Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

নদীকে মেরেছি, তাই মরছি

২০১৫ সালে বাঁকুড়ায় বড়জোড়ার কাছাকাছি একটি গ্রামে গিয়েছিলাম। সম্পন্ন গ্রাম। দামোদরের ও পারেই দুর্গাপুর স্টিল কারখানা, গ্রামের অধিকাংশ পরিবারের এক-দুজন সদস্য সেখানে কাজ করেন।

বার্ষিক: যে দিকে দুচোখ যায়, নির্মম জলরাশি। এ বার দুর্দশা চরমে পৌঁছেছে। রথিপুর, ঘাটাল। ২৫ জুলাই ২০১৭। ছবি: প্রদীপ সান্যাল

বার্ষিক: যে দিকে দুচোখ যায়, নির্মম জলরাশি। এ বার দুর্দশা চরমে পৌঁছেছে। রথিপুর, ঘাটাল। ২৫ জুলাই ২০১৭। ছবি: প্রদীপ সান্যাল

জয়া মিত্র
শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৭ ০৬:১০
Share: Save:

২০১৬ সালের ৩ অগস্ট বর্ধমানের কাছে মেমারিতে যাওয়ার কথা ছিল। তার আগের দুদিন ধরে বৃষ্টি পড়ছিল। আগের দিন বর্ধমান পৌঁছেছি। তেসরা সকাল সাতটায় বিপন্ন ফোন, ‘আসবেন না। স্টেশন প্লাটফর্মের বাইরে সব জায়গা জলে ডুবে আছে, জল ছাড়া দাঁড়াবার কোনও জায়গা নেই’। সে কী! মেমারি বেশ পুরনো, বর্ধিষ্ণু গ্রাম অঞ্চল বলেই তো জানি।

২০১৫ সালে বাঁকুড়ায় বড়জোড়ার কাছাকাছি একটি গ্রামে গিয়েছিলাম। সম্পন্ন গ্রাম। দামোদরের ও পারেই দুর্গাপুর স্টিল কারখানা, গ্রামের অধিকাংশ পরিবারের এক-দুজন সদস্য সেখানে কাজ করেন। গ্রামের বসত অঞ্চলে প্রতিটি বাড়ি পাকা— দোতলা-তিনতলা এবং কোনও বাড়ির সঙ্গে পাশের বাড়ির মাঝখানে এতটুকু ফাঁক নেই। একটিও গাছ নেই। এবং মোটামুটি বৃষ্টি পড়লেও সে জল বেরিয়ে যাওয়ার কোনও পথ নেই। উন্নত গ্রামগুলির এক বড় অংশেরই এই অবস্থা।

পুরসভা বা পঞ্চায়েতসমূহ বিল্ডিং প্ল্যান যে খতিয়ে দেখেন না, সেটা বোঝা যায় এই বর্ষায় জলজমার সমস্যা দেখলে। বর্ষা পৃথিবীতে নতুন নয়। মানুষের মাথা কেন একশো আশি ডিগ্রি ঘোরে না, এ-কথা নিয়ে রাগ বা বিস্ময়ের যেমন কোনও মানে নেই, আমাদের মৌসুমি জলবায়ুর দেশে বৃষ্টির প্রধান অংশই বর্ষার তিন মাসে ঝরে পড়ে, এই প্রাকৃতিক নিয়মকে সমস্যা ভাবাও সেরকমই অর্থহীন। অন্তত দু’হাজার বছর ধরে এ দেশের লোকেরা বৃষ্টিজল সংরক্ষণের ব্যবস্থা সম্পর্কে মনোযোগী থাকতেন। ভিন্ন ভিন্ন বৃষ্টি অঞ্চল ও বিভিন্ন ভূমিরূপের এই দেশে জলের ক্ষেত্রে কর্তব্য ও অকর্তব্যের যেন এক সম্পূর্ণ শাস্ত্র গড়ে উঠেছিল।

‘সম্ভবপরের জন্য প্রস্তুত থাকাই সভ্যতা’, এই আর্ষবাক্য মেনে নিলে বিশ্বাস করতেই হয় যে অন্তত বর্ষাজল বা সাধারণভাবে জল বিষয়ে ভারতে, আরও নির্দিষ্টভাবে বললে পূর্বভারতে, এমনকী সাধারণ মানুষরাও ‘জলসভ্য’ ছিলেন। ছোট নদীর কাছ ঘেঁষে বসত, বড় নদীর কাছে খেত, বসত কিন্তু দূরে। কথায় বলত চাষবাস। বড় নদীর ধারে নগর বন্দর, পল্লি ছোট নদীর পাড়ে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও সমাজে যেমন, সে-রকমই সরকারি ব্যবস্থাতেও জলস্থলের এই বিন্যাসকে মান্য করার একটা ধরন ছিল। আরও পুরনো আমলে, যখন সুরক্ষার কারণে শহর বা দুর্গ প্রাকারে ঘেরা থাকত, তখন সে সব প্রাকারের মধ্যে জলাশয় এবং বাইরে পরিখা থাকত, যাতে জল সরবরাহের পাশাপাশি জল না-জমার সুরক্ষা হয়।

কোটি বছর ধরে আমাদের বাসভূমি এই মৃত্তিকাপিণ্ডটি যে লক্ষকোটি ছোটবড় ঘটনার সমাপতনের ফলে প্রাণের ধারক হয়েছে, তা কার্যকারণের শৃঙ্খলায় আবদ্ধ। সেখানে প্রতিটি বস্তুর নিজস্ব চলন আছে এবং তা ছোটবড় অন্য বিস্তর প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ চলনের সঙ্গে জড়ানো। সে বাঁধন এত সূক্ষ্ম, এমন জটিল, সেখানে একটি ছোট সূত্র ছিঁড়ে গেলে ক্রমে সমস্ত নকশাটি টাল খায়। আর, যদি সে লঙ্ঘন চলতে থাকে বছরের পর বছর ধরে? তা হলে যা হয় সেটাই ইদানীং প্রায় প্রতি বর্ষায় ঘটছে।

সৃষ্টির শুরু থেকে বর্ষাজল আদিম জমির ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে ঢালের দিকে। উঁচুনিচু সেই জমির নিম্নতম অংশ দিয়ে জল গড়িয়ে যাবার সেই পথগুলোই নদী। নদী এক দিকে তার বয়ে-আনা পলি ফেলে ফেলে উর্বর মাটি তৈরি করে তুলেছে, অন্য দিকে ছোটবড় নদীগুলিই ছিল অববাহিকায় ঝরে পড়া বৃষ্টিজলের স্বাভাবিক নিকাশিপথ। বর্ষার মাঝামাঝি থেকে স্ফীত হয়ে ওঠা নদী কূল ছাপিয়ে দুপাশের অনেকখানি অঞ্চল জুড়ে বইত, কিন্তু তার স্থায়িত্ব ছিল অনেক কম দিন। বন্যাকালীন পলিমাটি দুপাশের খেত উর্বর করে তুলত আর মাটি বসে যাওয়া হালকা জলধারা বিপুল স্রোতে খাতকে আরও গভীর কেটে বয়ে চলে যেত। এই স্বাভাবিক শৃঙ্খলাটিকে মান্য করে মানুষ নিজের জীবন চালাত। জলস্থল সংস্থানের এই প্রাথমিক নিয়মগুলো তারা আয়ত্ত করেছিল। পারতপক্ষে সেগুলিকে লঙ্ঘন না করাই ছিল সর্বজনমান্য সামাজিক অনুশাসন।

চার-পাঁচ দশক আগেও বন্যাকে একটি সাময়িক সমস্যা বলে ধরা হত এবং তার শেষে থাকত খেতভরা পলিমাটির প্রসাদ। সত্তরের দশক থেকে জলমাটির এই স্থিতিশীল প্রাথমিক সম্পর্কে ভাঙন দেখা দেয়। তার আগে থেকেই দেশের স্রোতবতী নদীগুলিতে একের পর এক বাঁধ নদীজলের, অর্থাৎ তার অববাহিকা অঞ্চলে ঝরে পড়া জলের, স্বাভাবিক নিকাশপথকে বন্ধ করছিল। নদীর নিম্নপ্রবাহে পৌঁছে নতুন জমি তৈরি করার বদলে বয়ে আসা মাটি জমা হচ্ছিল বাঁধের পিছনের রিজার্ভারে। ডুয়ার্সের পর বাংলায় সবচেয়ে বেশি নদী ছিল বীরভূম, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ায়। তার কারণ, এই সব জায়গার মাটি গাঙ্গেয় উপত্যকার মতো আঠালো পলি নয়, কাঁকুরে ল্যাটেরাইট সয়েল, যার মধ্যে দিয়ে জল দ্রুত নীচে চলে যায়। এ দিকে এই পুরো এলাকার মাটির নীচে আছে ব্যাসল্ট, গ্রানাইট বা নিস-এর মতো আদিম কঠিন পাথর। জল তাকে সহজে ভেদ করতে পারে না। সুতরাং ভূপৃষ্ঠের অল্প নীচে জমা জল যে কোনও চ্যুতি দিয়ে ছোট নদী কি জলধারা রূপে বেরিয়ে আসত। ১৯৭৮ সালের আগের একশো বছরে
এ সব জেলার লোকের কখনও বন্যার অভিজ্ঞতা ছিল না। আশির মাঝামাঝি থেকে ‘নয়া কৃষি’ উন্নয়নকল্পে ‘জমিন চৌরস করা’ কর্মসূচি অনুযায়ী সমস্ত উঁচুনিচু কেটে এই এলাকাগুলিকে গঙ্গাক্ষেত্রের মতো সমান করে দেওয়া হল। সঙ্গে যোগ হল প্রায় প্রতিটি নদীর ওপরের বাঁধ। স্বাভাবিকভাবেই তিন-চার বছরের মধ্যে এখানকার মাঠের আলগা হয়ে যাওয়া মাটি সাধারণ বৃষ্টিতেও দ্রুত নেমে এসে নদীখাত ভরে ফেলল। হড়পা বানের স্বাধীনতা রইল না নদীর খাত পরিষ্কার করে ফেলার।

ঘাটাল, ময়না, আমতা, উদয়নারায়ণপুর-সহ বিস্তীর্ণ এলাকা নিম্ন দামোদর অববাহিকার অংশ। ডিভিসির বাঁধের পরে বাঁধের দরুন দামোদর আজ এক মৃত নদী। গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগেই দামোদরের প্রবাহ মরে যায়। সেই বদ্ধস্রোত জলার ওপর চার দিক থেকে গড়িয়ে আসা জলের সঙ্গে যখন যোগ হয় ডিভিসির ছাড়া জল, তখন কোন ব্লটিং পেপার ওই বিরাট অঞ্চলকে রক্ষা করবে! হেলিকপ্টার সদিচ্ছার প্রতীক। তা সমস্যার সমাধান করতে পারে না। ১৯৭৮-এর পর ২০০০, ২০০২-এর জলপ্রলয়ে এই প্রত্যেকটি সমস্যা বর্তমান ছিল। এ বারে সেই কালো মেঘে তিলমাত্র পরিত্রাণ ছিল শুধু এইটুকু যে সরকারের নিরলস সতর্কতায় ডিভিসির বাঁধগুলি আগের অনেক বারের মতো এক এক রাত্রে অঘোষিত ভাবে আড়াই লক্ষ কিউসেক জল ছাড়েনি। কিন্তু বাঁধ তৈরির সময়েই এই জল ছাড়ার কথা জানা থাকে। জানা থাকে এ কথাও যে, বাস্তবে প্রকৃতির স্বাভাবিক ব্যবস্থা ছাড়া নদী বা বাঁধ কার্যকর ভাবে ড্রেজিংয়ের অন্য উপায় নেই।

যা হয়েছে, যতই দুঃখপ্রদ হোক, তা অবশ্যম্ভাবী ছিল এবং ছিল একমাত্র সম্ভাবনা। যদি দু-এক বছর পর পর লক্ষ লক্ষ মানুষের কল্পনাতীত দুর্গতি এড়িয়ে যাওয়া প্রকৃতই আকাঙ্ক্ষিত হয়, তা হলে গোড়া থেকে ভাববার দায়িত্ব নিতে হবে। তা কঠিন হলেও অসম্ভব নয় হয়তো, কিন্তু আমাদের ঠিক করতে হবে, কী আমাদের কাছে অগ্রাধিকার পাবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE