Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
প্রাইভেট টিউশন বন্ধ করতে হলে ইস্কুলগুলির দিকে নজর জরুরি

শিক্ষকরাই সব সমস্যার মূল?

ব্যক্তিগত ভাবে প্রাইভেট টিউশনের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও দেখতে পাই চার দিকে। মনে হয়, এই পদক্ষেপের দ্বারা সরকার যেন বোঝাতে চাইছে, শিক্ষার বেহাল অবস্থার জন্য দায়ী শিক্ষকরাই।

কিংকর অধিকারী
শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৮ ০০:৪৫
Share: Save:

স্কুল স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রাইভেট টিউশন বন্ধের জন্য সরকারি তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদিও ব্যাপারটা নতুন নয়। পূর্বতন সরকারের আমলেও ২০০৫ সালে কলকাতা গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে একই প্রচেষ্টা হয়েছিল। এ কথা সত্যি, সরকারি সহযোগিতায় বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা রয়েছে। তার জন্য বেতনও পান শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ। এর পরও অভিভাবক বা ছাত্র-ছাত্রীরা আবার আলাদা ভাবে প্রাইভেট টিউশনের প্রয়োজন অনুভব করবেন কেন? তা হলে কি বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ শিক্ষার্থীদের যথাযথ শিক্ষাদান করছেন না? তাঁরা কি কেবল প্রাইভেট টিউশন পড়াতে ব্যস্ত? বাস্তবের মাটিতে গিয়ে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে।

ব্যক্তিগত ভাবে প্রাইভেট টিউশনের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও দেখতে পাই চার দিকে। মনে হয়, এই পদক্ষেপের দ্বারা সরকার যেন বোঝাতে চাইছে, শিক্ষার বেহাল অবস্থার জন্য দায়ী শিক্ষকরাই। তাঁদের প্রাইভেট টিউশন এই দশার অন্যতম কারণ। শিক্ষক বা শিক্ষাবিদরা না চাইলেও শিক্ষার নীতি নির্ধারণে সরকারি পদক্ষেপ যে শিক্ষাব্যবস্থার ভিত নড়িয়ে দিচ্ছে তা আড়াল করতে মাঝে মাঝে শিক্ষক সমাজের বিরুদ্ধেই মানুষকে খেপিয়ে দিয়ে সরকার তার স্বার্থ সিদ্ধি করে।

একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল প্রথা তুলে দিয়ে শিক্ষার যে ভিতটাকে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, আজ তা সরকারি ভাবেই স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই ভুল স্বীকারের আগেই কতগুলি বছর ধরে ছেলেমেয়েরা যে ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল, তার দায় সরকার নেবে কি? না কি তার দায়ও শিক্ষকদের? সামগ্রিক শিক্ষক সমাজের মতামত না নিয়ে কেবল শাসকের স্বেচ্ছায় নেওয়া সিদ্ধান্তকে শিক্ষাব্যবস্থার উপর চাপিয়ে দিয়ে তার কুফলের দায় শিক্ষকদের উপর চাপিয়ে দেওয়াটা কি সঙ্গত?

প্রথমেই বলি, বর্তমানে বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের কাজে বিরাট সংখ্যক মহিলা নিয়োজিত রয়েছেন। সংসারের বিভিন্ন কাজে অধিকাংশ সময় ব্যস্ত থাকায় তাঁদের মধ্যে কেউই প্রায় প্রাইভেট টিউশনে যুক্ত থাকেন না। এসএসসির মাধ্যমে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দূরদূরান্তে নিয়োজিত হওয়ায় শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ প্রাইভেট টিউশনের কথা ভাবতেই পারেন না। আবার সরকারি নিয়মের কারণে এবং স্বেচ্ছায় অনেকেই এমনিতেই টিউশন করেন না। প্রত্যেকটি বিদ্যালয় থেকে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, শিক্ষক-শিক্ষিকার ১০ শতাংশেরও অনেক কম প্রাইভেট টিউশনের সঙ্গে যুক্ত। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী শিক্ষিত বেকারদের কাছে টিউশন নিয়ে থাকে। এ কথা সত্যি, ব্যক্তিগত বা কোচিং সেন্টারে টিউশন এখন প্রায় ছোঁয়াচে রোগের মতো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। প্রশ্ন হল, এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা কেন গড়ে তোলা যাচ্ছে না, যেখানে শিক্ষার্থীদের সমস্ত চাহিদা বিদ্যালয়ে পূরণ হয়ে যাবে? আলাদা করে প্রাইভেট টিউশনের দরকারই পড়বে না? প্রাইভেট টিউশন বন্ধ করে সে কাজ করা নিশ্চয়ই ভাল, কিন্তু তার বদলে কেবল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রাইভেট টিউশন বন্ধ করার কথা ঘোষণা করলে লোক খেপানোটাই বেশি হয়, টিউশন বন্ধের কাজটা হয় না। সঙ্গত কারণেই অনেকের প্রশ্ন, যখন শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের প্রাইভেট টিউশন না করার উপর ফতোয়া জারি করা হচ্ছে, তখন অন্য সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে সরকার নীরব কেন? এক জন সরকারি কর্মী হলে তিনি টিউশন পড়াতে পারবেন আর এক জন শিক্ষাকর্মী তা পারবেন না, এটা কি দ্বিচারিতা নয়?

প্রথমেই বোঝা দরকার, অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের জন্য প্রাইভেট টিউশনের ব্যবস্থা করেন কেন? শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশনের জন্যই কি এর প্রচলন? বরং করুণ এক বাস্তবের জন্যই এর এত রমরমা। কয়েক বছর আগে আমাদের রাজ্যেই চার-পাঁচ হাজার পদে চাকরির জন্য প্রায় ২৭ লক্ষ বেকার যুবকযুবতী ফর্ম ফিল-আপ করেছিল। সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশে পঞ্চম শ্রেণি যোগ্যতাসম্পন্ন ৬২টি পিয়ন পদের জন্য আবেদন করেছিলেন প্রায় ৯৩ হাজার শিক্ষিত বেকার। তার মধ্যে ৫০০০০ স্নাতক, ২৮০০০ স্নাতকোত্তর, ৩৭০০ পিএইচ ডি ডিগ্রিধারী। এ ছাড়া বহু এমবিএ, বি টেক ডিগ্রিধারীও ছিল আবেদনকারীদের মধ্যে। সারা দেশের প্রতিটি রাজ্যেই কমবেশি একই চিত্র। যে দেশে বা রাজ্যের শিক্ষিত বেকারদের অবস্থা এই রকম, সেখানে অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন থাকেন, তা কি বলার অপেক্ষা রাখে? তাঁরা এই প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে নিজের সন্তানকে সেরা জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা করেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ফলে বিদ্যালয়ে একশো জনের শ্রেণিকক্ষে যা সম্ভব হয় না, তা ব্যক্তিগত টিউশনের মধ্য দিয়ে পাওয়ার প্রতিযোগিতা চলে।

যত দিন না এই বেকার সমস্যার সমাধান হবে তত দিন অভিভাবকরা তাঁর সন্তানকে যোগ্য এবং অভিজ্ঞ টিউটর দিয়ে বিশেষ পরিচর্যার ব্যবস্থা করবেনই। কোনও মতেই তা দূর করা যাবে বলে মনে হয় না। আর স্বভাবতই বেশির ভাগ অভিভাবক অভিজ্ঞ শিক্ষকদের দিয়েই তাঁর সন্তানকে টিউশন দিতে চান। কিন্তু শিক্ষকদের বদলে শিক্ষিত বেকাররাই এ দায়িত্ব পালন করেন।

মূল প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। সরকার যদি সত্যিই শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাইভেট টিউশন নির্মূল করতে চায় তা হলে বিদ্যালয়গুলিকে গতানুগতিক পাঠদান প্রক্রিয়ার পরিবর্তে প্রকৃত ডিজিটাল ক্লাসরুম তৈরি করছে না কেন? সিলেবাসকে বৈজ্ঞানিক ও আকর্ষক করছে না কেন? বিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিকাঠামো এমন হবে যে বিদ্যালয়ই ছাত্র-ছাত্রীদের আকর্ষণ করবে। স্কুল-পালানোর কথা তারা ভাবতেই পারবে না।

শিক্ষার অধিকার আইনে ৩০:১ অনুপাতে শিক্ষক নিয়োগ করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা কি রয়েছে? প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঁচটি ক্লাস থাকলেও অধিকাংশ স্কুলে দু’তিন জন শিক্ষক। তার উপর জনগণনা, ভোটার লিস্টের নাম তোলা ও সংশোধন, মিড ডে মিলের তদারকি-সহ হাজার কাজের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে পড়াশোনার কাজটিকে গৌণ করে দেওয়া হয়েছে। একই ভাবে মাধ্যমিক/উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সারা বছর জুড়ে কন্যাশ্রী, শিক্ষাশ্রী, মাইনরিটি গ্র্যান্ড, ব্যাগ, সাইকেল, মিড ডে মিল-সহ বহু ধরনের কাজ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ এর কিছুর জন্যই আলাদা কোনও কর্মী নেই। সমস্ত কাজই করতে হয় শিক্ষকদের ও শিক্ষাকর্মীদের।

বহু বিদ্যালয় জুনিয়র থেকে মাধ্যমিক, আর মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে পরিবর্তিত হয়েছে। অথচ সেই বিদ্যালয়ে নিয়োগ করা হয়নি পর্যাপ্ত শিক্ষক। উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগের জন্য ল্যাবরেটরির ব্যবস্থা নেই বহু স্কুলে। এমনকি উচ্চ মাধ্যমিকে পর্যাপ্ত শিক্ষক না দেওয়ায় স্নাতক স্তরের শিক্ষকদের দিয়ে কাজ চালাতে বাধ্য হচ্ছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীরা তাদের ঘাটতি মেটানোর জন্য যোগ্য প্রাইভেট টিউটরের কাছে তো যাবেই। প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষক অবসর গ্রহণ করছেন, কিন্তু সে অনুযায়ী নিয়োগ হচ্ছে না। এই আসল কাজগুলি না করে মানুষ খেপিয়ে, শিক্ষিত বেকারদের খেপিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তার ভোট রাজনীতি হচ্ছে না কি?

ব্যক্তিগত ভাবে প্রাইভেট টিউশনের সঙ্গে যুক্ত না হয়েও বলছি, কোনও শিক্ষক বা শিক্ষিকা যদি বিদ্যালয়ের নির্ধারিত সময় যথাযথ ডিউটি পালন করার পর সামাজিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন নিশ্চয়ই তা প্রশংসনীয়। সে তো তাঁর মানসিকতার উপর নির্ভর করে। কিন্তু কেউ যদি তা না করে তাঁর অতিরিক্ত সময় অন্য কোনও রোজগারের পরিবর্তে প্রাইভেট টিউশনে ব্যয় করেন এবং তাঁর অতিরিক্ত আয়ের জন্য সরকারকে যথাযথ

ট্যাক্স দিয়ে থাকেন, তা হলে তাঁকে আইনত বাধা দেওয়া যায় কি? এতে তাঁর বিষয়গত চর্চা যেমন বাড়ে, তেমনই শিক্ষার্থীরাও এর দ্বারা উপকৃত হয়। এ বার কে কোন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে টিউশন করবেন সেটা তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়। এমন কিছু শিক্ষক রয়েছেন, যাঁরা অনেক দুঃস্থ ছাত্র-ছাত্রীদেরও বিনেপয়সায় পড়ান।

কেউ কেউ বলেন যাঁরা প্রাইভেট টিউশন করেন, তাঁরা না কি বিদ্যালয়ে ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করেন না। কেউ এমন করে থাকলে তা নিশ্চয়ই সমর্থনযোগ্য নয়। তবে এ ক্ষেত্রে শুধু প্রাইভেট টিউশন করা শিক্ষক কেন, অন্য কোনও শিক্ষক বা শিক্ষিকাই যদি তাঁর দায়িত্ব ঠিক ভাবে পালন না করেন, তাঁদের জন্য ইতিমধ্যেই নজরদারির ব্যবস্থা রয়েছে আমাদের শিক্ষা পরিকাঠামোয়। স্বচ্ছ ভাবে সেই নজরদারি হয় তো? হলে কিন্তু এই প্রবণতা বাড়তে পারত না।

পরিশেষে বলি, এমন একটা শিক্ষার পরিকাঠামো এবং সার্বিক ব্যবস্থা গড়ে উঠুক যেখানে শিক্ষার্থীরা স্রোতের মতো প্রাইভেট টিউশনের জন্য দৌড়োবে না। সে তার সমস্ত চাহিদা শিক্ষাকেন্দ্রেই পাবে। সরকার এ দিকে মনোযোগী হলেই সকলের মঙ্গল।

শিক্ষক, বালিচক, পশ্চিম মেদিনীপুর

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Private Tuition School Surveillance
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE