Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

ব্রাহ্ম সমাজের শাখা ছিল কালনাতেও

অম্বিকা-কালনায় ব্রাহ্ম সমাজের শাখাটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রত্যক্ষ নির্দেশে এই শাখাটি প্রতিষ্ঠিত হয় বলে জানা যায়। লিখছেন সোমনাথ ভট্টাচার্যঅম্বিকা-কালনায় ব্রাহ্ম সমাজের শাখাটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রত্যক্ষ নির্দেশে এই শাখাটি প্রতিষ্ঠিত হয় বলে জানা যায়। লিখছেন সোমনাথ ভট্টাচার্য

(বাঁ দিকে) মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। (ডান দিকে) কেশব সেন। ফাইল ছবি

(বাঁ দিকে) মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। (ডান দিকে) কেশব সেন। ফাইল ছবি

শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৮ ০০:১২
Share: Save:

ধর্মমত সম্পর্কে আলোচনার জন্য রাজা রামমোহন রায় কলকাতায় তাঁর কয়েকজন বন্ধু এবং অনুগামীকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘আত্মীয় সভা’ (১৮১৫)। এই সভার আদি সদস্য ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, নন্দকিশোর বসু প্রমুখ। রামমোহন ধর্মচেতনার দিক থেকে ছিলেন একেশ্বরবাদী। ভারতীয় হিন্দু দর্শনের পাশাপাশি, রামমোহন অন্য ধর্মে সম্পর্কেও পড়াশোনা করে শেষ পর্যন্ত একেশ্বরবাদী দর্শনে স্থিত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে একেশ্বরবাদ সম্পর্কে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যেতেই তাঁর উদ্যোগে গড়ে ওঠে ‘ব্রহ্মসভা’। এই প্রতিষ্ঠানটিই পরবর্তীকালে ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ নামে পরিচিত হয়। রামমোহনের এই একেশ্ববাদী দর্শনের উৎস ছিল বেদান্ত ও উপনিষদ।

১৮৩০ সালে রামমোহন রায় বিলেত যাত্রা করেন। প্রবাসকালেই (১৮৩৩) তাঁর মৃত্যু হলে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম সমাজের নেতৃত্বের দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু রামমোহনের ধর্মচিন্তার সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের ধর্মীয়বোধের মৌলিক পার্থক্য ছিল। রামমোহনের চোখে ব্রহ্মোপাসনা কোনও পৃথক ধর্মমত নয়, হিন্দু ধর্ম দর্শনেরই একটি অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়েছিল। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম মতকে পৃথক ধর্ম হিসেবেই দেখতেন। ফলে, তাঁর আমলে ব্রাহ্ম একটি পৃথক ধর্মমতের রূপ পরিগ্রহ করে।

পরবর্তীকালে ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দেন কেশবচন্দ্র সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ। তাঁদের যোগদানের ফলে ব্রাহ্ম ধর্ম আন্দোলন একটি নূতন রূপ পরিগ্রহ করে। প্রচলিত হিন্দু ধর্মের একটি বিকল্প ধারা হিসেবে ব্রাহ্ম ধর্ম নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। তাদের হাত ধরেই ব্রাহ্ম ধর্ম নতুন আঙ্গিক লাভ করে ও সমাজের অন্য স্তরগুলিতে বিস্তার পায়।

ইতিহাসবিদেরা জানান, ১৮৪৯ সালে সারা দেশে ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য ছিলেন পাঁচশো জন। ১৮৬৪ সালে সেই সদস্য সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় দু’হাজারে। পরবর্তীকালে বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত ব্রাহ্ম সমাজের শাখা স্থাপিত হতে থাকে। জানা যাচ্ছে যে, ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় ৫০টি, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে দু’টি এবং পঞ্জাবে একটি ও মাদ্রাজে একটি করে শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলায় ব্রাহ্ম সমাজের ৫০টি শাখার মধ্যে একটি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অম্বিকা-কালনাতেও।

অম্বিকা-কালনায় ব্রাহ্ম সমাজের শাখাটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রত্যক্ষ নির্দেশে এই শাখাটি প্রতিষ্ঠিত হয় বলে জানা যায়। কালনার মথুরামোহন গঙ্গোপাধ্যায় এবং শ্রী রাধিকামোহন পাল প্রথম ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তাঁরা ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পরে, কালনায় বিদ্বান সমাজে ব্রাহ্ম ধর্ম সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হয়। সেই কারণেই কালনায় ব্রাহ্ম সমাজ গড়ে ওঠার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয় বলে ইতিহাসবিদদের অনুমান। তাঁদের একাংশ মনে করেন, কালনার রাজ মন্দিরের কাছাকাছি কোনও এক স্থানে এই ব্রাহ্মসমাজ গড়ে ওঠে।

গোড়ার দিকে ব্রাহ্মসমাজের প্রতি বর্ধমানের মহারাজা মহতাব চাঁদের আন্তরিক আনুকূল্য ছিল। প্রথম দিকে মাত্র দু’জন ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করলেও, পরবর্তীকালে বেশ কয়েকজন কালনার অধিবাসী ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু ইতিহাসবিদদের অন্য একটি অংশের অভিমত, কালনায় ব্রাহ্ম ধর্ম কোনও দিন তেমন বিস্তারলাভ করতে পারেনি। তা সমাজের একটি নির্দিষ্ট বৃত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তাঁদের যুক্তি, কালনায় সেই মধ্যযুগ থেকে সনাতন হিন্দু ধর্মের স্রোতটি প্রবল ছিল। কালনায় ছিল বহু সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের বসবাস। কালনার সংস্কৃজ্ঞ পণ্ডিতের অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু ধর্ম তথা শাস্ত্রের বিশারদ। রামমোহনের একেশ্বরবাদী চিন্তা সেই কারণেই কালনাকে তেমন ভাবে স্পর্শ করতে পারেনি। পরবর্তীকালে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের উদ্যোগে ভক্তিবাদী আন্দোলন শুরু হলে, ব্রাহ্ম ধর্ম দ্রুত তার আবেদন হারাতে থাকে।

১৮৬৮ সালে শান্তিপুরে ঠাকুর বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর বাড়িতে এসে কেশবচন্দ্র সেন ‘ভক্তি’ বিষয়ে বক্তৃতা দিলেও, সেই বক্তৃতা কালনার মতো নদীয়া সন্নিহিত এলাকাগুলিকে তেমন ভাবে স্পর্শ করেনি। এই বক্তৃতাসভায় কালনার কোনও প্রতিনিধির উপস্থিতির কথাও জানা যায় না। এ থেকে ইতিহাসবিদদের একাংশ মনে করেন, শুরুর কয়েক বছরের মধ্যে কালনায় ব্রাহ্ম সমাজ প্রত্যাশিত উড়াল দিতে পারেনি। তবে স্বাধীনতার কয়েক বছর পরেও কালনার হাতে গোনা কয়েকটি পরিবারের মধ্যে ব্রাহ্ম ধর্ম টিকে ছিল। ১৯৬৩ সালে কালনায় ব্রাহ্ম সম্মেলন আয়োজিত হয়। যত দূর জানা যায়, কালনার জ্ঞানেন্দ্রনাথ পালের পরিবারকেই এলাকার ‘শেষ ব্রাহ্ম পরিবার’ বলে মনে করা হয়ে থাকে। এই পরিবারের কর্তা জ্ঞানেন্দ্রনাথ বাবুর উদ্যোগে কালনায় এই ব্রাহ্ম সম্মেলন আয়োজিত হয়েছিল। পরবর্তী কালে এই পরিবারের তেমন কোনও লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায় না। বাকি যে পরিবারগুলি ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের সম্বন্ধেও বিস্তারিত তথ্য আজ আমাদের হাতে নেই। ফলে, একদা যে ধর্ম মত কলকাতা থেকে কালনায় ছড়িয়ে পড়েছিল, তা এক দিন হারিয়ে গিয়েছে ধীরে ধীরে।

লেখক কালনার সংস্কৃতিকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE