প্রচার-শৃঙ্খল। সঙ্ঘের পথসঞ্চলন অনুষ্ঠান, লখনউ, ৫ এপ্রিল। ছবি: পিটিআই।
আরএসএস এবং বিজেপি’র পারস্পরিক সম্পর্কটা ঠিক কেমন? ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের পরে এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তর কথা হয়েছে। নানা রাজনীতিবিশারদের নানা মত। এক দল মনে করেন, নরেন্দ্র মোদী আরএসএসকে তাঁর সরকারের উপর ছড়ি ঘোরাতে দেবেন না। আর এক দলের মতে, মোদীর নেতৃত্বে চালিত বিজেপি আসলে আরএসএস-এর পরিপূরক। আমি নিজে দ্বিতীয় মতটির পক্ষে। আমি মনে করি, সংবাদমাধ্যমে দুই গোষ্ঠীর মতানৈক্য বা সংঘাতের যে সব খবর মাঝে মাঝে পাওয়া যায়, সেগুলি কোনও গভীর বিরোধের ব্যাপার নয়। গত কয়েক মাসে সংবাদমাধ্যমেই দেখা গেছে, বিজেপি সভাপতি অমিত শাহকে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত প্রায় প্রতি মাসেই এক বার করে নাগপুরের সদর দফতরে ডেকে পাঠিয়েছেন। এটাও লক্ষ করার ব্যাপার যে, আরএসএস-এর হিন্দুত্বের প্রচারে, যেমন ঘর বাপসি-র প্রশ্নে বা মাদার টেরিজা সম্পর্কে মোহন ভাগবতের মন্তব্যে নরেন্দ্র মোদী বা তাঁর সরকার সচরাচর কোনও প্রতিক্রিয়া জানান না। মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, মৌন সম্মতির লক্ষণ।
মতামতের কথা থাক। সঙ্ঘ এবং সরকারের সম্পর্ক যাচাই করার জন্য আমরা একটা অন্য পদ্ধতি অনুসরণ করেছি। আমরা দেখতে চেয়েছি, বিজেপি সরকারের কাছে নানান সুযোগসুবিধে আদায় করার উদ্দেশ্যে মানুষ কতটা আরএসএস-এর শরণাপন্ন হচ্ছে। মোদী সরকার ক্ষমতায় এসেছে বছরখানেকের কাছাকাছি হল, এই বার আস্তে আস্তে সরকারি প্রসাদ বিতরণের ব্যবস্থা নীচের দিকে প্রসারিত হচ্ছে। ইলাহাবাদ, বারাণসী এবং দিল্লি, তিনটি জায়গায় আরএসএস কার্যালয়ে উপস্থিত থেকে সমীক্ষকরা যা দেখেছেন, তার ভিত্তিতে আমরা মোদী সরকারের উপর আরএসএস-এর প্রভাব প্রতিপত্তির চেহারা-চরিত্র বোঝার চেষ্টা করেছি।
বারাণসী ও ইলাহাবাদে আরএসএস অফিসে যাঁরা গেছেন, আমরা টানা প্রায় দশ দিন ধরে তাঁদের পর্যবেক্ষণ করেছি এবং তাঁদের সম্পর্কে তথ্যাদি নথিভুক্ত করেছি। দেখা গেছে, তাঁদের বেশির ভাগই উদ্যোগপতি বা ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, ইমারতি ব্যবসায় যুক্ত, কিছু এনজিও কর্মী এবং উপাচার্য পদের প্রার্থী কিছু স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক। অন্য দিকে, বিজেপি’র অফিসে যাঁরা যাতায়াত করেছেন তাঁদের মধ্যে আছেন ভবিষ্যতে রাজনৈতিক নেতা হতে চাওয়া ছাত্র ও যুবক, লোকের কাজ করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নেওয়া দালাল শ্রেণির লোক এবং কিছু দলীয় কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবী। আরএসএস অফিসে দালাল না ধরে নিজে গিয়ে কাজ আদায় করা তুলনায় সহজ, বিজেপি অফিসে ‘প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা’র দাপট বেশি, তাই সাধারণ মানুষ তো বটেই, গণ্যমান্য ব্যক্তিদের পক্ষেও ক্ষমতার উপরমহলে পৌঁছনো সহজ নয়, ফলে দালালের আনাগোনা চোখে পড়ার মতো।
আরএসএস-এর কর্মকর্তাদের পক্ষে সরকারি কাজ করিয়ে নেওয়া তুলনায় সহজ, সে কাজ সাধারণ মানুষের হোক অথবা ঠিকাদার, ব্যবসায়ী ইত্যাদি গোষ্ঠীর হোক। আমাদের সমীক্ষকদের এক জন সঙ্ঘের কার্যালয়ের লোকজনের সঙ্গে ভাল যোগাযোগ তৈরি করেছে। সেই কার্যালয়ে যাতায়াত করা এক উমেদার তাকে বলেন যে, বিজেপি সরকারে সঙ্ঘের লোকদেরই প্রতিপত্তি বেশি। এখানে ঘুষ বা চাটুকারবৃত্তির বিশেষ প্রকোপ নেই। তবে সঙ্ঘের কর্তাব্যক্তিদের আগে নিশ্চিত করতে হবে যে, আপনি হিন্দুত্বের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন কিংবা সঙ্ঘের কাজে যোগ দিতে চান অথবা আপনার আত্মীয়স্বজনের মধ্যে সঙ্ঘের লোক আছেন। ইলাহাবাদে সঙ্ঘের জেলা অফিসে এক সমীক্ষক এক দিন লক্ষ করেন, এক ইমারতি ব্যবসার কারবারি জেলা প্রচারক-এর সঙ্গে হিন্দু সংস্কৃতি নিয়ে দু’তিন ঘণ্টা কথা বলার পরে তাঁর হাতে চুপচাপ একটি কাগজ ধরিয়ে দিলেন। আমাদের প্রতিনিধিরা আরএসএস অফিসে ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককেও দেখেন তিনি উপাচার্য হতে চান, জেলা প্রচারকের আশীর্বাদ নিতে এসেছেন। তিনি নাকি ইতিমধ্যেই এরএসএস-এর এক গুরুত্বপূর্ণ কর্তাব্যক্তির আশীর্বাদধন্য।
কী ভাবে কাজ হয়? আমাদের সমীক্ষকরা দেখেন, বিভিন্ন উমেদারের কাছে আবেদন ও অন্যান্য কাগজপত্র জমা নিয়ে আরএসএস-এর প্রচারক কাজে নেমে পড়লেন। কয়েক জনের জন্য তিনি সরাসরি স্থানীয় বিজেপি নেতাকে ফোন করলেন, অন্যদের বললেন যে তাঁদের আবেদন দলের নেতাদের কাছে পেশ করবেন। আবার কাউকে কাউকে বিজেপি’র সর্বভারতীয় সদর দফতরে অমুক নেতার কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। ইলাহাবাদে আরএসএস-এর জেলা অফিসে দিন দশেকের পর্যবেক্ষণে আমরা দেখেছি, বিভিন্ন সরকারি দফতরে কাজ করিয়ে দেওয়ার সুপারিশ নিয়ে যাঁরা এসেছেন তাঁদের মধ্যে ৮৭ শতাংশ ঠিকাদার, ১০ জন বিল্ডার, ৮ জন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ১২ জন এনজিও কর্মী এবং শ’খানেক সরকারি অফিসার। আরএসএস বলে থাকে যে তারা সরকারের ব্যাপারে নাক গলায় না, কিন্তু এখন অন্তত দেখা যাচ্ছে নানা লোকের নানা কাজ করিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারি কর্তাদের কাছে সুপারিশ করতে তাদের সংগঠনের কোনও আপত্তি নেই।
একটা ব্যাপার এর থেকে বোঝা যাচ্ছে। ২০১৪ নির্বাচনে বিজেপিকে জয় এনে দেওয়ার জন্য আরএসএস কর্মীরা তৃণমূল স্তরে প্রচুর খেটেছেন। বুথের উপর নজরদারি থেকে শুরু করে ভোটদাতাদের বুথে নিয়ে যাওয়া, সব কাজ তাঁরা সামলেছেন। ফলে এখন মানুষ স্বভাবতই ভাবছেন যে, বিজেপি সরকারের কাছ থেকে তাঁদের কিছু পাওয়ার থাকলে বা সরকারি কাজে কোনও সমস্যায় পড়লে তাঁরা আরএসএস কর্মীদের হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানাতেই পারেন। দ্বিতীয়ত, সরকারি মহলে মধ্যস্থ বা দালালদের প্রতিপত্তি ক্রমশ বাড়ছে, তাদের উপর নির্ভর না করে সরকারের কাছে পৌঁছতে মানুষ আরএসএস-এর কাছে যাচ্ছেন। তৃতীয়ত, বিজেপি সরকারের কাছে কাজ আদায় করতে আরএসএস-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটা এখন মানুষের কাছে স্পষ্ট। সম্প্রতি যখন একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হলেন, তখন এই নিয়োগের পিছনে আরএসএস-এর এক বড় নেতার কতটা প্রভাব আছে সে বিষয়ে বিস্তর কথাবার্তা শোনা গেল। এর আগের বিজেপি জমানায় শিক্ষাজগতে কেউ কোনও বড় পদ পেলে মুরলীমনোহর জোশী, রাজনাথ সিংহ, কলরাজ মিশ্রের মতো বড় বড় দলনেতাদের প্রভাবের কথা শোনা যেত, এখন সচরাচর সঙ্ঘের কর্তাব্যক্তিদের ছায়াই বেশি পড়ে। অন্তত সমাজে এখন এই ধারণাই জোরদার যে, সরকারি সিদ্ধান্তের পিছনে আরএসএস-এর খুব দাপট কাজ আদায় করতে বা ক্ষমতার প্রসাদ পেতে সঙ্ঘের সাহায্যই কার্যকর।
দুটো প্রশ্ন ওঠে। এক, সহমর্মী বা অনুগামীদের সংখ্যাবৃদ্ধি ছাড়া আরএসএস-এর কী লাভ হচ্ছে? দুই, আরএসএস-এর কল্যাণে কাজটা হয়ে যাওয়ার পরে মানুষ কী ভাবে তার প্রতিদান দিচ্ছেন? দুটো প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজা বাকি।
ইলাহাবাদে জি বি পন্থ সোশ্যাল সায়েন্স ইউনিভার্সিটির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy