Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

শুশ্রূষার সত্য কাহিনি

ক্ষমা করিবার অসামান্য ক্ষমতা না থাকিলে এমন কথা বলা যায় না। কিন্তু ওলে-মাদারিয়োলার অবস্থান মানুষ সম্পর্কে এক স্বতন্ত্র মানসিকতারও পরিচায়ক।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৯ ০০:৫৮
Share: Save:

সন্তানহারা যে পিতা বলিতে পারেন, তরুণ পুত্রের সমবয়সি খুনির প্রতি তাঁহার মনে ঘৃণা নহে, করুণা আছে, এবং এই মর্মান্তিক ঘটনার অভিঘাতে তিনি ও তাঁহার পরিবার যখন বিপথগামী অল্পবয়সিদের আত্মসংশোধন করিয়া সুস্থ জীবনে ফিরিবার কাজে সাহায্য করিতে উদ্যোগী হন, তখন মানিতেই হয়, বিরল ব্যতিক্রম কথাটি আজও তাহার অর্থ হারায় নাই। লন্ডন শহরে গত নভেম্বর মাসে ছুরিকাঘাতে নিহত হয় সতেরো বছরের ম্যালকম মাইড-মাদারিয়োলা। হত্যাকারীর বয়সও সতেরো। তাহার সহযোগীর বয়স উনিশ। ম্যালকম তাহার এক বন্ধুকে আততায়ীর আক্রমণ হইতে বাঁচাইতে চাহিয়াছিল, ফলে সে নিজে আক্রান্ত ও নিহত হয়। আদালতে অপরাধ প্রমাণিত, জুলাই মাসে দণ্ডাদেশ ঘোষিত হইবে। অন্য নানা শহরের মতোই লন্ডনে এমন হত্যা পরিচিত, বিশেষত সাম্প্রতিক ইতিহাসে। পরিচিত নহে ম্যালকমের পরিবারের, বিশেষত তাহার বাবা ওলুমিডে ওলে-মাদারিয়োলার প্রতিক্রিয়া। তিনি পুত্রঘাতকের ‘চরমতম দণ্ড’ চাহেন নাই, বলেন নাই যে, ‘তাহাকে উচিত শাস্তি না দিতে পারিলে আমার শান্তি হইবে না।’ বরং তিনি বলিয়াছেন, ‘যাহারা এই কাজ করিয়াছে তাহাদের ভবিষ্যৎ ঝরঝরে হইয়া গিয়াছে।’ তাঁহার ইচ্ছা, ওই অপরাধীদের সহিত দেখা করিবেন, কারণ তিনি চাহেন, ওই তরুণরা যখন (সম্ভাব্য) কারাবাস সারিয়া পরিণত বয়সে বাহিরের পৃথিবীতে ফিরিয়া আসিবে তখন যেন বাকি জীবনকে ঠিক ভাবে অতিবাহিত করিয়া ‘সমাজের সুনাগরিক হইয়া উঠিতে পারে।’

ক্ষমা করিবার অসামান্য ক্ষমতা না থাকিলে এমন কথা বলা যায় না। কিন্তু ওলে-মাদারিয়োলার অবস্থান মানুষ সম্পর্কে এক স্বতন্ত্র মানসিকতারও পরিচায়ক। তিনি ব্যক্তি-অপরাধীর সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতটি মনে রাখিতে চাহেন। তিনি জানেন, আপন জীবনে, বিশেষত শৈশবে ভয়াবহ অভিজ্ঞতাই তাহাদের অপরাধী করিয়া তোলে, এবং সেই কারণেই তাহাদের মনকে অন্ধকার হইতে আলোয় আনিবার জন্য যত্নবান হওয়া আবশ্যক। এই উদ্দেশ্যেই তিনি ও তাঁহার স্বজনবান্ধবরা একটি প্রতিষ্ঠান তৈয়ারি করিয়াছেন, সেই প্রতিষ্ঠান বিপথগামী বা বিপন্ন তরুণদের সহযোগিতা ও শুশ্রূষা দিয়া সুপথে ফিরাইতে তৎপর থাকিবে। এই মানসিকতায় নিহিত রহিয়াছে ন্যায়বিচারের এক মহোত্তম ধারণা, যাহার পোশাকি নাম ‘রেস্টোরেটিভ জাস্টিস’ বা পরিচর্যামুখী ন্যায়। সেই ধারণা অপরাধীর শাস্তির প্রয়োজন অস্বীকার করে না, কিন্তু শাস্তিদানের পরে অথবা শাস্তিভোগের পাশাপাশি অপরাধীর আত্মশুদ্ধির সুযোগকেও বিচারের অঙ্গ বলিয়া গণ্য করে। কিছু দেশে এখন এই বিচারধারা অংশত অনুসৃত হইতেছে। আবার অনেক দেশেরই জনজাতি সমাজে ইহার প্রচলন আজও সম্পূর্ণ বন্ধ হয় নাই। এ দেশে কারাগারের নাম সংশোধনাগার হইয়াছে, কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে সামগ্রিক ভাবে বিচারের ধারণাটি অপরাধ ও শাস্তির অতিসরল ছকেই বাঁধা। বস্তুত, গত কয়েক বছরে সমাজের মানসিকতায় ওই ছকটি অনেক বেশি প্রভাবশালী হইয়া উঠিয়াছে— বহু ভারতবাসীর চোখেই অপরাধের শাস্তি অধুনা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করিবার উপায়। ‘মৃত্যুদণ্ড চাই’ দাবি এখন কথায় কথায় গগনভেদী। এই জিঘাংসার বলয়ে দাঁড়াইয়া ব্যতিক্রমী শুশ্রূষার কাহিনি শুনিলে দেশের মঙ্গল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Forgiveness
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE