Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

গরিবের সুরক্ষার অধিকার নেই

চিকিৎসাশাস্ত্র বলবে, আত্মীয়তার চেয়ে আরও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল কিছু শর্ত পূরণের প্রয়োজন থাকে। গর্ভ ভাড়া প্রসঙ্গে রোগীর স্বাধিকার বা সার্বভৌমত্বের কথা ওঠে বন্ধ্যাত্ব-পীড়িত দম্পতির কথা মাথায় রেখেই।

প্রজ্ঞাপারমিতা মণ্ডল
শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৮ ০০:৩৫
Share: Save:

কেন্দ্রীয় সরকার জানাল, ২০১৬ সালের সারোগেসি (রেগুলেশন) বিলটিকে আইনে পরিণত করার জন্য মন্ত্রিসভার সম্মতি মিলেছে। বাণিজ্যিক গর্ভ ভাড়ার প্রথা রদ করে অলট্রুয়িস্টিক বা পরার্থবাদী গর্ভ ভাড়া দেওয়াকেই স্বীকৃতি দেওয়া হবে। ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া বা কানাডায় যে পরার্থবাদী ব্যবস্থা চালু, তার সঙ্গে ভারতের ব্যবস্থার ফারাক আছে। সে দেশগুলোতে যে কোনও মহিলা অর্থবিনিময় না করে আইভিএফ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অন্য কারও জন্য গর্ভধারণ করতে পারেন। ভারতের নিয়ম, কমপক্ষে পাঁচ বছর যাবৎ বন্ধ্যাত্বে পীড়িত এমন ভারতীয় দম্পতিরাই ‘নিকট আত্মীয়া’র গর্ভ ব্যবহার করতে পারবেন।

চিকিৎসাশাস্ত্র বলবে, আত্মীয়তার চেয়ে আরও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল কিছু শর্ত পূরণের প্রয়োজন থাকে। গর্ভ ভাড়া প্রসঙ্গে রোগীর স্বাধিকার বা সার্বভৌমত্বের কথা ওঠে বন্ধ্যাত্ব-পীড়িত দম্পতির কথা মাথায় রেখেই। কারণ রোগ বা তার চিকিৎসার উপায় এবং সেই সম্পর্কিত তথ্য নিয়ে সামাজিক ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার নিছক বিলাসিতা নয়। অন্তত সামাজিক আন্দোলন, ধারণাগত বিপ্লব বা বিশেষ বিশেষ রোগের প্রতি সামগ্রিক নৈতিক মননের পরিবর্তন না ঘটলে সে দাবি করাই অসম্ভব। কিন্তু এ সব যুক্তিতে জল ঢেলে ভারতে সারোগেসিকে একটা নতুন অবয়ব দেওয়া হচ্ছে। পরার্থবাদের এক নতুন সীমারেখা নির্দিষ্ট করা হচ্ছে কারণ সারোগেসি এখন থেকে হতে চলেছে একটি পারিবারিক দায়বদ্ধতা— প্রজনন অক্ষমতা থেকে নিকট আত্মীয়দের উদ্ধার করে মমত্ব, সহানুভূতি ও বাৎসল্য প্রদর্শনের একটা জায়গা।

অনেকের মত, ‘ভাড়াটে গর্ভ’ হল মাতৃত্বের অবমাননা। টাকা না নিয়ে সারোগেসি করলে ‘নিকট আত্মীয়া’র দেহ ও মর্যাদার কী ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে তা নিয়ে যদিও কেউ ভাবিত নন। আইভিএফ প্রক্রিয়া যদি এই দুই শ্রেণির মহিলার উপরেই একই ভাবে প্রয়োগ করা হয়, তা হলে টাকা নেওয়া বা না নেওয়ায় তাঁদের সামাজিক ও শারীরিক পরিণাম কেন আলাদা হবে? সারোগেসি করে অর্থোপার্জন সম্ভব হলে কোনও গরিব মহিলার কাছে দ্বিতীয় বার সারোগেট হওয়ার বা অনাবশ্যক ঝুঁকি নেওয়ার হাতছানি থাকে বটে। কিন্তু নজরদারি ব্যবস্থা নড়বড়ে হলে এবং দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে আইন প্রণয়ন না করে, দফায় দফায় প্রকাশিত ও পরিবর্তিত বিলের ভরসায় দেশে সারোগেসি চালিয়ে গেলে এমনটা হওয়ার সম্ভাব্যতা বেশি হতেই পারে।

বাণিজ্যিক সারোগেসিতে গর্ভ ভাড়া দিতে আসা মহিলাদের বিপুল শোষণের সম্মুখীন হতে হয়, এই ধারণাটি নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বেশ পোক্ত। এই ধারণার একটা দার্শনিক ভিত্তি আছে— টাকার বিনিময়ে হলেও সারোগেসির প্রক্রিয়াটি দাঁড়িয়ে আছে অসম লেনদেন ও অসম তথ্যের বিনিময়ের উপর। অনেকে আবার মনে করেন যে স্রেফ গরিব হওয়ার দরুন নিজের প্রজনন ক্ষমতাকে বিক্রি করতে বাধ্য হওয়াটাই এক প্রকার শোষণ। বাণিজ্যিক সারোগেসি নিয়ে গবেষণা করার সুবাদে বহু বার ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে গিয়ে দেখেছি, এ রকম একমাত্রিক কোনও ধারণা বাস্তবের ওপর চাপিয়ে দেওয়া মুশকিল। শুধুমাত্র বাধ্য হয়েই মেয়েরা বাণিজ্যিক সারোগেসিতে সম্মত হন, এমন কথা বলে দেওয়া আসলে বেশ গোলমেলে। অভিজ্ঞতার নিরিখে বলতে পারি, সারোগেটদের ‘সম্মতি’ এবং তাঁদের তথ্যভিত্তিক সচেতনতা নিয়ে সে রকমই সূত্র পাওয়া গিয়েছে। এক জন অশিক্ষিত, দরিদ্র মহিলার পক্ষে ডাক্তার এবং কমিশনিং জনকজননীর সঙ্গে কোনও রকম দরাদরি করা সম্ভব নয়, অথবা নিজের স্বার্থরক্ষা করা সম্ভব নয়— এ কথাও কিন্তু সব ক্ষেত্রে সমান সত্যি নয়। দারিদ্র লাঘব করার জন্য কোনও মহিলাকে নিজের গর্ভ ভাড়া দিতে হচ্ছে, এটা নিয়ে সমাজের কোনও অংশের মনে অস্বস্তি থাকতেই পারে। কিন্তু সেই অস্বস্তি এই মহিলাদের বাস্তবকে বদলে দেয় না, আরও কঠিন করে তোলে।

আরও বড় প্রশ্ন, শোষণের উপাদান বিচারের সময় আমরা কি কোনও সামগ্রিক ‘ভাল’ বা ‘মন্দ’-র আদলে তাকে চিহ্নিত করতে পারি? তারতম্য ভেদে কোন শোষণ স্বাভাবিক আর কোনটা প্রথাগত, কোন শোষণের রূপ বরদাস্ত করা যায় আর কোনটা একেবারেই অনুমোদনযোগ্য নয়— এ বিষয়ে ঠিক কোন নিয়মনির্দিষ্ট, চাঁচাছোলা যুক্তির আশ্রয় নেব? শোষণমূলক কাজ এবং কাজের ক্ষেত্রে শোষণ— দুইয়ের মধ্যে সূক্ষ্ম ধারণাগত ব্যবধান রক্ষার দায়ও কিন্তু সমাজেরই। আমাদের সামাজিক নীতিগত কর্তব্য কোনটা— শোষণের সম্ভাবনা আছে এমন কাজের ধারণাকেই পত্রপাঠ বিদায় জানানো, না কি সেই সব কাজের পরিসরে শোষণের প্রভাব কমিয়ে তাকে (উন্নয়নের) অনুকূল করে তোলা?

দরিদ্র সারোগেট মহিলাদের প্রতিকূল আর্থসামাজিক অবস্থানের ফলে চুক্তির বিনিময়-বণ্টনে অসাম্য থাকতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে তাঁদের শোষণের সহজ নিশানায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। কিন্তু, তা ঠেকানোর জন্য সারোগেসি চুক্তি মজবুত করা যেত, এবং সেই প্রেক্ষিতে মহিলাদের ক্ষমতা প্রসারণের কথা ভাবাই যেত। কিন্তু টাকার বিনিময়ে কোনও গরিব মহিলার গর্ভদানকে ‘আপত্তিকর’ বলে দেগে দেওয়া হলে, তাঁর আর্থসামাজিক চাহিদার গুরুত্ব ও সেই চাহিদা পূরণে তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগের মর্যাদাকেও অস্বীকার করা হয়। সেই সঙ্গে বোধ হয় এই ইঙ্গিতও দেওয়া হয় যে সরকারি নীতিব্যবস্থা বা রাষ্ট্রীয় আইনযন্ত্র দুর্বল আর্থসামাজিক বর্গের মানুষদের বাজারে সুরক্ষিত বিনিময়ের সুযোগ করে দিতে অপারগ। তাই তাঁদের জন্য একমাত্র বিকল্প হল বাজার থেকে অপসারণ। প্রশ্ন করা প্রয়োজন, বিনিময়ের সুরক্ষা কি তা হলে সামাজিক সুরক্ষার অন্তর্ভুক্ত নয়?

নাড়াজোল রাজ কলেজে ইংরেজির শিক্ষিকা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

protection poor Right
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE