তাজমহলের পশ্চিম ফটকের সামনে হামলা চালাল ভিএইচপি সদস্যরা। ছবি: টুইটার
ভাষ্যে শান্তির ললিত বাণী। কিন্তু ক্রিয়াকলাপ বলছে, সে সব নিতান্তই ব্যর্থ পরিহাস।
আবার অসহিষ্ণু আক্রমণ, আবার বর্বরের মতো আচরণ। আক্রান্ত হল তাজমহলের পশ্চিম ফটক। লোহার রড ও হাতুড়ি ব্যবহার করে ভাঙার চেষ্টা হল ঐতিহাসিক সৌধের প্রবেশদ্বারটি। সেখানে ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের তৈরি করা অস্থায়ী ফটকটিও উৎপাটিত হল। অভিযুক্ত বিশ্ব হিন্দু পরিষদ।
যত বার অসহিষ্ণুতার অভিযোগ তোলা হয়েছে সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে, তত বারই জোর গলায় তা নস্যাৎ করার চেষ্টা হয়েছে সঙ্ঘের তরফ থেকে। কখনও নাগরিক, কখনও প্রতিষ্ঠান, কখনও ইতিহাস আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু আক্রমণের হোতাদের দাবি, তেমন কিছুই হচ্ছে না, হইচই বেশি হচ্ছে।
আক্রমণ যার দিক থেকেই আসুক, দিনের শেষে দায় বর্তায় প্রশাসন বা সরকারের উপরে। সরকার কি অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে যথেষ্ট কঠোর অবস্থান নিচ্ছে? অবধারিত ভাবে প্রশ্ন ওঠে। আর সরকারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠলে শাসক দলকেও প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতেই হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাসক দল বা সরকার এ সব প্রশ্নের জবাবই দেয় না। এক অদ্ভুত অবজ্ঞা প্রকাশ করে যেন নীরবতায়। আর যখন জবাব দেয়, তখন শান্তি, সম্প্রীতি, ঐক্যের এমন ললিত বাণী শোনায়, যার বিন্দুমাত্র প্রতিফলন সরকারি পদক্ষেপে দেখা যায় না।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
সরকার শুধু নয়, দেশের শাসক পক্ষের বিরুদ্ধে তথা সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ তৈরি করার অভিযোগের জবাব সম্প্রতি দিতে চেয়েছেন সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবৎও। নাগপুরে সঙ্ঘে এক কর্মসূচির মঞ্চ থেকে ভাগবৎ বলেছেন, বিবিধতার মধ্যে একতা হল ভারতের হাজার হাজার বছরের পরম্পরা।
সঙ্ঘ প্রধানের এই মন্তব্যের পরে মাত্র কয়েকটা দিন কেটেছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অনুগামীরা সশস্ত্র হামলা চালালেন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক স্থাপত্যের প্রবেশদ্বারে।
ভুবনজোড়া খ্যাতি তাজমহলের। গোটা বিশ্ব যে সব প্রতীকগুলির মাধ্যমে ভারতকে চিনতে পারে, তাজমহল তেমনই এক প্রতীক। এ সৌধকে ঘিরে গরিমার অনুভূতি থাকার কথা ভারতবাসীর মনে। কিন্তু হচ্ছে উল্টো। কখনও বলা হচ্ছে, তাজমহলের নাম বদলে দেওয়া হবে। কখনও বলা হচ্ছে, তাজমহল গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। কখনও বলা হচ্ছে, তাজমহলের ইতিহাস নতুন করে লেখা হবে।
আরও পড়ুন: তাজমহলের ফটকে হামলা, অভিযুক্ত বিশ্ব হিন্দু পরিষদ
হামলাটা শেষ পর্যন্ত কিন্তু রোখা গেল না। তাজমহলের পশ্চিম ফটকে ভাঙচুরটা শেষ পর্যন্ত চালানো হল। কীসের এত বিদ্বেষ, সহনশীলতার এত অভাব কেন? তাজমহল মুঘলদের তৈরি স্থাপত্য বলেই কি এত বিদ্বেষ তার বিরুদ্ধে?
লোকসভা নির্বাচন ক্রমশ এগিয়ে আসছে। হিন্দুত্ব যে অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হবে বিজেপির কাছে, তা বলাই বাহুল্য। তবে তার জন্য হিন্দুত্বর হাওয়া নতুন করে তুলতে হবে দেশে। আচমকা তাজমহল বিরোধী জিগির দেখে আশঙ্কা হচ্ছে, হাওয়া তোলার পরিকল্পনা নয় তো এ সব?
একটি শিব মন্দিরের নাম জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এই বিতর্কে। তাজমহলের পশ্চিম ফটকটির কারণে চারশো বছরের পুরনো ওই শিব মন্দিরে পৌঁছনোর পথ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। তাজমহলের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে সংলগ্ন এলাকায় হিন্দুদের বেশ কিছু উত্সব-অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলেও এক দল লোকের দাবি। এ সব দাবি সত্য না অসত্য, সে বিতর্কে যাচ্ছি না। অভিযোগগুলো নিয়ে হইচই শুরু করার জন্য যে সময়টাকে বেছে নেওয়া হল, বিতর্ক উস্কে দিচ্ছে সেই সময়টাই।
২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে হিন্দুত্বের এজেন্ডা ছিল বিজেপির। অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ অন্যতম ‘লক্ষ্য’ ছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে। যে ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪-য় রাম মন্দির যে রকম অসম্পূর্ণ ছিল, ২০১৮-তেও সে রকমই। কিন্তু বিজেপির সদর দফতর এই চার বছরে বাংলো থেকে প্রাসাদে রূপান্তরিত হয়েছে। এ দৃশ্য যথেষ্ট অস্বস্তিতে ফেলেছে গেরুয়া শিবিরকে।
আগামী লোকসভা নির্বাচনেও মেরুকরণের প্রয়োজন পড়বে বিজেপির। সে কথা মাথায় রেখে এখন থেকেই হিন্দুত্বের জিগির তোলার চেষ্টা চলছে না তো? বিরোধী দলগুলি ঐক্যবদ্ধ হলে বিজেপির জয় যে বেশ কঠিন, দেশব্যাপী সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক উপনির্বাচনে সে কথা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। সেই সাফল্যের কথা মাথায় রেখে অন্তত চারশো লোকসভা আসনে ঐক্যবদ্ধ বিরোধী শিবিরের পক্ষ থেকে এক জনই প্রার্থী রাখার চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে। বিজেপির পক্ষে এ যে অশনি সঙ্কেত, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এই অশনি সঙ্কেতের মোকাবিলায় যদি কৃত্রিম ভাবে কট্টরবাদ উস্কে দেওয়ার চেষ্টা হয়, তা হলে সে হবে আরও মারাত্মক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy