Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
উত্তর সম্পাদকীয়

পাশাপাশি থেকেও সকলে যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ

সবার হাতে এখন স্মার্টফোন। ইন্টারনেটও সহজলভ্য। সময়ে, অসময়ে, প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে ভার্চুয়াল জগতে ঢুঁ মারা এখন আমাদের সকলের নিত্যকর্ম হয়ে উঠেছে। লিখছেন সাইদুর রহমানসবার হাতে এখন স্মার্টফোন। ইন্টারনেটও সহজলভ্য। সময়ে, অসময়ে, প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে ভার্চুয়াল জগতে ঢুঁ মারা এখন আমাদের সকলের নিত্যকর্ম হয়ে উঠেছে। লিখছেন সাইদুর রহমান

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৯ ০৩:৪৭
Share: Save:

তামাম বিশ্ব আজ ইন্টারনেট-জ্বরে ভুগছে। ভুগছে গোটা সমাজ, পরিবার, পরিবারের সদস্যেরা। শুধু তরুণরাই নয়, নানা বয়সের মানুষের কাছে এই ভার্চুয়াল জগৎ দিন দিন হয়ে উঠছে মাদকাসক্তির মতো। সবার হাতে এখন স্মার্টফোন। ইন্টারনেটও সহজলভ্য। তাই সময়ে, অসময়ে, প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে মনের অজান্তেই ভার্চুয়াল জগতে ঢুঁ মারা এখন আমাদের সকলের নিত্যকর্ম হয়ে উঠেছে। ফলে বাস্তব দুনিয়া থেকে আমরা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি। এখন আর ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা তেমন চোখে পড়ে না। চোখে পড়ে না ক্যান্টিনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্ক-বিতর্ক। চায়ের কাপে ঝড় তোলা আড্ডাও কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে।

অথচ একটা সময় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে দেখা যেত দল বেঁধে গল্প, তর্ক-বিতর্ক আর প্রণোচ্ছল আড্ডা। বন্ধু বান্ধবের দল একত্রিত হলেও তাদের আড্ডা ঘিরে প্রাধান্য পায় সোশ্যাল সাইট, অনলাইন গেম নিয়ে আলোচনা। পাশাপাশি আড্ডায় বসেও তারা যে যার স্মার্টফোনে পরস্পর বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো বাস করে। কিশোর তরুণদের আজ আর আগের মতো খেলার মাঠেও তেমন দেখা যায় না। সেই জায়গা দখল করেছে অনলাইন গেম। সোশ্যাল সাইটে অনেকে মানবতা, দেশ, সমাজ নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লিখে বিশ্বজয় করে ফেলছেন। অথচ তাদের অনেকেই নিজের পরিবারের সদস্যের খোঁজ নিতেও ভুলে যাচ্ছেন। স্মার্টফোনের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যে আবেগ ছড়িয়ে আসলে বাস্তবজগতে মানুষ আবেগশূন্য হয়ে পড়ছেন। ইন্টারনেট আসক্তি, সোশ্যাল সাইটগুলোতে অতিরিক্ত চ্যাট আমাদের বাস্তব জীবনের আবেগকে কেড়ে নিচ্ছে। আজকের প্রযুক্তি-নির্ভর দুনিয়া ভাগ হয়ে গিয়েছে বাস্তবে আর ভার্চুয়ালে। যে বাস্তব জগতে আমরা বাস করি, সেখানে যত মানুষের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে, তার থেকে বহু বেশি মানুষকে আমরা চিনি ও যোগাযোগ রাখি অধরা-অদেখা-কাল্পনিক ভার্চুয়াল জগতে। অথচ এমন একটি জগতের আনন্দ আর বেদনা; বিপদ আর সম্ভাবনা বর্তমান সময়ের মানুষের জীবনের অন্যতম বাস্তবতা। একে মেনে নিয়েই এবং সামলে নিয়েই আমাদের অতিক্রম করতে হচ্ছে ডিজিটাল পৃথিবীর সাইবার পথ।

ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কোনও স্টেটাস বা পোস্টে এবং মানুষের সামনাসামনি তর্কের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে প্রচুর। দুই জায়গায় মানুষ দু’ভাবে প্রতিক্রিয়া দেন। ভিন্ন মত পোষণকারীর বক্তব্য সামনাসামনি এক রকম আবার লেখার মাধ্যমে উপস্থাপন হতে পারে অন্য রকম। তা ছাড়া, ভার্চুয়াল জগতে আমাদের গোপন বলতে কিছু থাকে না। আমাদের নিজেদের অজান্তেই আমাদের পছন্দ, অপছন্দ, নীতি, বিশ্বাস, আদর্শ, বিতর্কিত চিন্তা ভাবনা, অভ্যাস, অর্থাৎ ব্যক্তিগত বিষয় অনেক সময় ব্যক্তিগত থাকে না। যে কোনও সময় ব্যক্তিগত কোনও তথ্যই চলে যেতে পারে অন্যের কাছে। আবার, ভার্চুয়াল জগতের সব তথ্যকে সত্য ধরে নিয়ে অনেক সময় বড় ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আমেরিকার গত সাধারণ নির্বাচনে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের প্রবণতা কী ভাবে নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছিল তা মোটামুটি সকলের জানা।

কিন্তু এত কিছু জানার পরেও মানুষ প্রতিদিন বেশি বেশি করে ভার্চুয়াল তথা নেট দুনিয়ার ওপর নির্ভরশীল ও আসক্ত হয়ে পড়ছেন কেন? অকল্পনীয় হলেও মানুষ এখানে খুব সামান্য চেষ্টায় নিজের কল্পনার মতো একটা জীবন সাজিয়ে নিতে পারেন। যে জীবনের অস্তিত্ব থাকে শুধু ছবিতে, স্টেটাসে, মেসেজে। যে জীবন কেবলই একটা ধাঁধা, একটা ইল্যুশন। কল্পনাবিলাসী, অলস বা অক্ষম মানুষের জন্য এটা সবথেকে সহজ উপায়। আবার যারা বাস্তব জীবনে কিছুটা অন্তর্মুখী, তাদের অনেকেরই একটা সুপ্ত আকাঙ্খা থাকে নিজের কথা অন্যকে বলার। অনলাইন জগত অনেকটাই সেই সুযোগটা এনে দিয়েছে। এর মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের অসংখ্য মানুষ বিনোদনের সুযোগ পান। বিন্দুমাত্র পরিশ্রম না করেও কেউ চাইলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিভিন্ন ধরনের বিনোদন পেতে পারেন ঘরে বসেই। আমি একা বিচ্ছিন্ন কিছু নই, সবার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত, দলভুক্ত বা গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে আছি— এই অনুভূতি অর্জন করতে পারেন অনেকেই। যদিও এই ভাবনাটি পুরোপুরি একটা কল্পনাবিলাস আর গোলোকধাঁধা।

ভার্চুয়াল জগতের সবথেকে নেতিবাচক দিক হল সমাজের মনুষ্যত্বহীনতা। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি বর্তমানে যে ভাবে বিস্তার লাভ করছে, তাতে মানুষের পারস্পরিক ক্রিয়া উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে। কারণ, মানুষ তখন ভার্চুয়াল জগতে বাস্তব জীবনের চেয়েও অনেক ভাল বন্ধু এবং মনের মতো পরিবেশ পাবে। আর মানুষ যদি এ ভাবে রঙিন চশমা আর কালো গ্লাভসকে মানুষ ও সমাজের বিকল্প হিসেবে বেছে নেন তা হলে মানবসমাজ বিলুপ্ত হতে বেশি সময় লাগবে না। ভার্চুয়াল দুনিয়া অতিমাত্রায় কল্পনানির্ভর।

আর এর মাধ্যমেই মানুষ তার কল্পনার রাজ্যে ইচ্ছেমতো বিচরণ করতে পারে। ফলে, দেখা যাবে যে, মানুষ বেশির ভাগ সময় বাস্তব জগতের পরিবর্তে সময় কাটাবেন কল্পনার জগতে। আর মানুষ যদি কল্পনা ও বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে না পারেন তাহলে মানবতা পুরোপুরি ভার্চুয়াল জগতে আবদ্ধ হয়ে পড়বে। তাই, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশের আগে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার জগৎ আর প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে কিছু জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি। ভার্চুয়াল জগৎ সম্পর্কে সচেতনতার অভাব , দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা, মানুষের অধিকার সম্পর্কে অসেচতনতা নিত্য বিপদ ডেকে আনছে। মানুষের গোপনীয়তার অধিকার একটি জন্মকালীন সহজাত, সর্বজনীন, মৌলিক মানবাধিকার। এই অধিকার মানুষের জীবন ধারনের অধিকারের সাথে সম্পৃক্ত। এক জন ব্যক্তি অনুমতি ছাড়া অন্যের ছবি, ভিডিয়ো বা অন্য কোনও তথ্য ব্যবহার করতে পারেন না— এ সম্পর্কে ধারণা ও সচেতনতা থাকা দরকার।

সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস জানিয়েছেন, বয়স ১৪ হওয়ার আগে তিনি তাঁর সন্তানদের মোবাইল ফোন কিনে দেননি। আর অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জোবস নিজের উদ্ভাবিত আইপ্যাডই কখনও ব্যবহার করতে দেননি তাঁর সন্তানদের। অথচ তাঁদের উদ্ভাবিত স্মার্টফোন, আইপ্যাড ও কম্পিউটার গেমস পৌঁছে গিয়েছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের ঘরে ঘরে, লক্ষ লক্ষ শিশুর হাতে। ফলে, শিশুর শৈশব বলে কিছু নেই, নেট দুনিয়ায় শিশুও আর শিশু নেই। নেট দুনিয়া তাদেরকেও এক একটি পাকা ডিজিটাল পরিণত মানুষে পরিণত করছে। শিশুকে বোঝাতে হবে, ‘ভার্চুয়াল জগৎ’ একটা ইল্যুশন মাত্র। অতএব, ‘ভার্চুয়াল জগতে’র ইল্যুশন আর আগ্রাসন থেকে নিজেকে, পরিবারকে ও সমাজকে বাঁচাতে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের উপর জোর দেওয়া বিশেষ জরুরি বলেই মনে হয়।

‘উত্তর সম্পাদকীয়’ বিভাগে
লেখা পাঠান এই ইমেল-এ
edit.msd@abp.in
ইউনিকোড হরফে লেখা পাঠালেই ভাল হয়। অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

(শেষ)

শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Internet Social Media Virtual World
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE