বন্ধ রয়েছে গড়িয়া-টালিগঞ্জ রুটের অটো। —নিজস্ব চিত্র।
ছেলের সামনেই আক্রান্ত হয়েছেন মা, শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন। ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাটা হানা দিয়েছে ভরসন্ধ্যায়, ব্যস্ত শহরের ততোধিক ব্যস্ত রাস্তায়। অভিযোগ অন্তত তেমনই। কিন্তু অভিযোগ করার ফল যে এমন হতে পারে, দুঃস্বপ্নেও সম্ভবত কল্পনা করেনি পরিবারটি। অসহায়প্রায়, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, স্তম্ভিত পরিবার আজ হতভম্ব এক মুখমণ্ডল নিয়ে প্রশ্ন করছে— ‘‘ঝান্ডার তলায় থাকলেই কি সব অপরাধ মাফ হয়ে যাবে?’’
অটোচালকের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের সত্যাসত্য তদন্তে উঠে আসবে। কিন্তু অভিযোগই তুলতে দেওয়া হবে না, অভিযোগ তোলার চেষ্টা হলেই চরম নৈরাজ্য নামিয়ে আনা হবে, হাড় হিম করে দেওয়া শাসানি চলবে, পুলিশের সামনেই বুক চিতিয়ে অভিযোগকারীকে হুমকি দেওয়া হবে, এবং এ সব হবে খাস কলকাতারই বুকে— এমনটা কল্পনা করাও কঠিন। কিন্তু বাস্তবেই ঘটে গেল এ সব।
বাঁশদ্রোণীর যে পরিবার আতঙ্কের সম্মুখীন হয়েছে, স্তম্ভিত শুধু তাঁরা নন, স্তম্ভিত আমরা সকলেই! এই ভাবে অরাজকতা গ্রাস করবে সব কিছু? এই ভাবে নৈরাজ্য কবলিত হয়ে পড়বে আমাদের দৈনন্দিন জীবন!
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
প্রশাসন অনেকদিন আগে থেকেই সমীহ হারাতে শুরু করেছিল। আরও দ্রুত হয়েছে সম্ভবত সেই প্রক্রিয়া। পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোড়া আজকাল সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক নেতার হাত মাথার উপরে থাকলে, পুলিশকে অগ্রাহ্য করা, এমনকী পুলিশকে যত্রতত্র হেনস্থা করা বা চোখ রাঙানোও যায়। যে অটোচালকের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছে তিনি অটোচালকদের একটি খুব বড়সড় ইউনিয়নেরই সদস্য, অতএব রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়াতে থাকাই অভ্যাস এখন তাঁর, অতএব তাঁকে এবং তাঁর সঙ্গীদের সমীহ করে চলা এখন শহরের পুলিশের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ‘কর্তব্য’।
ছবিটা ঠিক এইরকম হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেই কথায় কথায় আক্রান্ত হচ্ছে পুলিশ প্রশাসন। রাজনীতির চাপে মেরুদণ্ডটা বেঁকে গিয়েছে বলেই কোনও কোনও জেলায় শাসক দলের সভাপতি এসপির চেয়েও ‘বেশি গুরুত্বপূর্ণ’ হয়ে উঠছেন, জেলা সভাপতির হুমকির মুখে পুলিশকর্তাদের তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। খোদ কলকাতার বুকে আক্রান্ত হচ্ছে থানা, ফাইলের আড়ালে মাথা বাঁচাচ্ছেন পুলিশকর্মী। এ সব দৃশ্য বার বারই চর্চায় এসেছে, তবে পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হয়নি। নেতাজিনগর থানাতেই তার প্রমাণ মিলল। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে পুলিশ প্রাথমিক পদক্ষেপটুকু করা মাত্রই জোরদার রাজনীতি শুরু হয়ে গেল বিষয়টি নিয়ে।
আরও পড়ুন: থানা থেকে বার হলেই ছিঁড়ে খাব, উড়ে এল শাসানি
কোথাও একটা পূর্ণচ্ছেদ জরুরি। প্রশাসনিক প্রক্রিয়াকে ঘিরে রাজনীতির অনন্ত এবং অশেষ দাপাদাপি শেষ হওয়া জরুরি। আবার বলছি, বাঁশদ্রোণীর পরিবারটিকে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির মুখে পড়তে হল, মৌলিক নাগরিক অধিকার থেকে পরিবারটিকে বঞ্চিত করার চেষ্টা হল। প্রয়োজনে প্রশাসনের দ্বারস্থ হওয়া বা আইনের রক্ষকদের কাছে বিচার চাইতে যাওয়া নাগরিকের একেবারে বুনিয়াদি স্তরের অধিকার। সেই অধিকারটুকু প্রয়োগ করতে গিয়ে একটি পরিবারকে ভয়ঙ্কর বাধার মুখে পড়তে হবে, পুলিশের সামনেই শাসানির সম্মুখীন হতে হবে, তার পরে পুলিশের গাড়িতে চড়ে বাড়ি ফিরতে হবে, এ দৃশ্য একেবারেই কাম্য নয়। এক অটোচালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে বলে যে ভাবে গোটা অটো রুট দিনভর অচল রেখে যাত্রীদের বেকায়দায় ফেলা হল, তা নৈরাজ্য ও অরাজকতারই নামান্তর। অভিযোগকারীদের যে ভাবে হেনস্থা, হুমকি ও শাসানির মুখে ফেলা হল, তা নৈরাজ্যেরই বার্তাবহ।
যে রাজনীতির চাপে এইরকম ন্যুব্জ দশা পুলিশ-প্রশাসনের, যে রাজনীতির মোকাবিলা না করতে পেরে পুলিশের এমন অসহায় দশা, সেই রাজনীতিকেই পদক্ষেপটা করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ-প্রশাসনের ন্যূনতম স্বাধীনতা প্রয়োজন, সেই স্বাধীনতায় রাজনীতি হস্তক্ষেপ করবে না, এমনটা সুনিশ্চিত করতেই হবে। তা যদি সুনিশ্চিত না হয়, তাহলে কোনও অসহায় নাগরিক কোনও অসহায় প্রান্ত থেকে আবার প্রশ্ন তুলবেন ‘‘ঝান্ডার তলায় থাকলেই কি সব অপরাধ মাফ হয়ে যাবে?’’ এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায় কিন্তু রাজ্যের শীর্ষ রাজনীতিক তথা শীর্ষ প্রশাসকেরও রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy