Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি যেন কবির মাতৃক্রোড়

খুব ভোরে ওঠা তাঁর অভ্যাস ছিল। তেমনই এক গ্রীষ্মের দিন। ঘড়ির কাঁটা ৫টাও ছোঁয়নি। কবি বসেছেন কাগজ-কলম নিয়ে। লিখছেন অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য।আসলে ওই সকালবেলাটা রবীন্দ্রনাথের কাছে বিশেষ একটি মুহূর্ত। সৃষ্টির আবেগ তখন বিশেষ ভাবে জেগে ওঠে।

রবীন্দ্রনাথ কি শান্তিনিকেতনকে শুধু তাঁর পিতৃদেবের পছন্দের জায়গা বলেই ভালবেসেছিলেন? ফাইল চিত্র।

রবীন্দ্রনাথ কি শান্তিনিকেতনকে শুধু তাঁর পিতৃদেবের পছন্দের জায়গা বলেই ভালবেসেছিলেন? ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ০১:৫১
Share: Save:

শীতের শান্তিনিকেতন। তার রূপ, রমণীয়তা, সৌন্দর্য, আকর্ষণ আশ্রমিকদের চোখে যেন সব হতে সেরা। শুধু শীত নয়, শান্তিনিকেতনের বর্ষা, বসন্তও কি কম মনোরম, কম দৃষ্টিনন্দন নাকি? এ ছাড়া বৃক্ষরোপণ, দোল, পৌষ, সমাবর্তন ইত্যাদি আরও কত শত উৎসব তো আছেই। আছে বর্ষবরণ, বর্ষামঙ্গল, শারদোৎসব। সত্যি কথা বলতে কী, শান্তিনিকেতনে না এসে পৌঁছলে তার অপরূপ সৌন্দর্যের গোপন কথাটি কারও পক্ষে হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব নয়। সে সব হতে স্বতন্ত্র, অথচ সব হতে আপন।

রবীন্দ্রনাথ কি শান্তিনিকেতনকে শুধু তাঁর পিতৃদেবের পছন্দের জায়গা বলেই ভালবেসেছিলেন? না, শুধু সেটুকুই সব নয়। শান্তিনিকেতনকে দেবেন্দ্রনাথ আবিষ্কার করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু কলকাতা শহর থেকে কিছু দূরে বীরভূম জেলার লুপ-লাইনের বোলপুর-শান্তিনিকেতনের প্রথম প্রভাতটি থেকেই তার আশ্চর্য স্বতন্ত্র নিরাভরণ অপূর্ব সৌন্দর্য সেই যে কবিকে মুগ্ধ করেছিল, তা তাঁর জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। পৃথিবীর যেখানেই, যত দূরেই তিনি যান না কেন, কিছু দিনের মধ্যেই উতলা অধীর হয়ে প্রিয় শান্তিনিকেতনের বুকে ফিরে আসতে চাইতেন। তাঁর বড় আদরের শান্তিনিকেতনকে পৃথিবীর সত্য ও সৌন্দর্যের সবসেরা আকর্ষণ করে গড়তে চান যে তিনি।

কবির বয়স তখন এগারো বছর ক’মাস। বাবার সঙ্গে এসেছেন বোলপুর-শান্তিনিকেতনে। বোলপুর স্টেশনে রাত্রে নেমে পাল্কিতে শান্তিনিকেতন। তার পর তীব্র প্রতীক্ষিত রাত্রির অবসানে জেগে ওঠে শান্তিনিকেতনের প্রথম প্রভাত! শান্তিনিকেতনে কবির সেই প্রথম সকালের অভিজ্ঞতাটি—‘ভোরের বেলা উঠেই বাইরে এসে দেখলুম—চারি দিকেই মাঠ, কোথাও ধানের চিহ্ন নেই। জায়গায় জায়গায় মাটি খোঁড়া, শুনলুম সেইসব জায়গায় চাষ হয়েছে।... সেই প্রথম বোলপুর দর্শনের কত কথাই মনে পড়ে। তখনো কবিতা লিখতুম।...কবির যে রকমটি হওয়া উচিত সে সম্বন্ধে তখন আমার বিশেষ দৃষ্টি ছিল— দুপুর বেলায় মাঠের ভিতর খোয়াইয়ের মধ্যে একটা গুহার ছায়ায় পা ছড়িয়ে দিয়ে বসতুম, সামনে দিয়ে ক্ষীণ জলস্রোত বালির উপর দিয়ে বয়ে যেত, আপনাকে রীতিমত কবি বলে মনে হত। বুনো খেজুর গাছে ছোটো ছোটো খেজুর ফলে থাকত, সেগুলো খেতে আদবেই ভাল লাগত না, কিন্তু তবু মরুপ্রান্তরের মধ্যে বুনো গাছ থেকে বুনো ফল স্বহস্তে পেড়ে খাচ্ছি এই মনে করে একটা বিশেষ গর্ব অনুভব করতুম। এই খোয়াইয়ের মধ্যে আমানিডোবা বলে একটি ছোট্ট ডোবা ছিল, তার মধ্যে খুব ছোট্ট মাছ থাকত, কাপড়-চোপড় খুলে সেই ডোবার মধ্যে গিয়ে পড়তুম—মনে হত নির্ঝরের জলে স্নান করছি।’

এই তাঁর শান্তিনিকেতনে প্রথম আসা। প্রথম দর্শনে শান্তিনিকেতনের রুক্ষ প্রকৃতির অভিনব সৌন্দর্যে, তার দিগন্তবিস্তৃত রক্তিম মৃত্তিকায়, খোয়াই অঞ্চলের উঁচু নিচু রকমারি বৈচিত্র আর ‘নির্ঝরের জলে স্নান’-এ রবীন্দ্রনাথ সত্যিই মুগ্ধতায় নিমজ্জিত। এ ছিল তাঁর প্রথম পরিচয় তথা প্রথম প্রেম। পরে শান্তিনিকেতনের এই প্রকৃতি তার রূপ-রস-গন্ধ-স্নেহ-স্পর্শ, এককথায় সব কিছু যেন একদিন তাঁকে আরামে মাতৃক্রোড়ে নিশ্চিন্তে শায়িত থাকার সুখ এনে দিয়েছিল। পরবর্তী কালে কোনও দূরান্ত থেকে শান্তিনিকেতনে ফিরে এলে—তার লাল মাটি, নীল আকাশ, সবুজে মোড়া আম্রকুঞ্জ ও শালবীথি, গোয়ালপাড়া ও সাঁওতাল পল্লি, খোয়াই ও কোপাইয়ের মাঝে এসে পৌঁছলে— কবির মনে হয়, যেন তিনি মায়ের স্নেহভরা কোলটিতেই ফিরে এসেছেন।

শীত হোক কি গ্রীষ্ম! খুব ভোরে ওঠা কবির অভ্যাস ছিল। তেমনই এক দিন, গ্রীষ্মে। ঘড়ির কাঁটা ৫টাও ছোঁয়নি। কবি বসেছেন কাগজ-কলম নিয়ে। এক প্রিয়জনকে চিঠি লিখছেন। সে লেখা কোনও কর্তব্যের তাগিদে নয়। পত্রোত্তরও নয়। আসলে ভোরবেলাটি বড় মধুর অনুভূত হচ্ছে যে! যেমন পাখির কণ্ঠে ভোরের সূচনায় গান আসে, কবির কলমে তেমনই লেখা! সে লেখারই প্রথম ক’টি ছত্র:

‘এখনো পাঁচটা বাজে নি— কিন্তু আলো হয়েছে, বেশ বাতাস দিচ্ছে এবং বাগানের সমস্ত পাখিগুলো জেগে উঠে গান জুড়ে দিয়েছে। কোকিলটা তো সারা হয়ে গেল—সে কেন যে এত অবিশ্রাম ডাকে, এ পর্যন্ত বোঝা গেল না—।’

আসলে ওই সকালবেলাটা রবীন্দ্রনাথের কাছে বিশেষ একটি মুহূর্ত। সৃষ্টির আবেগ তখন বিশেষ ভাবে জেগে ওঠে। শান্তিনিকেতনে বসেই লিখছেন: ‘সকাল বেলাটি এমনি গভীর নিস্তব্ধ এবং সুন্দর এবং উজ্জ্বল যে, আমার মনে হচ্ছে আমার মনটা যেন একটি স্বচ্ছ এবং শীতল আলোকের মধ্যে সুগভীর ভাবে অবগাহন করে নির্মল নিরাময় হয়ে উঠছে।’ আরও লিখছেন, ‘একটা পেন্সিল এবং খাতা হাতে একটা কোনও রচনার মধ্যে প্রবেশ করতে ইচ্ছে করছে।’

গানেও তিনি ভোর-জাগা, ‘আজ প্রথম ফুলের পাব প্রসাদখানি, তাই ভোরে উঠেছি। আজ শুনতে পাব প্রথম আলোর বাণী, তাই বাইরে ছুটেছি।’ কালানুক্রমিক ‘গীতবিতান’-এই পরের গান: ‘আমাদের শান্তিনিকেতন আমাদের সব হতে আপন।’

শুধু সকাল কেন, বারো মাসই শান্তিনিকেতনের দুপুরটিও কবির কাছে ব়ড় উপভোগ্য। তেমনই শরতের এক দুপুর নিয়ে কবি বলছেন : ‘দুপুর বেলাটি এমন সুগভীর নিস্তব্ধ নির্জন এবং পরিপূর্ণ যে, আমার সমস্ত অন্তঃকরণটিকে একেবারে আবিষ্ট করে রেখে দেয়— লিখি, পড়ি, ভাবি, যাই করি, এই সুবিস্তীর্ণ সুবৃহৎ সকরুণ মধ্যাহ্ন আমাকে নীরবে সস্নেহে বেষ্টন করে থাকে।’ ওই চিঠিতেই লেখা, ‘বোলপুরের মতো এমন সুগভীর শান্তি এবং বিশ্রাম আর কোথাও পাওয়া যেত না।’— প্রথম আমলের চিঠিতে কবি ‘শান্তিনিকেতন’ নয়, লিখছেন ‘বোলপুর’ই।

দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরেই কি লেখালিখিতে বসতেন নাকি? কবিই জানান: ‘আমার ঘরের ভিতরে সমস্ত দুপুর বেলাটা কেবল কাঠবিড়ালির ছুটাছুটি চলে। খাওয়া-দাওয়ার পর অনেকক্ষণ পর্যন্ত অলসভাবে বসে বসে এই জন্তুগুলির বিচিত্র ভঙ্গি নিরীক্ষণ করে দেখা আমার প্রতিদিনের একটা নিয়মিত কাজের মধ্যে হয়ে গেছে।’

শান্তিনিকেতন থেকে তাঁর কোথাও আর যেতে মন সরে না। দু’দিন পর কলকাতায় যাওয়া, কিন্তু মন সাড়া দেয় না: ‘এখান থেকে যেতে আমার মন কেমন করছে—কলকাতায় ফিরে গিয়ে এখানকার প্রফুল্ল সকাল বেলা এবং নির্জন দুপুর বেলা আমার সর্বদাই মনে পড়বে—এখানকার শান্তি এবং সৌন্দর্যস্মৃতি আমাকে আকর্ষণ করতে থাকবে।’

আবার কলকাতায় গেলেই শীঘ্র বোলপুরে ফেরার জন্য মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। ‘শীঘ্রই বোলপুরে যাব সঙ্কল্প করেছি। আমি বেশ বুঝতে পারছি সেখানে যখন সেই গাড়িবারান্দার ছাতের উপর বড়ো কেদারা পেতে একলাটি শরতের সন্ধ্যালোকে বোলপুরের দিগন্তপ্রসারিত সবুজ মাঠের উপর আমার অন্তঃকরণের সমস্ত ভাঁজগুলি খুলে দিয়ে তাকে বিস্তৃত করে দিতে পারব, তখন অগাধ শান্তিরসে আমার সমস্ত জীবন অভিষিক্ত হয়ে উঠবে।’

আর একটি চিঠিতে অন্য এক জনকে লিখছেন: ‘আমার কলকাতার কাজ শেষ হয়ে এল, পরশু কিংবা শনিবারে শান্তিনিকেতনে ফিরে যাব।...এদিকে শুক্লপক্ষ এসে পড়ল। দিনে দিনে সন্ধ্যার পেয়ালাটি চাঁদের আলোয় ভর্তি হয়ে উঠতে থাকবে। আমি বারান্দায় আরামকেদারার উপর পা তুলে দিয়ে একলা চুপ করে বসব— চাঁদ আমার মনের ভাবনাগুলির পরে আপন রূপোর কাঠি ছুঁইয়ে তাদের স্বপ্নময় করে তুলবে—ছাতিমতলায় ঝরে পড়া মালতি ফুলের গন্ধ জ্যোৎস্নার সঙ্গে মিশে যাবে। সেই সুগন্ধি শুক্লরাত আমার মনের এ-কোণে ও-কোণে উঁকি দিয়ে কোনো নতুন গানের সুর খুঁজে বেড়াবে—বেহাগ কিংবা সিন্ধু কিংবা কানাড়া।’

আমাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন অনেকটা জানা আর অনেকই চেনা। কিন্তু শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রনাথকে আমরা এখনও বুঝি খুব বেশি জেনে উঠতে পারিনি। অথচ বারে বারে নানা সময়েই কবি বলেছেন, ‘বোলপুরের মতো এমন সুগভীর শান্তি এবং বিরাম’ আর কোথাও নেই। ডিসেম্বর এসেছে। শীতের হাওয়া, শান্তিনিকেতনে এসেছে তা-ও! কবিও লিখছেন: ‘আজকাল শীত পড়াতে হাত পা একটু ঠান্ডা হয়ে আসলেই দক্ষিণের বারান্দাটিতে গিয়ে বসি এবং মাতৃক্রোড়ের মতো প্রকৃতির একটি আতপ্ত স্পর্শ আমাকে আবৃত করে ফেলে; পায়ের কাছে রোদ্‌দুরটি এসে পড়ে, সবুজ মাঠের অতি দূর নীলাভ প্রান্তটি পর্যন্ত দেখা যায়, চারিদিকের গাছপালা থেকে পতঙ্গদের একটি অবিশ্রান্ত গুন্‌গুন্‌ শব্দ আসতে থাকে, মনে হয় যেন সকলের স্নেহ এবং সেবা চার দিক থেকে এসে আমার শরীরের মধ্যে জীবন সঞ্চার করে দিচ্ছে।’

সেই জীবনের স্পন্দন আজও শান্তিনিকেতনের বুকে অনুভূত হয়। সেই জীবন খুঁজে পাওয়ার জন্য আজও শান্তিনিকেতনের মাটিতে মানুষের মহামেলা।

লেখক বিশ্বভারতীর প্রাক্তন রবীন্দ্র অধ্যাপক (মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rabindranath Tagore Santiniketan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE