দেশের জন্য কাজ করিতে ইচ্ছুক, এমন প্রতিভাবান মানুষদের যদি সেই কাজের সুযোগ করিয়া দেওয়া হয়, তাহাতে আপত্তি করিবার কারণ থাকিতে পারে কি? কেন্দ্রীয় সরকার যদি দশটি দফতরের যুগ্ম সচিবের পদ সরকারি এবং বেসরকারি ক্ষেত্রের পেশাদারদের জন্য খুলিয়া দিতে চাহে, আপাতদৃষ্টিতে সেই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানোই বিধেয়। যাঁহারা ইউপিএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত হইয়া আমলাতন্ত্রের ধাপে ধাপে যুগ্মসচিব স্তরে উঠিয়াছেন, নীতিনির্ধারণে তাঁহারা বেসরকারি ক্ষেত্রে কর্মরত পেশাদারদের হইতে অধিকতর দক্ষ বা বিচক্ষণ হইবেন, এমন কোনও নিশ্চয়তা নাই। বরং, আমলাতন্ত্রের বাঁধা গতে যদি বাহিরের খোলা হাওয়া ঢুকিতে পায়, তবে নূতন— এবং, যাহাকে ‘আউট অব দ্য বক্স’ চিন্তা বলে, সেই গোত্রের— ধারণা সরকারি ক্ষেত্রে আসিবার সম্ভাবনা। এবং, এই নিয়োগ যে হেতু বাজারের নিয়ম মানিয়াই হওয়ার কথা, ফলে আগ্রহীদের মধ্যে যোগ্যতম, এবং যোগ্যদের মধ্যে আগ্রহীতম প্রার্থীরাই যুগ্মসচিব হইবেন, এমনটা আশা করা চলে। আইএএস অফিসারদের সীমিত লোকসংখ্যা হইতে দেশের বাজারের বৃহত্তর ব্যাপ্তি, এই উল্লম্ফনে ভারতের লাভ বই ক্ষতি হইবার কথা নহে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কার্যত এইখানে আসিয়াই ঠেকিয়া গিয়াছেন। তিনি স্বীকার করিয়াছেন, আপাতদৃষ্টিতে এই ব্যবস্থায় দূষণীয় কিছু নাই। কিন্তু, অভাব যাহার, তাহার নাম স্বচ্ছতা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যটি এই যুগ্মসচিব বিতর্কের সার কথা বলিয়া দিয়াছে— প্রস্তাবটি ভাল, কিন্তু তাহার মধ্যে বিপদের বহু সম্ভাবনা লুকাইয়া আছে, ফলে বৃহত্তর তর্ক, আলোচনা প্রয়োজন। ইউপিএসসি ব্যবস্থার মাধ্যমে যাঁহারা নির্বাচিত হন, এবং প্রশিক্ষণের পরে প্রশাসনের ধাপে ধাপে অগ্রসর হন, সেই প্রক্রিয়াটির মধ্যে স্বচ্ছতা রহিয়াছে। প্রশিক্ষণ তাঁহাদের রাজনৈতিক ভাবে নিরপেক্ষ থাকিতেও শিখায়। যুগ্মসচিবের পদে কোনও বহিরাগতকে বসানো হইলে এই দুইটি গুণ লইয়াই প্রশ্ন উঠিবে। এই কথার অর্থ ইহা নহে যে বাহির হইতে কাহাকেও আমলাতন্ত্রে লইয়া আসা চলিবে না। বস্তুত, আরও উপরের স্তরে বাহিরের লোককে আনিয়া যে ভাল ফল পাওয়া গিয়াছে, এই কথাটির পক্ষে স্যাম পিত্রোদা, নন্দন নিলেকানিরা অকাট্য প্রমাণ। প্রয়োজন একটি প্রশ্নাতীত ব্যবস্থা গড়িয়া তোলা। এমন একটি প্রক্রিয়া নির্মাণ করা, যাহার মাধ্যমে নির্বাচিত প্রার্থীদের লইয়া কোনও প্রশ্ন উঠিবে না। প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ স্বচ্ছ হইবে। এবং, এই ব্যবস্থাটিতে পৌঁছাইতে গেলে বৃহত্তর আলোচনা প্রয়োজন, তর্ক প্রয়োজন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাহার কথা বলিয়াছেন।
সমস্যাটিকে তীব্রতর করিয়া তুলিয়াছে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের ভাবমূর্তি। যে পদে প্রার্থী মনোনয়ন সরকারের অধিকারের আওতায় পড়ে, এমনকি যেখানে পড়ে না, সেখানেও, গত চার বৎসরে কেন্দ্রীয় সরকার কেবলই ‘নিজের লোক’ বসাইয়াছে। দুর্জনের মতে, তাঁহাদের অনেকেরই প্রধানতম যোগ্যতা সঙ্ঘ পরিবারের প্রতি আনুগত্য। গজেন্দ্র চহ্বাণ হইতে বজুভাই বালা, কেহই স্ব স্ব পদের জন্য যোগ্যতম প্রার্থী ছিলেন, এমন দাবি তাঁহাদের পরম সুহৃদও করিবেন না। ফলে, যুগ্মসচিবের পদেও যে একই মাপকাঠিতে নিয়োগ হইবে না, তেমন বিশ্বাস রাখা মুশকিল। এবং, ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের অধিকর্তার তুলনায় অর্থ, পরিবেশ, অসামরিক পরিবহণ বা কৃষি দফতরের যুগ্মসচিবের ভূমিকা দেশের জন্য অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতীয় অর্থনীতিতে ‘সাঙাততন্ত্র’-এর শিক়ড় অতি গভীরে। যুগ্মসচিবের খিড়কি পথে যে সেই সাঙাততন্ত্র আরও অনেক অন্যায্য সুবিধা জোগাড় করিয়া লইবে না, সেই ভরসা কোথায়? অতএব, ধীরে চলাই বিধেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy