Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ব্রহ্মদৈত্য

ধিক্কারের পরেও একটি প্রশ্ন থাকিয়া যায়। শব্দের মাত্রা ও তাহার সময়সীমা সম্পর্কে আদালত যে নির্দেশ দিয়াছে, তাহা অক্ষরে অক্ষরে পালিত হইবে না কেন? একটিও বেআইনি বাজি কেন ফাটিবে?

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

কথিত আছে, শব্দ ব্রহ্ম। ব্রহ্ম ক্রমে ব্রহ্মদৈত্য হইয়াছে। সম্বৎসর তাহার দাপটে নাগরিকের কান ঝালাপালা, কালীপূজা দীপাবলির মরসুমে সেই দাপট চরমে উঠিয়া থাকে। আইন আছে, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ আছে, সর্বোচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা আছে, কিন্তু এই রাজ্যে আইন আইনের পথে চলে, দুর্বৃত্তেরা তাহাদের পথে। নিয়ম মানিয়া দুষ্টের দমন করিবার দায়িত্ব যাঁহাদের, সেই পুলিশ প্রশাসনের কর্তারা তবে কী করেন? তাঁহারা শব্দ মাপেন। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মাপজোখ করিয়া তাঁহারা রায় দেন: গত বছরের তুলনায় কালীপূজা দেওয়ালিতে শব্দের মাত্রা কমিয়াছে। যে বয়স্ক, অসুস্থ বা নিছক শান্তিপ্রিয় নাগরিকরা উৎকট বাজি এবং উৎকটতর ডিজে ও মাইকের আক্রমণে অতিষ্ঠ, তাঁহারা অতঃপর কর্তাদের এই সিদ্ধান্তটি অঞ্জলি ভরিয়া গ্রহণ করিয়া আপনাপন দেহে ও মনে প্রলেপ দিন। আর এই রায় যে মানে না? সে অবশ্যই মন্দ লোক। ধিক তাহাকে।

ধিক্কারের পরেও একটি প্রশ্ন থাকিয়া যায়। শব্দের মাত্রা ও তাহার সময়সীমা সম্পর্কে আদালত যে নির্দেশ দিয়াছে, তাহা অক্ষরে অক্ষরে পালিত হইবে না কেন? একটিও বেআইনি বাজি কেন ফাটিবে? একটি জায়গাতেও কেন নিয়ম ভাঙিয়া ডিজে বা মাইক ব্যবহার করা হইবে? প্রশ্ন উঠিতে পারে, শব্দের মাত্রা ষোলো আনা নিয়ন্ত্রণ করা কি সম্ভব? প্রথমত, প্রশাসন যদি চাহে, তবে বহুলাংশে সম্ভব। তাহার জন্য সব দুর্বৃত্তকে গ্রেফতার করিবার প্রয়োজন নাই, শুধু কিছু দুরাচারীকে আটক করিয়া শাস্তির বন্দোবস্ত করিলে এবং সেই তথ্য যথেষ্ট প্রচার করিলেই চলিবে। মানুষের মনে যদি এই ধারণাটুকু জন্মায় যে, আইন ভাঙিয়া পুলিশের হাতে পড়িলে কোনও রাজনৈতিক দাদা-দিদিই বাঁচাইবেন না, তাহা হইলেই অতি দ্রুত অনাচার কমিয়া আসিবে। দ্বিতীয়ত, কয় আনা সাফল্য বাস্তবে সম্ভব, তাহা না ভাবিয়া প্রশাসনকে মনে করিতে হইবে, ষোলো আনাই সম্ভব। লড়াইয়ে নামিবার আগেই অর্ধেক হারিয়া বসিলে লড়াই করা যায় না।

শব্দের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন, অর্ধেক নহে, বারো আনাই হারিয়া বসিয়া আছে। স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে শব্দ দমন দূরস্থান, অতিষ্ঠ হইয়া পুলিশে অভিযোগ করিয়াও অনেকেই সুসমাচার শুনিয়াছেন: একটাই তো রাত্রি, সহ্য করিয়া লউন। অথবা— হেথা নহে, অন্যত্র যোগাযোগ করুন। এই নিষ্ক্রিয়তার কারণ একাধিক। এক, যাহারা আইন ভাঙে তাহাদের অনেকেই ক্ষমতাবানদের স্নেহধন্য, তাহাদের ধরপাকড় করিলে উপরতলা চটিতে পারে। এই ভয় পশ্চিমবঙ্গের পুলিশকে কোন অতলে পৌঁছাইয়া দিয়াছে তাহা সর্বজনবিদিত। জনতার মার হইতে বাঁচিতে তাহাকে থানায় টেবিলের নীচে লুকাইতে হয়। এই রাজ্যে পুলিশ যত্রতত্র মার খাইয়া চলিয়াছে, শব্দতাণ্ডব আটকাইতে গিয়াও প্রহার বা লাঞ্ছনার বিবিধ নজির তৈয়ারি হইয়াছে। কিন্তু নিষ্ক্রিয়তার পিছনে সম্ভবত আরও একটি গভীরতর কারণ আছে। পুলিশ প্রশাসনের কর্তারা এবং তাঁহাদের নিয়ামক রাজনীতিকরাই হয়তো মনে করেন, শব্দের উৎপাত লইয়া এত শোরগোল করা বাড়াবাড়ি, ইহা নিতান্ত তুচ্ছ ব্যাপার। তাঁহাদের আচরণে তেমন মনোভাবই সুস্পষ্ট। দীর্ঘ বদভ্যাসে সমাজের চেতনাও বোধ করি নিদ্রিত, নচেৎ আইন আদালতের প্রয়োজন হইত না— যথার্থ সভ্য সমাজে কেহ ভাবিতেও পারেন না যে, উৎসবের নামে উৎকট আওয়াজ করিতে হইবে। অন্যকে পীড়া দিয়া আনন্দ করিবার মানসিকতাটিই বিকৃত, সমাজ-বিরোধী। সামাজিক মন বদলানো অবশ্যই জরুরি। কিন্তু সমাজের সুচেতনা আপনাআপনি জাগ্রত হয় না, দায়িত্ব লইতে হয় প্রশাসন তথা রাজনীতির চালকদেরই। তাঁহারাই যদি সমস্যাটি তুচ্ছ করিতে ব্যস্ত থাকেন, তবে ব্রহ্মদৈত্যের উপদ্রব হইতে বঙ্গবাসীকে কে বাঁচাইবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sound System Sound Pollution Restriction
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE