যাদবলালের ভাইপো শম্ভুনাথ ছিলেন নিঃসন্তান। সব সম্পত্তি তিনি কলেজকে দান করেছিলেন। আর কলেজের জন্য ৭২ বিঘা জমি দিয়েছিলেন সত্যনারায়ণ ও তাঁর পরিবারের সদস্যেরা।

সত্যনারায়ণ জেলা ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক ছিলেন কুড়ি বছর ধরে। আর সে সময়েই হেতমপুরের রাজাদের কাছ থেকে জমি নিয়ে সিউড়ির ডিএসএ গ্রাউন্ডের পত্তন ও উন্নয়ন ঘটান। সিউড়িতে রবীন্দ্র সদন স্থাপনের প্রাথমিক পর্যায়ে যুক্ত ছিলেন, অর্থসাহায্যও করেছিলেন সত্যনারায়ণ। যাদবলালের প্রতিষ্ঠিত দাতব্য চিকিৎসালয় সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের স্বীকৃতি পায় সত্যনারায়ণের সময়েই পঞ্চাশের দশকে। হাইস্কুলও হায়ার সেকেন্ডারি হয়েছে ষাটের দশকের শুরুতে।

সত্যনারায়ণের মৃত্যুর পরে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের অন্যান্য কলকাতা-প্রবাসী সদস্যদের সঙ্গে লাভপুরের যোগাযোগ প্রায় ছিন্ন হয়ে যায়। সে ছিন্ন-গ্রন্থি আবার জোড়া লাগে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র সুব্রতনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহায্যে। ১৯৭৭ সালে তাঁর উদ্যোগেই লাভপুরে স্থাপিত হয়েছে বিশ্বেশ্বরী শিশু শিক্ষা মন্দির। অতিথিশালা, ঠাকুরবাড়ি, দুর্গামণ্ডপ— একেবারে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানেরও নব-রূপায়ণ ঘটিয়েছেন তিনি। পরিবারের অন্য সদস্যেরাও অর্থ জুগিয়েছেন, কিন্তু লাভপুরে বসে সে কাজের বাস্তব রূপায়ণের কৃতিত্ব তাঁরই। সরকারি এবং ব্যক্তিগত সাহায্য সংগ্রহ করে শতবর্ষ-ছোঁয়া অতুলশিব মঞ্চটিকে সাজিয়েছেন নতুন সাজে।

নিজে নাটক না করলেও প্রবল নাট্যোৎসাহী এই মানুষটি এখন লাভপুরের সব নাট্যদল এবং সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানগুলির কার্যত অভিভাবকে পরিণত হয়েছেন। চার পুরুষ ধরে শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষণার শেষতম প্রতিনিধি তিনিই।

লেখক সাহিত্যকর্মী (মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tarashankar Banerje Jadavlal Banerje Luvpur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE