Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
উপায় নেই, তাই কাজের খোঁজে নিত্য ঘরছাড়া অগণিত শ্রমজীবী

ট্রেনে গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি করে ওরা কোন ঠিকানায় চলেছে, কেউ জানে না

অসংখ্য দালাল কোনও ভাবে নথিভুক্ত না হয়েই লেবার নিয়ে যাচ্ছে। তারা কোন ঠিকানায় চলেছে কেউ জানে না। এখন ট্রেনের সংখ্যা বেড়েছে। তবু শীতের ওই ফসল ওঠার পরের দিনগুলোয় পশুর চেয়ে হীনতর অবস্থায় মানুষ যায়। গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি। শিশুদের অবস্থা শোচনীয়, ভিড়ের চাপে শিশুমৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে গত বছর।

অনিতা অগ্নিহোত্রী
শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

তারা চলে গিয়েছে। নবান্নের নতুন ধান ওঠার উৎসবের পরই দাদন দিয়ে গিয়েছে ঠিকেদার। অনেক টাকা ভূমিহীন খেতমজুর ও প্রান্তিক চাষির সংসারে। চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকা এক থোকে। নাগপুর থেকে যে গাড়ি আসে তাকে থামিয়ে রাখা হয় কাঁটা বাঞ্জি স্টেশনে। ট্রেন যায় বলাংগীর থেকে কাঁটা বাঞ্জি হয়ে রায়পুর। রায়পুর থেকে লাইন গিয়েছে হায়দরাবাদ। গিয়েছে উত্তরে, গোরখপুর, ইলাহাবাদ। ফাল্গুনের দুপুরে শান্ত কাঁটা বাঞ্জি স্টেশন যেন প্রায় ঘুমন্ত। থমথমে। দেখলে বোঝা যাবে না নভেম্বরে এখানে থইথই করে মানুষ। ছেলে মেয়ে বৌ নিয়ে সংসারী মানুষ। দালালদের রেজিস্ট্রেশন করে জেলা লেবার অফিস। এ বছর পাঁচশোর বেশি হয়েছে। অসংখ্য দালাল কোনও ভাবে নথিভুক্ত না হয়েই লেবার নিয়ে যাচ্ছে। তারা কোন ঠিকানায় চলেছে কেউ জানে না। এখন ট্রেনের সংখ্যা বেড়েছে। তবু শীতের ওই ফসল ওঠার পরের দিনগুলোয় পশুর চেয়ে হীনতর অবস্থায় মানুষ যায়। গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি। শিশুদের অবস্থা শোচনীয়, ভিড়ের চাপে শিশুমৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে গত বছর।

মানুষ কেন মরসুমে দেশান্তরে যায়? আমি যেখানে গিয়েছিলাম, ওড়িশার সেই নওয়াপাড়া ও বলাংগীর জেলা থেকে ভূমিহীন খেতমজুর ও প্রান্তিক চাষিরা যান উত্তরপ্রদেশ ও অন্ধ্রপ্রদেশের ইটভাটায় কাজ করতে। তামিলনাড়ুর গৃহনির্মাণ প্রকল্পে। হরিয়ানা পঞ্জাবে খেতের কাজে। বাইরে মজুরি বেশি, কাজও অপর্যাপ্ত। রাজ্যের মধ্যে মজুরি কম। কাজও সীমিত। তার ওপর দাদনের নগদ। এমন বহির্গমন শুখা মরসুমে অন্য রাজ্য থেকেও হয়: পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, পূর্ব উত্তরপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়। রাজ্যের দরিদ্রতর এলাকা থেকে অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন, সজলতর এলাকায়। রাজ্যের বাইরে।

দেশান্তরী হলে ক্ষতি কী? স্থানান্তরেই তো লুকিয়ে আছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। মেট্রো শহরগুলিতে দিনে হাজার হাজার মানুষ গ্রাম থেকে এসে ফুটপাত থেকে জীবন শুরু করেন। সেও এক দুর্নিবার বাঁচার লড়াই। কিন্তু মরসুমের এই দেশান্তর এক ভয়াবহ অসহায়তা ও অবনমনের ছবি তুলে ধরে। কয়েকটি গ্রামে ঘুরে, স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেল, পঞ্চাশ থেকে আশি শতাংশ ঘরের দুয়োরে তালা। কোনও কোনও ঘরে বৃদ্ধ বৃদ্ধা শিশু ছাড়া কেউ নেই। মহাত্মা গাঁধী এনআরইজিএ-র কাজ আরম্ভ হয়নি মার্চ মাসেও। টাকার বরাদ্দ যথেষ্ট নয়। নানা প্রশাসনিক কারণে কাজ আরম্ভে দেরি। তা ছাড়া গত তিন বছরের বকেয়া টাকাও অনুমোদিত হয়ে আসেনি কেন্দ্র থেকে। এর মাস পাঁচেক আগেই দালালরা দাদনের টাকা নিয়ে দোরগোড়ায় হাজির। ছোট চাষি মজদুর কোন ভরসায় গ্রামে থাকার সাহস দেখাবে? সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে পুরো পরিবার। দাদনের টাকা খেটে শোধ করতে হবে। তা না হলে ফেরার পথ বন্ধ। স্ত্রী সঙ্গে থাকলে সে-ও কাজে হাত লাগাবে। ছেলেমেয়েদের অবসরে দেখবে। গ্রামের মানুষের বড় অবলম্বন তার সামাজিক সামুদয়িক জীবন। গ্রামে কাজ নেই, রোজগার নেই। কিন্তু আছে পালাপার্বণ, মন্দির মসজিদ, গানের নাচের আসর, যাত্রা নাটক। ভিনরাজ্যের কাজের জায়গায় পশুর খোঁয়াড়ের মতো ঝুপড়ি বা বড়জোর কাঁচা ইটের ঘর। শৌচাগার নেই। নেই স্নানের জল। শিশুগুলি পড়াশুনো করে না। সারা দিন ধুলোয় গড়ায়, খেলে। বাবা মা কাজ করছেন। দাদনের টাকা শোধ হচ্ছে। খাদানের ধুলো, ভাটার ধুলো, ইট পোড়ানোর ধোঁয়া গিয়ে জমছে ফুসফুসে। চিকিৎসার কোনও নির্ধারিত ব্যবস্থা নেই। মালিকের দয়া হলে পরচি দিয়ে ডাক্তারের কাছে পাঠাল, না হলে নিজের টাকায়। তা-ও ছুটি পেলে তবেই। ভিনদেশে বার বার ডাক্তারের কাছে ছোটা, পয়সা খরচ করে, তা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

দাদন কেন নেয় মানুষ? বছরকার খাওয়া, জামাকাপড়, তেলনুনের দরকার মেটানোর পর নানা খরচ আছে, যেমন বিয়ে, তীর্থযাত্রা, শ্রাদ্ধশান্তির ভোজ, যে সব প্রয়োজনে ব্যাঙ্ক ঋণ দেবে না। নিখরচায় ক্রেডিট কার্ডের টোপ— সে সব শহুরে মধ্যবিত্তের জন্য। স্থানীয় মহাজন ধার দেবে চড়া সুদে, সে ধার শোধ করতে যে কাজ জোটাতে হবে তা গ্রামে নেই। দাদনের হিসেব সোজা। টাকা নাও অগ্রিম, শরীরে খেটে শোধ কর। যুক্তিটা সহজ মনে হলেও ভিনদেশে কাজ করার বাস্তব সম্পূর্ণ আলাদা। এ এক চক্রব্যূহ, ঢোকা সহজ, বেরোনো কঠিন। আঠারো ঘণ্টা কাজ, ভুল হলেই মার, গালিগালাজ, চোখরাঙানি। অধিকার ভোগ তো দূরে থাক, আওয়াজ বার করার জো নেই। তত্ত্বের হিসেবে, ভিনরাজ্যে গিয়েও শ্রমিক ও তার পরিবারের পাওয়ার কথা ন্যায্য মূল্যে শস্য, ন্যূনতম মজুরি, নিয়ন্ত্রিত কাজের ঘণ্টা, বিশ্রাম, চিকিৎসা, শিক্ষা। কার্যত কিছুই হয় না। নথিভুক্ত দালালের ক্ষেত্রেই হয় না, বেআইনি দেশান্তরে তো প্রশ্নই নেই।

নববিবাহিত যুবক গিয়েছিল ইটভাটায়, স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়েই। প্রসবের সময় নানা জটিলতা, চিকিৎসার বিপুল খরচ। মেয়েটি বাঁচল না। মালিকের মধ্যস্থতায় স্ত্রীর মৃতদেহ ছাড়াতে পারল কোনও মতে, কিন্তু শিশুটিকে রেখে নিল ওরা, এত টাকা ধারের মূল্য হিসেবে। জেলা কালেক্টরের চেষ্টায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, পুলিশ সঙ্গে নিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করে আনে। ফেরার পর স্টেশনে গলায় ফুলের মালা পরা তাদের ছবি কাগজে ছাপা হয়। একে কি সাফল্য হিসেবে ধরা যাবে?

রাজ্যের বাইরে নানা কর্মপরিসরে মেয়েদের উপর যে নিত্য লাঞ্ছনা ও অত্যাচার হয়, তার খুব অল্পই বাইরে আসে। ঠিকাদার, মালিকের লোক, সর্দার— অবরুদ্ধ পরিসরে যে কেউ বনে যেতে পারে অত্যাচারী। সহজ ব্যাপার। বাবা মা জেনেও প্রতিবাদ করতে পারেন না। নিজের গ্রামে ফিরে গেলে কর্মহীন জীবন, অনাহারের ভয়, তা ছাড়া দাদনের এককালীন টাকা হারানোর আশঙ্কা। এঁরা গিয়েছেন ইটভাটা বা গৃহনির্মাণ প্রকল্পে। বিস্তৃত অসংগঠিত ক্ষেত্রের আছে নিজস্ব অর্থনীতি। বাংলার মেয়ে দালালের হাত ধরে গৃহপরিচারিকার কাজ করতে গিয়ে ধর্ষিতা, নিহত, দেহের খণ্ডাংশ থলেতে— এ আজও হয়ে চলেছে। কত মেয়ে ঠিকানা বদল করতে করতে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছেন কিংবা নামমাত্র বিয়ের পর পাচার হয়ে গিয়েছেন মাংসের বাজারে, তার পরিসংখ্যান নির্দিষ্ট নয়।

চুক্তি-শ্রমিক নিয়োগ সম্বন্ধীয় আইন দাদন দিয়ে বা বেআইনি ভাবে পাচার হওয়া শ্রমিকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। নির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত, সমস্ত ঠিকাদার, সর্দার ও শ্রমিকের আবশ্যিক নথিভুক্তি প্রয়োজন, না হলে সমস্যার উপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। অন্য দিকে শ্রমিকের দেশান্তরী হওয়া বন্ধ করে দেওয়াও আইনসঙ্গত নয়, এতে মানুষের সক্রিয় সিদ্ধান্ত জড়িত। সংবিধানে আছে মানুষের চলাচলের অধিকার। সম্পন্ন রাজ্যের যুবকযুবতী চলেছে বিদেশে। শ্রম দিতে। তাদেরও আছে নিজস্ব বিপন্নতা। তাদের জায়গা পূরণ করছে অন্য, কম উন্নত রাজ্যের শ্রমিক। দেশান্তরের ঝুঁকি ও বিপদ কম করানোর জন্য যে বিশাল হারে, সারা বছর কাজ করা দরকার তা হতে পারছে না। শ্রম বিভাগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি কোথাও কোথাও কাজের সময় বেঁধে দেওয়া, শিশুদের স্কুল চালু করা, এ সব নিশ্চিত করছে। কিন্তু যে বিপুল সরকারি যন্ত্র দেশান্তরী শ্রমিকের নথিভুক্তি ও প্রাপ্য আদায়ে নিয়মিত ভাবে ব্যবহৃত হতে পারত তাদের তৎপরতার অভাব মার্জনার অযোগ্য।

অথচ এতে অর্থের প্রয়োজন নগণ্য। দরকার একটি কার্ড ও রেজিস্ট্রেশন নম্বরের ভিত্তিতে পরিষেবার স্থানান্তর— স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসার যে সুবিধে শ্রমিকের পরিবার নিজের গ্রামে পেতে পারত, তা ভিন্ন রাজ্যের ঠিকানাতেও কোনও আবেদন নিবেদন ছাড়াই পাবে, এটা আধারের মতো অদ্বিতীয় অভিজ্ঞানপত্রের মাধ্যমেও হতে পারে। এ ছাড়া আছে নিরাপত্তার অধিকার। কিন্তু আমাদের প্রাথমিকতায় এর জায়গা এখনও আসেনি। এই নিস্পৃহতার ফলে নষ্ট ও খণ্ডিত হয়ে চলেছে একটি সম্পূর্ণ প্রজন্ম। নিজস্ব ঠিকানায় সারা বছর থাকতে পারেন না বলে অনেক দেশান্তরী শ্রমিক ভোট দিতে পারেন না। এবং নির্বাচনের নিরন্তর চক্র আমাদের মনোযোগ যেমন ভাবে আকৃষ্ট করে রাখে, তেমন কি আর অন্য কোনও কিছু?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Labour Foreign Slave Contractor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE