Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

মত্ত হস্তী

স্বাধীনতা দিবসের পূর্বে উত্তরপ্রদেশ সরকার সব মাদ্রাসাকে হুকুম করিয়াছিল, উদ্‌যাপনের অনুষ্ঠানটির ভিডিয়ো রেকর্ডিং করিয়া তাহা সরকারের নিকট জমা করিতে হইবে।

শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন দ্রুত শিখিয়া লইতেছে। জাতীয়তাবাদের স্বঘোষিত রক্ষকদের নিকট ইউজিসি শিখিয়াছে, কী ভাবে গায়ের জোরে সিদ্ধান্ত চাপাইয়া দিতে হয়। নাগপুরের সৈনিকরা যেমন মাথায় ডান্ডা মারিয়া দেশপ্রেম জাগাইয়া তুলিতে উদ্গ্রীব এবং সেই দেশপ্রেম হইতে কাহারও নিস্তার নাই, তেমনই ইউজিসি-ও ফরমান জারি করিয়াছে, দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বল্লভভাই পটেলের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে একতা দিবস পালন করিতে হইবে। যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশ সরকারের নিকট ইউজিসি শিখিয়াছে, কী ভাবে প্রমাণ আদায় করিতে হয়। স্বাধীনতা দিবসের পূর্বে উত্তরপ্রদেশ সরকার সব মাদ্রাসাকে হুকুম করিয়াছিল, উদ্‌যাপনের অনুষ্ঠানটির ভিডিয়ো রেকর্ডিং করিয়া তাহা সরকারের নিকট জমা করিতে হইবে। ইউজিসি-ও তৎসম নির্দেশ দিয়াছে। ২০১৪ সাল হইতেই ইউজিসি-র তরফ হইতে সর্দার পটেলের জন্মদিন উদ্‌যাপন করিবার অনুরোধ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যায়। এই বৎসর তাহা আদেশে পরিণত হইয়াছে। অর্থাৎ, ‘খাঁচার তোতাপাখি’ হইয়া উঠিবার জন্য যে যোগ্যতাগুলি প্রয়োজন, এই বার ইউজিসি তাহার প্রতিটিতেই সম্মান-সহ পাশ করিয়াছে। দেশের শাসক যে ভাষায় অভ্যস্ত, ইউজিসি ঠিক সেই ভাষাতেই কথা বলিতেছে। কিন্তু, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এই প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্বের যৌক্তিকতা সরকারের মনোরঞ্জন করিবার ক্ষমতার মাপকাঠিতে নির্ধারিত হইতে পারে না। বহু পূর্বেই কমিশনটিকে বিদায় করা বিধেয় ছিল। সেই সিদ্ধান্তের অপরিহার্যতার পক্ষে ইউজিসি আরও একটি অকাট্য যুক্তি খাড়া করিল।

কমিশন যে বুলি আওড়াইতেছে, তাহার উৎস যে বাহাদুর শাহ জাফর মার্গে নহে, বুঝিতে বিশেষ রাজনীতিপ্রাজ্ঞ হইতে হয় না। ফলে, এহেন নির্দেশ জারি করিবার মধ্যে কমিশনের যে অনধিকারচর্চা রহিয়াছে, তাহা তুলনায় গৌণ সমস্যা। যে ভঙ্গিতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে দলীয় রাজনীতির উদ্দেশ্যসাধনে ব্যবহার করা হইতেছে, তাহাই চিন্তার প্রধান কারণ। কমিশন যাঁহার নির্দেশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির নিকট পৌঁছাইয়া দিয়াছে, সেই মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রীর জানা উচিত ছিল, প্রথমত, কোন প্রতিষ্ঠানে কী অনুষ্ঠান আয়োজিত হইবে, তাহা স্থির করিবার নৈতিক অধিকার তাঁহার নাই; দ্বিতীয়ত, ইউজিসি-র কাজ অর্থ বণ্টন, তাঁহার মনোবাঞ্ছার বার্তাবহ হওয়া নহে। কিন্তু, যেহেতু অর্থের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ইউজিসি-র মুখাপেক্ষী, এবং যুগের ধর্ম মানিয়া ইউজিসি সরকারের নিকট নতজানু, ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির ঘাড়ে বল্লভভাই পটেল, অথবা পটেল বলিতে বিজেপি যাহা বোঝে, সেই ধারণাটি চাপাইবার জন্য সরকার ইউজিসি-কেই ব্যবহার করিয়াছে। কোন প্রতিষ্ঠানের এক্তিয়ারের সীমা কতখানি, দলের পতাকা বহন করিলে সেই প্রশ্নটি গুরুত্বহীন হইয়া যায়।

কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে বল্লভভাই পটেলের জন্মদিন পালন করিতে বাধ্য করিলেই কি ছাত্রদের বিশ্বাস করানো যাইবে যে সর্দার পটেল শুধুমাত্র আসমুদ্রহিমাচলব্যাপী নির্বিকল্প হিন্দু রাষ্ট্রই চাহিয়াছিলেন— নাগপুরের নেতারা যেমন চাহেন? না কি, আধুনিক ভারতের স্থপতি হিসাবে নেহরুকে সম্পূর্ণ মুছিয়া ফেলা যাইবে? নাগপুরের কর্তারা নিঃসন্দেহ থাকিতে পারেন, কোনওটিই হইবে না। ছাত্ররা প্রশ্ন করিতে শিখিবেই। এবং, কে বলিতে পারে, অন্যথায় যাহারা নির্বিবাদে ছাত্রজীবন অতিবাহিত করিয়া চলিয়া যাইত, এই সরকারি জবরদস্তিতে বিরক্ত হইয়া হয়তো তেমন কিছু ছেলেমেয়েও অস্বস্তিকর সব প্রশ্ন করিতে আরম্ভ করিবে। সেই প্রশ্নের উত্তর সামলাইবার সামর্থ্য নাগপুরের আছে তো? কেন পটেল আরএসএস-কে নিষিদ্ধ করিয়াছিলেন, তাহার সত্য উত্তর মুখে জোগাইবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

UGC Universities
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE