Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
অাজ ভগিনী নিবেদিতার ১৫২তম জন্মদিন

‘আপন’ বলে চিনেছিলেন

ভারতবর্ষীয় বাস্তবের কঠোর ছবি তুলে ধরেও অবশ্য মিস নোব্‌লকে ইংল্যান্ডে আটকে রাখা গেল না। তিনি এ দেশে এলেন। দৈনন্দিন জীবনযাত্রার নানা অসুবিধেও টের পেলেন।

বিশ্বজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৮ ০০:২৬
Share: Save:

তেইশ জুলাই, ১৮৯৭। আলমোড়া থেকে মিস নোব্‌লকে লিখছেন বিবেকানন্দ, ‘‘কাজ শুরু হয়ে গেছে এবং বর্তমানে দুর্ভিক্ষনিবারণই আমাদের কাছে প্রধান কর্তব্য। কয়েকটি কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং কাজ চলছে, দুর্ভিক্ষ-সেবা, প্রচার এবং সামান্য শিক্ষাদান।... তুমি এখানে না এসে ইংল্যান্ডে থেকেই আমাদের জন্য বেশি কাজ করতে পারবে।’’ ২৯ জুলাইয়ের চিঠিতে আরও খোলাখুলি লিখলেন স্বামীজি, ‘‘এ দেশের দুঃখ, কুসংস্কার, দাসত্ব প্রভৃতি কী ধরনের, তা তুমি ধারণা করতে পারো না। এ দেশে এলে অর্ধ-উলঙ্গ অসংখ্য নর-নারীতে পরিবেষ্টিত দেখতে পাবে। তাদের জাতি ও স্পর্শ সম্বন্ধে বিকট ধারণা... তা ছাড়া জলবায়ু অত্যন্ত গ্রীষ্মপ্রধান।... শহরের বাইরে কোথাও ইউরোপীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কিছুমাত্র পাবার উপায় নেই।’’

ভারতবর্ষীয় বাস্তবের কঠোর ছবি তুলে ধরেও অবশ্য মিস নোব্‌লকে ইংল্যান্ডে আটকে রাখা গেল না। তিনি এ দেশে এলেন। দৈনন্দিন জীবনযাত্রার নানা অসুবিধেও টের পেলেন। ৩১ জানুয়ারি ১৮৯৮। এরিক হ্যামন্ডকে তাঁর ভারতবাসের অভিজ্ঞতার কথা লিখছেন মিস মার্গারেট নোব্‌ল। সে চিঠিতে মিশেছে চকিত কৌতুক। পার্ক স্ট্রিটের যে বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে সে বাড়ির স্নানঘরটিই আয়ারল্যান্ডের মেমসাহেবের কৌতুকের কারণ। স্নানঘরে জলের একটি কল আছে। সেখানে দাঁড়িয়ে টিনের মগে করে মাথায় জল ঢালতে হয়। এমন ধারা স্নানের অভিজ্ঞতা একেবারেই নতুন। কিছু দিন যেতে না যেতেই অবশ্য এই দেশের সব কিছুই বড় আপন বলে মনে হল। পাশ্চাত্যের জীবনযাত্রার ফেলে আসা অভ্যেস ভুলে এই দেশটিকেই কর্মসূত্রে নিজের করে নিলেন। মিস নোব্‌ল হয়ে উঠলেন ভগিনী নিবেদিতা। কিন্তু কী ভাবে? কোন মন্ত্রে?

বিবেকানন্দ যে কথাগুলি লিখেছিলেন তা সর্বৈব সত্য। এক জন শিক্ষিত ইউরোপীয়ের কাছে এ দেশের দুর্দশা বিরক্তিকর, কষ্টদায়ক। নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার পক্ষে বাইরের এই প্রতিকূলতাই যথেষ্ট। তবু নিবেদিতা এই প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে পেরেছিলেন তাঁর অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে। অন্তর্দৃষ্টি বলতে কিন্তু অলৌকিক কিছু নয়। অন্তর্দৃষ্টি হল দেখার সেই চোখ যা অন্যের অবস্থানকে বুঝতে চায়, তাকে ‘অপর’ হিসেবে দূরে ঠেলে রাখতে চায় না। এই দৃষ্টি নিবেদিতা অর্জন করেছিলেন তাঁর ইতিহাসবোধ থেকেই। কোনও নতুন জনগোষ্ঠীর সঙ্গে অপরিচয়ের দূরত্ব মোচন করা যায় কী ভাবে? নিবেদিতা লিখছেন, ‘‘দ্য ফাউন্ডেশন-স্টোন অব আওয়ার নলেজ অব আ পিপল মাস্ট বি অ্যান আন্ডারস্ট্যান্ডিং অব দেয়ার রিজিয়ন।’’ ভারতবর্ষের মানুষদের বুঝতে গেলে সে দেশের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য খেয়াল করতে হবে। এও বললেন যে, জানতে হবে সেখানকার মানুষদের শ্রমের প্রকৃতিটি ঠিক কী রকম।

নিবেদিতা তখনও এ দেশে আসেননি। বঙ্কিমচন্দ্র সাহেবি দৃষ্টি সম্বন্ধে ঠাট্টা করে লিখেছিলেন ‘‘বিলাতী বিদ্যার একটা লক্ষণ এই যে, তাঁহারা স্বদেশে যাহা দেখেন, মনে করেন বিদেশে ঠিক তাই আছে। তাঁহারা Moor ভিন্ন অগৌরবর্ণ কোন জাতি জানিতেন না, এ জন্য এ দেশে আসিয়া হিন্দুদিগকে Moor বলিতে লাগিলেন।’’ নিবেদিতা তো সাধারণ মেমসাহেব ছিলেন না, ভারতবর্ষকে চেনা ও চেনানোর সাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন। নিজের দেশে যা আছে অপর দেশেও তাই থাকবে এবং তা না-থাকলে মন্দ বলতে হবে এই সঙ্কীর্ণ আধিপত্যকামী দৃষ্টির অধিকারী কেবল পাশ্চাত্যের মানুষেরাই ছিলেন না, ভারতীয়রাও ছিলেন। ভারতীয়রা সাহেবদের মতো ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না বলে তাঁদের সঙ্কীর্ণতায় আধিপত্যবাদ ছিল না, তবে সাহেবমাত্রেই খারাপ এই বিশ্বাস দৃঢ়মূল ছিল। সাহেব-মেমসাহেবদের যে বাঙালি-বাড়ির ত্রিসীমানায় যেতে দিতে নেই সে সংস্কার ছিল ষোলো আনা। নিবেদিতাকে সংস্কারমুক্ত মা সারদা তাঁর বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলেন। নিবেদিতা টের পেয়েছিলেন সারদা মায়ের পরিজনেরা এই উদার বাঙালিনীকে একঘরে করতে তৎপর। তিনি নিজেই অন্য বাড়িতে উঠে গেলেন।

বিবেকানন্দ যে ধর্ম-আন্দোলনের প্রবক্তা, সেই ধর্ম আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য এই দুই ধারার মিলন। বিবেকানন্দ ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ নামের যে ধারাবাহিক নিবন্ধটি ‘উদ্বোধন’ পত্রে লিখেছিলেন, তাতে এই দুই সংস্কৃতির মিলনের কথা ছিল। দুই পক্ষেরই অন্তর্দৃষ্টি প্রয়োজন— প্রাচ্যকেও চিনতে হবে পাশ্চাত্য সভ্যতার রীতি-নীতি, পাশ্চাত্যকেও বুঝতে হবে প্রাচ্যের গুরুত্ব। বিবেকানন্দের অনুগামী নিবেদিতার জীবন এই ব্রতেই স্থিতি লাভ করেছিল। ভারতবর্ষকে চেনাই ছিল তাঁর সাধনা, শুধু যে নিজে চিনছেন তা-ই নয়, তিনি ভারতবাসীদেরও তাঁদের দেশ ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে সচেতন করে দিচ্ছেন। পরাধীন ভারতীয়দের আত্মবিশ্বাস নেই। নিবেদিতা তাঁদের হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিতে তৎপর। অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল এঁদের সঙ্গে নিবেদিতার সখ্য গভীর। নিবেদিতার উৎসাহেই ভারতশিল্পের পুনরুজ্জীবন ঘটল। ভারতীয় পুরাকথাকে, গুহাচিত্রের ঐশ্বর্যকে নিবেদিতার সাহচর্যে ভারতীয়রা পুনরাবিষ্কার করলেন। দীনেশচন্দ্র সেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করছিলেন ইংরেজিতে। নিবেদিতা তাঁর ইংরেজি পরিমার্জনা করে দেন। বাংলা সাহিত্যের প্রাগাধুনিক উপাদান নিয়ে দীনেশচন্দ্রকে নানা প্রশ্ন করেন। এই প্রশ্নে দীনেশচন্দ্রের কাছে তাঁর নিজের দেশের সংস্কৃতি নতুন অর্থে উন্মোচিত হয়। নিবেদিতা লেখেন 'Cradle Tales of Hinduism'। সে বইতে আছে সতীর কাহিনি। সতীর কাছে পিতা দক্ষ শিবের নিন্দা করছেন। ‘‘থিফ, রাসকাল, ইভল, ডিজনেস্ট, ডটার-স্টিলার দ্যাট হি ইজ়!’’ দক্ষের তো অন্তর্দৃষ্টি নেই, তাই এ ভাবেই দেখেন তিনি শিবকে। সতী জানেন এ তো শিবের প্রকৃত রূপ নয়, দেখার চোখ না থাকলে সে রূপ অধরা থেকে যায়। শিবকে দেখার অন্তর্দৃষ্টি ছিল সতীর, যেমন ভারত সম্বন্ধে দেখার গভীর দৃষ্টির অধিকারিণী ছিলেন নিবেদিতা। তাঁর প্রয়াণের পর যে সংবেদী প্রয়াণলেখ রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাতে নিবেদিতাকে উপমিত করেছিলেন সতী হিসেবেই।

তা হলে কি এ দেশের অভাব নেই কিছুর? অন্তর্দৃষ্টিতে ভেতরের রূপ দেখেই মোহিত হয়ে থাকতে হবে? না, তা নয়। বিবেকানন্দ তাঁর পত্রে জানিয়েছিলেন নিবেদিতাকে সেবাকার্যের কথা, শিক্ষাব্রতের কথা, এ দেশের অভাবের কথা। নিবেদিতা এ দেশে এসে সে-দু’টি কাজই গ্রহণ করলেন, শিক্ষা আর সেবা এই দুই তাঁর ব্রত। সে কাজ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হল কারণ অন্তর্দৃষ্টির অধিকারে তিনি এ দেশকে ভালবেসে ছিলেন। তাঁর ইস্কুলে যে পড়ুয়ারা আসে নিবেদিতা তাদের সম্বন্ধে নোট রাখেন। তাদের প্রবণতার ইচ্ছে-অনিচ্ছের খোঁজ নেওয়া চাই। তাঁর এ বাড়ির উঠোনে মাঝে মাঝে আসেন বাঙালি প্রতিবেশীরা। তাঁদের চেয়ারে বসতে দিয়ে মাটিতে বসে থাকেন নিবেদিতা। প্লেগ কলকাতায় মহামারির আকার নেয়। অক্লান্ত সেবায় আত্মনিয়োগ করেন তিনি। সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি সম্বন্ধে দরিদ্র ভারতবাসীর অজ্ঞানতার শেষ নেই যেন। সেবাকার্যে দেশীয় যুবকদের সাহায্য নেন তিনি। বর্জ্যপদার্থ পরিষ্কার করেন যাঁরা, তাঁদের শারীরিক সামর্থ্য ও দেহসৌষ্ঠবে তিনি মুগ্ধ— এঁদের কিনা ভারতীয় সমাজের প্রান্তে ঠাঁই হয়! গোপালের মায়ের সেবা করেন একান্তে। গোপালের মা বালবিধবা, মা সারদার কাছে থাকেন। দু’জনে দু’জনের ভাষা বোঝেন না। তবু অন্তরের যোগ টের পাওয়া যায়। গোপালের মায়ের পায়ের কাছে বসে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দেন। এই বিধবার মধ্যে যেন খুঁজে পান নিজের ঠাকুমাকে। সারদা মায়ের বাড়িতে যান। সেখানে নিঃশব্দ বোঝাপড়ায় মেয়েরা ঠাকুরের পুজোর আয়োজন করছেন। তাঁদের এই সম্মিলিত পুজোর আয়োজনে কৌম সমাজের প্রাণ-স্পন্দন টের পান। এ ভাবেই প্রাত্যহিক ছোট ছোট কাজের মধ্যে এ দেশের সঙ্গে তাঁর আদান-প্রদান চলে। এই আদান-প্রদান চলে বলেই স্বামীজির প্রয়াণের পরেও এই দেশেই থেকে গেলেন তিনি। বিবেকানন্দ তাঁর পত্রে লিখেছিলেন নিবেদিতাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। এ দেশকে নিজের মতো করে চিনেই নিবেদিতা স্বনির্ভর হয়ে উঠেছিলেন। ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সীমার বাইরে যে দেশ, তাকে আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন।

বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Birthday Sister Nivedita
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE