Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
সুস্থ রাজনীতি থাকলে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে আন্দোলন করতে হত না

শিক্ষা শুধুই স্বার্থ ও কৌশল?

নেতাদের কথা বলতে লাইসেন্স লাগে না। রাজেশ সরকার নামক ছাত্রের মৃত্যুসংবাদ প্রকাশিত হওয়া মাত্র শাসকদলের একাধিক নেতা ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়ে দিলেন: কে বা কারা এর পিছনে মদত জুগিয়েছে।

কুমার রাণা
শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:৪১
Share: Save:

হয়তো মৃত্যুরও হৃদয় আছে, কিন্তু রাজনেতারা তো তারও বাইরে। অতএব, যে মুহূর্তে লজ্জায় অধোবদন হওয়ার কথা, নতজানু হয়ে মার্জনা প্রার্থনার কথা, শুধু নিহত ছাত্রদের মাতা-পিতার কাছেই নয়, রাজ্যের তাবৎ ছাত্র-ছাত্রী ও তাদের জনক-জননীর কাছে— তখন রাজনেতাদের নির্লজ্জ উল্লাস কদাচ অস্বাভাবিক নয়। মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়, ছাত্র-হত্যা নিয়ে এই চাপান-উতোর, দাড়িভিট গ্রামে রাজনেতাদের ভ্রমণ প্রতিযোগিতা। মৃত্যুও তাদের কাছে আসার আগে হয়তো ক্ষমা ভিক্ষা করেছিল, কিন্তু নেতারা করেননি। জল প্রকৃতই ঘোলা, আর সে জলে মাছ থাকার বহুল সম্ভাবনা। দলীয় রাজনীতির ব্যাপারিরা সে সুযোগ ছাড়বেই বা কেন?

নেতাদের কথা বলতে লাইসেন্স লাগে না। রাজেশ সরকার নামক ছাত্রের মৃত্যুসংবাদ প্রকাশিত হওয়া মাত্র শাসকদলের একাধিক নেতা ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়ে দিলেন: কে বা কারা এর পিছনে মদত জুগিয়েছে। আবার তদন্ত শুরু হওয়ার আগেই খোদ মুখ্যমন্ত্রী ইটালি থেকে জানিয়ে দিলেন, পুলিশ গুলি চালায়নি, অন্য কেউ চালিয়েছে! কালক্ষেপ না করে বিরোধী দলগুলিও তাঁদের ‘আন্দোলন’ শুরু করে দিলেন: অমুক তদন্ত চাই, তমুকের পদত্যাগ চাই।

হয়তো তদন্ত হবে। লোকসাধারণ যে হেতু দলীয় রাজনীতি ও রাষ্ট্র সম্পর্কে তেমন ওয়াকিবহাল নন, তাঁরা এখনও তা বিশ্বাস করছেন, সেই বিশ্বাসে নিহত সন্তানদের দাহ না করে সমাধিস্থ রেখেছেন। হয়তো তাদের বিনষ্ট দেহের অস্থি থেকে পাওয়া যাবে তথ্যসূত্র। লোকসাধারণের বিশ্বাস অগাধ, সেই বিশ্বাসেই তাঁরা যেমন ভোট দেন, বা আশা রাখেন যে নেতারা তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাগুলোর সমাধান করবেন— তেমনই তাঁরা সন্তানদের স্কুলে পাঠান এই আকাঙ্ক্ষায় যে স্কুলে তারা শিক্ষালাভ করবে, নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্মাণের চেষ্টা করবে। যুগ কেটে যায়, সুদিন তো আসে-ই না, মানুষের মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার মর্যাদাটুকুও লুঠ হতে থাকে। অনেক পরীক্ষানিরীক্ষার দরকার নেই, যে ছাত্রহত্যা নিয়ে আজ পশ্চিমবঙ্গের দলীয় রাজনীতি এত মুখর, সেই ছাত্রদের সাধারণ দাবি নিয়ে এ রাজ্যের— এবং এ দেশের, ‘মাই-বাপ’রা যে ভাষায় কথা বলছেন তা সভ্য সমাজে চলবার কথা নয়। ক’দিন আগে দেশের শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, “স্কুলগুলো সরকারের কাছে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে আসে কেন?’’ তেমনই এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সহকর্মী ও প্রশাসনকে তিরস্কার না করে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের দোষী সাব্যস্ত করে দিয়েছেন। তাঁর বিধান: শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে ছাত্রদের কোনও দাবি থাকতে পারে না। তাদের যদি বাংলার শিক্ষক ইংরেজি পড়ান, সেটাও না কি চলতে পারে। অর্থাৎ, সংস্কৃত-র শিক্ষক জীবনবিজ্ঞান, বা উর্দুর শিক্ষক পদার্থবিজ্ঞান পড়াতেই পারেন!

আশ্চর্য হওয়া কঠিন। যে দেশে সরকার মনে করে শিক্ষার জন্য রাজকোষ থেকে অর্থ দেওয়াটা বড় জোর খয়রাতমাত্র, লোকেদের সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার ওপর কোনও হক নেই, এবং তাবৎ বিরোধী দল সেটা প্রশ্নহীন ভাবে মেনে নেয়, কেননা কখনও না কখনও তারাও সরকারে আসীন থাকতে পারে, কিংবা আসীন হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা রােখ— সে দেশে এমনটাই হওয়ার কথা। সুতরাং বিধি মেনেই ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো নিয়ে চু-কিতকিত খেলা। শিক্ষার মতো একটা সামাজিক ন্যায্যতার দাবি নিয়ে মৃত্যু ঘটে যাওয়ার পরও শিক্ষা নিয়ে কোনও কথা নেই, দলীয় রাজনীতি তাকে সহজেই পুরে ফেলে গোষ্ঠীস্বার্থের সংকীর্ণ খোপে।

অথচ রাজনীতি যদি ঈষৎ সুস্থ হত, সেখানে যদি লোকসাধারণের সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রশ্নটা সামান্যতম স্থানও পেত, তা হলে শিক্ষকের দাবি নিয়ে ছাত্রদের আন্দোলনে যেতে হত না। বস্তুত, এটাই বিশ্বাস করা কঠিন, কী করে একটা সভ্য দেশে ছাত্রদের শিক্ষকের দাবিতে আন্দোলনে যেতে হয়। তাদের আন্দোলন করার নানা কারণ থাকতে পারে, কিন্তু স্কুল থাকবে অথচ শিক্ষক থাকবেন না, এমন একটা উৎকট, অশ্লীল ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদে নামার প্রয়োজনটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, এ দেশ এখনও সভ্য ব্যবস্থাপনা থেকে কতটা দূরে। কেরল-তামিলনাড়ুর মতো কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে সারা দেশ জুড়েই শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্কটটা একেবারে বুনিয়াদি: এক দিকে ইস্কুল, শিক্ষক, প্রশিক্ষণ, উপকরণের অভাব, এবং সেই সঙ্গে যেটুকু পাওয়া যায় তার বণ্টনে ঘোর অসাম্য, এবং অন্য দিকে শিক্ষার বিষয়বস্তুকেই পশ্চাৎমুখী করে তোলা— শিক্ষাবিজ্ঞান নামক যে শাস্ত্রটা বিশ্বের ভাণ্ডার থেকে জ্ঞান আহরণ করে গড়ে উঠেছে, এ দেশে তার মূল্য নেই, এখন সবই বিশ্বাসে মিলায় বস্তু! যে দলটি নিজেদের বিশ্বাসকে সকলের বিশ্বাস করার জন্য দেশ জুড়ে বলপ্রয়োগ করে চলেছে, সেই বিজেপি যে শিক্ষার মৌলিক চাহিদা ইত্যাদি নিয়ে কোনও কথা বলবে না সেটা বুঝতে অসুবিধে নেই। কিন্তু প্রগতিবাদী বামপন্থীদের কী হল?

এ রাজ্যে প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা, সর্বত্র নানা অসঙ্গতি। সম্ভবত এর সর্বাপেক্ষা কুৎসিত প্রকাশ দেখা যায় শিক্ষক নিয়োগে। যেমন, প্রাথমিক স্তরে গড় হিসেবে খুব অভাব না থাকলেও শিক্ষকের বণ্টনে বিপুল অসাম্য। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে সে অসাম্য আরও প্রকট। যত প্রান্তে যাবেন, ততই শিক্ষকের অভাব। যত কেন্দ্রের কাছাকাছি, তত শিক্ষক উদ্বৃত্ত। এই কলকাতা শহরেই বালিগঞ্জ এলাকার এক স্কুলে সব বিষয়ের একাধিক শিক্ষক, কিন্তু মেটিয়াবুরুজে বহু পদ খালি। বীরভূমের এক গ্রামের স্কুলে কেবল শিক্ষকের অভাবে বিজ্ঞান পড়ানো বন্ধ করে দিতে হয়েছে, যদিও এই বিজ্ঞান বিষয়েই আবার নগরাঞ্চলের স্কুলগুলোর ছবিতে শিক্ষক অনেক উদ্বৃত্ত।

শিক্ষাব্যবস্থার গণতন্ত্রীকরণ নিয়ে বাগাড়ম্বরে খামতি নেই, কিন্তু তাকে আমলাতান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত করার কাজ যে এখনও অবধি কতটা হয়েছে তা কোনও একটা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যায়। তাঁদের দিয়ে খোলাখুলি কথা বলানো কঠিন। যেমন, এক প্রধান শিক্ষক জানালেন— আপনাকে মিনতি করছি, আমার বা আমার স্কুলের নাম লিখবেন না। চাকরি না হয় রইল, কিন্তু মার খাওয়া থেকে বাঁচাবে কে?

অনুরোধ এড়ানো যায়, কিন্তু মিনতি? অতএব নাম গোপন রেখেই তাঁর বক্তব্য বলি। গত চার বছর ধরে তাঁর স্কুলে আট জন শিক্ষকের পদ খালি, কিন্তু তিনি খালি দেখাতে পারছেন মাত্র তিন জনের, কারণ এর বেশি খালি দেখাতে হলে তাঁকে অনুমোদন নিতে হবে। কর্তৃপক্ষের মর্জি হয়নি, তাই অনুমোদন মেলেনি। পাশাপাশি আছে নানা খুড়োর কল। যেমন, সংরক্ষিত শ্রেণির প্রার্থী পাওয়া কঠিন, এমন পদগুলোকেই সংরক্ষণের আওতায় ফেলে রাখার মতো বহু পুরনো এক তন্ত্রবিদ্যার অনুশীলন।

সরকার যে হেতু টাকা দেয় তাই তথ্যের ওপর অধিকারও তার! জনসাধারণ তো সরকারের বদান্যতার মুখাপেক্ষী, তাই তার পক্ষে জনপরিসরে তথ্য পাওয়া সুলভ নয়। যেমন, রাজ্য সরকারের বিদ্যালয় শিক্ষা দফতরের ওয়েবসাইট থেকে আপনি যেটুকু তথ্য পাবেন, তা অন্তত সাত বছরের পুরনো। মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ, উচ্চ-মাধ্যমিক কাউন্সিল, প্রভৃতি দফতরের সাইট ঘেঁটেও কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয় যে, রাজ্যে ঠিক কত এবং কী কী বিষয়ের শিক্ষকের পদ খালি আছে। কিন্তু, বণ্টনগত বৈষম্যটা কতটা মারাত্মক, তার কিছুটা আঁচ মিলতে পারে সর্বশিক্ষা মিশনের সংগৃহীত তথ্য থেকে— ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব এডুকেশনাল প্ল্যানিং অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন যে হিসেব দেয়। ২০১৪-১৫ সালের (আংশিক) হিসেব অনুযায়ী, এ রাজ্যে মাধ্যমিক এবং উচ্চ-মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষক-পিছু ছাত্রের অনুপাত কলকাতায় ১৮, আর উত্তর দিনাজপুরে ৩৫! এখানেই শেষ নয়, ব্লক থেকে ব্লক, গ্রাম থেকে গ্রাম, এই অনুপাতের বিপুল পার্থক্য। যে উত্তর দিনাজপুরে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত রাজ্যের মধ্যে সর্বাধিক, সেখানেই আবার নগরাঞ্চলে এমন স্কুলও আছে যেখানে এই অনুপাত ১৫!

এই দুঃস্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত হয়, বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগের ভয়াবহ অভাব। উচ্চ মাধ্যমিক কাউন্সিলের সাইট থেকে যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে রাজ্যে বিজ্ঞান শিক্ষার পরিমণ্ডল নিয়ে— আশঙ্কা নয়— আতঙ্ক হওয়ার কথা।

হত্যা সহজেই দলীয় রাজনীতিকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু হত্যার নিবারণে তার যে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, ইসলামপুরের ছাত্রহত্যা-পরবর্তী রাজনীতি তাকেই প্রমাণ করতে ব্যস্ত। কোনও দলের মুখে শিক্ষার সংসাধনে ঘোর বৈষম্য বা অব্যবস্থা নিয়ে কোনও কথা নেই। অস্বাভাবিক মৃত্যু না ঘটা পর্যন্ত কোনও আন্দোলন হবে না, এটাই যেন রাজনীতির ব্যাকরণ। এবং সে আন্দোলনে মানবিক বিকাশ নয়, দলের কোলে ঝোলের পরিমাণটাই একমাত্র বিচার্য। মৃত্যু বাস্তবিক সহৃদয়, একমাত্র সে-ই মানুষকে সঙ্গ দেয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Politics Teacher appointment Protest
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE