Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সরকার রাজস্ব আদায় করছে, তাই পেট্রোপণ্যের দাম চড়া

তেলের দাম না কমালে নয়

হিসেবটা ভেঙে বলা যাক। গত ১৯ জুন দিল্লির বাজারে পেট্রল আর ডিজ়েলের দাম ছিল লিটার প্রতি ৭৬ টাকা ২৭ পয়সা আর ৬৭ টাকা ৭৮ পয়সা।

সুরজিৎ দাস
শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৮ ০০:৪৯
Share: Save:

আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ছে বলেই দেশের বাজারেও পেট্রল-ডিজ়েলের দাম দিনে-রাতে ঊর্ধ্বমুখী, কেউ এমন যুক্তি দিলেই চেপে ধরবেন। বলবেন, তেলের দাম না হয় বেড়েছে, কিন্তু পাল্লা দিয়ে তার ওপর করের পরিমাণও বেড়েছে। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় সরকার পেট্রোপণ্যের ওপর ৩৭.৫% কর আদায় করত, রাজ্য সরকারগুলো গড়ে ২০% কর চাপাত। এখন অঙ্কগুলো দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৫০ শতাংশেরও বেশি এবং প্রায় ৪০ শতাংশে।

হিসেবটা ভেঙে বলা যাক। গত ১৯ জুন দিল্লির বাজারে পেট্রল আর ডিজ়েলের দাম ছিল লিটার প্রতি ৭৬ টাকা ২৭ পয়সা আর ৬৭ টাকা ৭৮ পয়সা। শুধু পেট্রলের হিসেবটাই লিখি। ডিলার পেট্রল কিনেছিলেন ৩৬ টাকা ৯৬ পয়সা প্রতি লিটার দরে। তার সঙ্গে যোগ হল প্রতি লিটারে ডিলারের কমিশন ৩ টাকা ৬২ পয়সা। বাকিটা কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের রাজস্ব। কেন্দ্রীয় সরকারের আদায় করা উৎপাদন শুল্ক ছিল লিটার প্রতি ১৯ টাকা ৪৮ পয়সা, আর রাজ্য সরকারের যুক্তমূল্য কর ১৬ টাকা ২১ পয়সা। এ ছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকার ২.৫% হারে আমদানি শুল্ক আদায় করেছিল। পেট্রলের দামের কতখানি বিশ্ব বাজারের কারণে, আর কতটা সরকারের কর আদায়ের ফল, সেটা এই হিসেব থেকে পরিষ্কার। লাভের পাল্লা কেন্দ্রীয় সরকারের দিকেই ঝুঁকে। ২০১৬-১৭ সালে কেন্দ্রের প্রতি ১০০ টাকা রাজস্ব আদায়ের মধ্যে ২৪ টাকাই এসেছিল পেট্রোপণ্য থেকে। রাজ্য সরকারগুলোর মোট আদায়ের ৮% এসেছিল এই খাতে। হিসেবগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের পেট্রোলিয়াম প্ল্যানিং অ্যানালিসিস সেল-এর দেওয়া।

বিশ্ব বাজারের দামের সঙ্গে দেশের বাজারে পেট্রলের দামের সম্পর্ক কেমন, দেখা যাক। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে দিল্লি মুম্বই কলকাতা চেন্নাই— চার শহরে পেট্রলের গড় দাম ছিল প্রায় ৫০ টাকা। তখন বিশ্ব বাজারে তেলের (অপরিশোধিত তেল হিসেবে ‘দুবাই ফতে’-র)দাম ছিল ব্যারেল প্রতি ৮০ ডলার। ২০১২ সালের মাঝামাঝি বিশ্ব বাজারে তেলের দাম হল ব্যারেল প্রতি ১২০ ডলার। আর ভারতে পেট্রলের গড় দাম পৌঁছল লিটার প্রতি ৮০ টাকায়। মাঝে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমতে কমতে ব্যারেল প্রতি ২০ ডলারে নেমে এখন ফের ৮০ ডলারে উঠেছে। কিন্তু ভারতের বাজারে পেট্রলের দাম লিটার প্রতি ৫০ টাকা নয়, প্রায় ৮০ টাকা। কাজেই, বিশ্ব বাজারের দোহাই দিলে চলবে না, দেশে তেলের দাম বেড়েছে করের দৌলতে। বিশ্ব বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম যখন ব্যারেল প্রতি ২০ ডলার ছিল, নরেন্দ্র মোদীর ভারতে পেট্রল বিক্রি হয়েছিল লিটার প্রতি ৭০ টাকায়। শুধু করই বাড়েনি, ডিলারদের কমিশন বেড়েছে, তেল সংস্থার লাভের পরিমাণ বেড়েছে। তেল পরিশোধনের খরচও বেড়েছে। তবে, প্রধান ফারাক হয়েছে কেন্দ্রের কর আদায়ের কারণেই। তার হার ৩৭.৫% থেকে বেড়ে ৫০% হয়েছে। আরও বড় কথা, এই করের পরিমাণটি অপরিশোধিত তেলের দামের ওপর নির্ভরশীল। তার দাম বাড়লে করের পরিমাণও বাড়ে। ফলে, ক্রেতার ওপর একই সঙ্গে দু’তরফে ধাক্কা এসেছে।

পেট্রোপণ্যের ওপর কর ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই। কর আদায়ে ঝঞ্ঝাট বা খরচও নেই। করের ধাক্কায় ক্রেতারা চটে যাবেন, সব সময় সেই আশঙ্কাও থাকে না। বিশ্ব বাজারে যখন তেলের দাম কমতে থাকে, তখন করের পরিমাণ বাড়িয়ে দিলেও বাজারের দামে তার প্রভাব পড়ে না— অপরিশোধিত তেলের দাম কমায় দেশের বাজারে যতখানি দাম কমার কথা ছিল, বাড়তি করের দৌলতে দাম তার তুলনায় ঢের কম নামলেও ক্রেতারা খেয়াল করেন না। বস্তুত, করের হার বাড়ার পরেও দেশের বাজারে পেট্রলের দাম অনেকখানি কমেছিল— ২০১৪ জুলাইয়ে ৮০ টাকা লিটার দরে যে পেট্রল বিক্রি হয়েছিল, ২০১৬-র গোড়ায় তা দাঁড়িয়েছিল ৬০ টাকায়। কারণ, এই সময়কালে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১০০ থেকে কমে ৫০ ডলারেরও নীচে চলে গিয়েছিল। এই সুযোগে সরকার রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়িয়ে নিয়েছে। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম ফের ঊর্ধ্বমুখী হয়। করের হার কিন্তু একটুও কমেনি। ফলে, পেট্রলের দাম ঠেকেছে ৮০ টাকা লিটারে। ডিজ়েলের ক্ষেত্রে সংখ্যাগুলো আলাদা, কিন্তু গল্পটা একেবারে এক।

গত আট বছরে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম যতটা ওঠানামা করেছে, দেশের বাজারে তার প্রভাব ঠেকাতে কেন্দ্রীয় সরকার করের হার বাড়াতেই পারে। অপরিশোধিত তেলের দাম যখন কম, সেই সুযোগে রাজস্ব বাড়িয়ে নেওয়া অযৌক্তিক নয়। কিন্তু, দাম যখন ঊর্ধ্বমুখী, তখন কর না কমানো হলে দেশের বাজারে দাম স্থিতিশীল থাকবে কী করে? বস্তুত, তেলের দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য একটি বিশেষ তহবিল গঠন করা যায় কি না, সরকার সেটা ভেবে দেখতে পারে। যখন বিশ্ব বাজারে দাম কম, তখন সরকার যে বাড়তি রাজস্ব আদায় করবে, তার একটা অংশ রাখা থাকবে এই তহবিলে, তেলের দাম বাড়লে সেখান থেকেই সরকার ভর্তুকি দিতে পারে।

তেলের দাম স্থিতিশীল রাখা কেন জরুরি? শুধুমাত্র গাড়ি চড়া উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য নয়, গোটা দেশের জন্যই। ডিজ়েলের দাম বাড়লে কার্যত যে কোনও পণ্যের পরিবহণ খরচ বাড়ে। তাতে সরাসরি মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। সমস্যাটা কতখানি গভীর, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিকতম আর্থিক নীতি থেকেই তা স্পষ্ট। ব্যাঙ্ক রেপো রেট বাড়িয়েছে ০.২৫ শতাংশ-বিন্দু। তাতে ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতির হার কমবে কি না সেটা অন্য তর্ক, কিন্তু সুদের হার বেড়ে গেলে শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগের আরও গতিভঙ্গ হবে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে বেকারত্বের হার। সুদের হার না বাড়িয়ে সরকার বরং পেট্রোপণ্যের ওপর কর খানিক কমাতে পারত। রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ একটু বাড়তে দিলে এই রাজস্ব হ্রাসের ফলে সামাজিক ক্ষেত্র বা অন্য কোথাও সরকারি ব্যয় না কমিয়েও চালিয়ে দেওয়া যেত। দায়িত্বটা মূলত কেন্দ্রেরই— কারণ প্রথমত, পেট্রোপণ্যের ওপর আদায় করা রাজস্বের সিংহভাগ কেন্দ্রীয় রাজকোষেই যায় এবং দ্বিতীয়ত, দাম স্থিতিশীল রাখার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের।

তেলের ওপর রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কমবে, তেমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু, ভোটের মুখে দেশের বাজারে মূল্যস্ফীতির হারে লাগাম পরাতে সুদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হল। তাতে শিল্পক্ষেত্রে ব্যয়ের পরিমাণ আরও বাড়বে— তেলের দাম বাড়ার ফলে পরিবহণের ব্যয়বৃদ্ধির পাশাপাশি সুদ বাড়ার ফলে ঋণ করার ব্যয়ও বাড়বে। শিল্পক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়বেই। তাতে মূল্যবৃদ্ধি হবে, জিডিপি-র বৃদ্ধির হারের ওপর প্রভাব পড়বে, কর্মসংস্থান কমবে।

‘অচ্ছে দিন’ আসতে আর বাকি থাকল কী?

দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

reduction Petrol Price Hike Revenue
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE