Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

দায়ও বুঝে নিতে হবে

এই সব বিদেশি কেতায় আমাদের অবশ্য কিচ্ছু আসে-যায় না; আমরা একে অন্যের ফোন নম্বর, ছবি, সব দিব্যি শেয়ার করছি।

ইন্দ্রজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৮ ০০:০১
Share: Save:

আপনার তথ্য সুরক্ষিত রাখার দায় আছে আমাদের। যদি আমরা সেটা পালন করতে না পারি, তবে আমরা (যা করছি তার) যোগ্যই নই।

মার্ক জ়াকারবার্গ, ২৫ মার্চ ২০১৮

দিন পনেরো আগে বিলেতের সংসদে এক নতুন আইনের আলোচনা হল যার গালভরা নাম আপস্কার্টিং— এই আইন বলবৎ হলে, আপনি অন্য কারও অজান্তে তাঁর বা তাঁদের ছবি তুলতে পারবেন না, ‘ফেসবুকে তোলা’ তো দূরস্থান!

ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার নিয়ে বিশ্ব জুড়ে বিপুল জলঘোলার শুরু মাস তিনেক আগের ফেসবুক বিতর্কে; গত ২৫ মে থেকে ইউরোপের সব দেশে চালু হয়েছে জিডিপিআর (জেনারেল ডেটা প্রোটেকশন রেগুলেশন)। গত কয়েক সপ্তাহে তাই ইন্টারনেটে ‘অ্যাকসেপ্ট কুকিজ়’ নীতির আমূল বদল হয়েছে; অন্ততপক্ষে আমাদের সম্মতি নিয়েই এখন তথ্য সংগৃহীত হচ্ছে। তথ্য সুরক্ষার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করছে সরকারি ও বেসরকারি সব সংস্থাই।

এই সব বিদেশি কেতায় আমাদের অবশ্য কিচ্ছু আসে-যায় না; আমরা একে অন্যের ফোন নম্বর, ছবি, সব দিব্যি শেয়ার করছি। যে কোনও দোকানে বিল মেটানোর সময় অনুরোধের বদলে বেশ ধমকের সুরেই আমাদের ফোন নম্বর চেয়ে নেওয়া হয়, যেন নম্বরটা আগে না বললে পয়সা দিয়ে যা কিনছেন, তা সে পিৎজ়া হোক বা বাচ্চার জামা, হাতে পাওয়ার হক নেই আপনার! দোকানি কেন আমার ব্যক্তিগত ফোন নম্বর বা ই-মেল আইডি চাইবেন অথবা কেনই বা আমি স্বেচ্ছায় আমার নিজের কোনও তথ্য দিতে রাজি হব, সেই প্রশ্ন আমরা তুলি না।

না-বলেকয়ে আমার তথ্য অন্যকে বিক্রি করা তো অপরাধ বটেই, এমনকি তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণও হয়তো অনৈতিক, তা সে ফেসবুক-তথ্য হোক বা রাষ্ট্রের আধার কার্ডের তথ্য। বিক্রি না করা হলেও চুরি হতে পারে; এমনকি, ট্রাম্প বা মোদীর জয়ের পথ মসৃণ করতে পারে! কাজটা ঠিক কি না সে প্রশ্ন আজ তাই অর্থনৈতিক পুস্তকে আবদ্ধ থাকে না; নৈতিকতা, সুরক্ষা, সমাজকল্যাণ, রাজনীতির প্রশ্নও সহজেই জড়িয়ে যায়।

এক দল বলেন, কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হবে! যেমন ধরা যাক, বিদেশে বসে এই কাগজের ওয়েব-সংস্করণ পড়া ছাড়া আমার গত্যন্তর নেই। অন্তর্জালে কাগজ খোলা মানেই আমার অজ্ঞাতসারেই আমার কম্পিউটার থেকে অনেক তথ্য অন্যের গোচরে চলে যাওয়া; অথচ, উপায় নেই— ফেলো তথ্যের কড়ি, মাখো কাগজের তেল। আমি চাই বা না-চাই, আমার ব্যক্তিগত তথ্য (প্রাইভেট ইনফরমেশন) আর কখনও প্রাইভেট থাকে না, ক্রমশ বাজারি পণ্য হয়ে ওঠে।

কেউ বা আবার বলবেন, না চাইলে ইন্টারনেটে কাগজ দেখো না, গান শুনো না, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দাও! ফেসবুক তো আমাদের কিছু পরিষেবা দিচ্ছে, তা-ও আবার বিনামূল্যে। মুশকিল হল, এই পরিষেবাটাই তথ্যনির্ভর, তথ্য না দিলে বন্ধু পাব কী করে? তা হলে, যে ডালে বসে আছি, সেই ডালটা কাটি কেন? উঠতি লেখক বা কবি আগে বই ছাপতেন না, ছাপলেও মেরেকেটে শ’দুয়েক বিক্রি হত; তিনিই এখন নিজের পেজ-এ লিখে পাচ্ছেন কয়েক হাজার পাঠকের ‘হাতের বুড়ো আঙুল’।

এই পরিস্থিতিতে আমাদের তথ্য নিয়ে যদি কারও ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে, তাকে কি পাইকারি ভাবে অনৈতিক বলে দাগিয়ে দেওয়া যায়? আমি যে পিৎজ়া কিনলাম সেই খবরটা এক দোকানি জানলেন, সে খবরের ভিত্তিতে তাঁর ব্যবসা, সামান্য হলেও, লাভের মুখ দেখল। হয়তো বা দোকানি সেই লাভের গুড়ের একটু অংশ আগামী দিনে ‘অফার’ হিসেবে আমাকেও দিলেন— মার্কেটিংয়ের পরিভাষায় যাকে বলে ‘লয়ালটি বোনাস’। আমার তথ্যের বিনিময়ে আমি অফার পেলাম, দোকানি যেন তথ্যের মূল্য ধরে দিলেন, ব্যস, শোধবোধ। তবু, মনে খচখচানিটা থেকেই যায়।

তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক, তথ্য সংগ্রহের এই দাবানলে কোনও অযৌক্তিক, অনৈতিক কিছু ঘটেনি— আমাকে জানিয়েই আমার কাছ থেকে আমার সম্বন্ধে তথ্য নেওয়া হয়েছে, কাউকে সেই তথ্য দেওয়া হয়নি, তথ্য বিক্রীত বা বিকৃত হয়নি, চুরি হয়নি, আমার তথ্য নিয়ে কোনও বাণিজ্যিক লেনদেন হয়নি। তা হলে কি চলছে-চলুক?

মোটেই না। সমস্যাটা শুধু অর্থনীতির বা নৈতিকতার নয়; প্রশ্ন দায়ভারেরও, দায়িত্বজ্ঞানেরও। যে মুহূর্তে আমার ব্যক্তিগত তথ্য কারও হাতে গেল, তখনই এল দায়ভারের কথা। ‘আপস্কার্টিং’ বা আমাকে না জানিয়ে আমার ব্যক্তিগত ছবি তোলা অপরাধ তো বটেই; তবে, তার সমান অপরাধ হল তথ্য নিয়ে দায়িত্বপালন না করা। আপনার সম্বন্ধে আমি যদি কিছুমাত্র জানি— ছবি, ফোন নম্বর, ব্যক্তিজীবনের গোপন ঘটনা যা-ই হোক না কেন, তা ব্যবহার বা অপপ্রয়োগের কোনও আধিকার আমার নেই, এই দায়িত্ববোধটাই সভ্যতা। তবে, এটা শুধু জ়াকারবার্গের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা নয়; দায়িত্বজ্ঞান আমাদের সকলকেই দেখাতে হবে।

ব্রিটেনে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

information security Awareness
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE