নদীর ধারে বাস, চিন্তা বারো মাস। বর্ষায় তো কথাই নেই। গত বছরও দক্ষিণবঙ্গে বিপুল ক্ষতি হয়েছে, সরকার চাষিদের ক্ষতিপূরণ দিয়েছে এগারোশো কোটি টাকা। কিন্তু যা অলক্ষ্যে রয়েছে তা হল, এরই মধ্যে কয়েকটি এলাকা বেঁচে গিয়েছে বন্যা থেকে। যেমন ঘাটাল মহকুমার দেওয়ানচক ১ পঞ্চায়েত এলাকা। এখানে নদীর পাড় ভাঙেনি, জলও ঢুকতে পারেনি গ্রামে। কিসে রুখল ভাঙন? সিমেন্ট, বালির বস্তা, শালবল্লা নয়। ঘাস। লম্বা, ঠাসবুনোন শিকড়ের জাল মেলে এই ঘাস ভেঙে পড়তে দেয়নি মাটিকে।
ঘাসের নাম ভেটিভার। তার সঙ্গে বাঙালির দীর্ঘ পরিচয়। হিন্দিতে যা খসখস, বাংলায় খুস, তা-ই হল ভেটিভার (তামিল শব্দ ‘ভেট্টিভার’ থেকে এসেছে ইংরেজিতে।) ছেলেবেলায় দেখেছি, সরকারি দফতরে গ্রীষ্মের উত্তাপ কমাতে লাগানো হত এই ঘাসের তৈরি পরদা। জল ছিটিয়ে দিলে অদ্ভুত সুগন্ধ ছ়ড়িয়ে পড়ত। ভেটিভারের একটি প্রজাতি থেকে সুগন্ধী তেল তৈরি হয়। তৈরি হয় মহামূল্য আয়ুর্বেদিক ওষুধ, ঘাসের দড়ির নানা হস্তশিল্প। কিন্তু যে রাজ্যে গৃহহারা মানুষের দুর্গতি প্রতি বর্ষায়, সেখানে ভূমিক্ষয় প্রতিরোধ ভেটিভারের প্রধান উপযোগিতা হয়ে দেখা দিচ্ছে। খরচও কম। বালির বস্তা ফেলে এক কিলোমিটার নদীর পাড় বাঁধতে যা খরচ, তা ভেটিভার বোনার খরচের থেকে দশগুণ।
এ-রাজ্যে ভাঙন প্রতিরোধে ভেটিভার লাগানো শুরু আরামবাগের খানাকুলে, বাম আমলে। এখন তৃণমূল সরকার পনেরোটি জেলায় ভেটিভার লাগাচ্ছে। নদিয়ার সাড়ে পাঁচশো কিলোমিটার নদীবাঁধে ভেটিভার লাগানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, এখনও অবধি দুশো কিলোমিটারে বসানো হয়ে গিয়েছে ভাগীরথী, জলঙ্গি, চূর্ণী, মাথাভাঙা, পদ্মার পাড়ে। পশ্চিম মেদিনীপুরে এ-বছর রূপনারায়ণ, সুবর্ণরেখা, হলদি, কংসাবতী, চণ্ডীর পাড়ে আড়াইশো কিলোমিটারেরও বেশি নদীপাড়ে ঘাস বোনার কথা। মুর্শিদাবাদ, মালদহ, জলপাইগুড়িতেও কাজ হচ্ছে। এখনও অবধি গোটা রাজ্যে পাঁচশো কিলোমিটার মতো পাড় বাঁধানো হয়েছে ভেটিভার দিয়ে, বলছেন সরকারি কর্তারা।
একশো দিনের কাজের প্রকল্পের অধীনে নার্সারি তৈরি করে ভেটিভার চারা বানাচ্ছে মেয়েদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি। আবার সেই সব চারা নদীর পাড়ে বসানোতেও বেশ কিছু কর্মদিবস তৈরি হচ্ছে। নদিয়া, মালদহ, জলপাইগুড়িতে নদীর পাড়ে ঘাস বোনার পর অনেক জায়গায় চেহারাই বদলে গিয়েছে। ক্ষয়া, ভাঙা পাড় হয়ে উঠেছে সুঠাম, সবুজ। আশেপাশের ন্যাড়া নদীপাড়ের সঙ্গে ঘাস-বোনা নদীপাড়ের পার্থক্য খালি চোখেই বোঝা যায়।
অসম ও দক্ষিণ ভারতের কিছু রাজ্যে ভাঙন প্রতিরোধ ছাড়াও নানা ব্যবহার হচ্ছে এই ঘাসের। রাস্তায় ধাতব গার্ডওয়ালের পরিবর্তে, সমুদ্রতটে বালুচরের বিস্তার প্রতিরোধে, সজীব বেড়া বানাতে, মাটির নোনাভাব কমাতে কাজে লাগছে ভেটিভার। পরিবেশের দিক থেকেও এর উপযোগিতা খুব বেশি, কারণ কার্বন আবদ্ধ করার ক্ষমতায় অন্যান্য অনেক উদ্ভিদের চাইতে এগিয়ে ভেটিভার। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্ট বলছে, এখনই ভারতে যত কার্বন উদ্গত হয়, তার ছেচল্লিশ শতাংশ আবদ্ধ করছে ভেটিভার শস্যপ্রণালী। জল বা মাটি থেকে ভারী ধাতু শুষে নিতেও জুড়ি নেই এই ঘাসের। তাই ল্যান্ডফিল সাইটের পাশে লাগালে দূষণ ছড়ায় কম। পচা, দূষিত পুকুর-ডোবাতে ঘাসের ভেলা তৈরি করে ভাসিয়ে দিলেও জল থেকে ধাতু শুষে নেয়।
কিন্তু ভেটিভার কাজে লাগানোর উদ্যোগের পথ আটকে দাঁড়াচ্ছে বেশ কয়েকটি সমস্যা। যার অনেকগুলিই ছোট স্বার্থপ্রণোদিত।
প্রথমত, এ ভাবে ঘাস বুনে ভাঙন প্রতিরোধ, বা ‘বায়োইঞ্জিনিয়ারিং’, বন্যা নিয়ন্ত্রণের সাবেকি ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্পের বিকল্প হতে পারে না। নদীর ঢেউ যেখানে পাড়ের আট-দশ ফুট নীচে আঘাত করছে, সেখানে শুধু উপরে ঘাস বুনে বিশেষ লাভ হবে না। মুশকিল হল, দুই ধরনের প্রযুক্তিকে পরস্পর পরিপূরক বলে পরিকল্পনা এখনও দেখা যায় না। বিশেষত যে সংস্থাগুলি বায়োইঞ্জিনিয়ারিং করে, তারা সাবেকি প্রযুক্তিকে এড়াতে চায়।
দুই, ঘাস বোনার জন্য চার-পাঁচ ফুট জমি ছাড়তে রাজি হতে চান না জমির মালিকেরা। ভেটিভার প্রচলনে সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে কাজ করছে যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, সেই ‘গ্রাম ট্রাস্ট’-এর অভিজ্ঞতা, বন্যাদুর্গত এলাকাতেও মানুষকে বোঝাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। অনেক সময়ে বাঁধ তৈরির বরাত-পাওয়া সংস্থার সঙ্গে স্থানীয় সরকারের যোগাযোগ থাকে, তার জন্যও বাধা আসতে থাকে।
তিন, যখনই সরকারি প্রকল্প, তখনই দুর্নীতির স্পর্শ থাকে। বেনা ঘাসকে ভেটিভার বলে চালানোর একটা ঝোঁক লক্ষ করা যাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীদের মধ্যে। এটা আটকাতে না পারলে ভেটিভারের উপর মানুষের আস্থা কমতে বাধ্য।
মনে রাখা ভাল, জ্যাট্রোফার তেল যে জৈব জ্বালানি হিসাবে খুব উপযোগী, তা প্রমাণ হয়েছিল। তাকে কাজে লাগাতে উৎসাহও ছিল যথেষ্ট। তবু নানা শ্রেণির ব্যবসায়ীদের বাধায় তাকে কাজে লাগানো যায়নি। ভেটিভারের যেন সেই দশা না হয়।
বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy