Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
সব বিভেদ ছাপিয়ে ভারতীয় বোধ এখনও ভারতেই আছে

‘দুরূহ কাজে নিজেরি দিয়ো কঠিন পরিচয়’

ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ৭২ বছর পরে সাম্প্রতিক কালে রাষ্ট্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয় গোটা দেশকে এক গভীর সঙ্কটের মুখে দাঁড় করিয়েছে আজ। এত দিন আমরা শুধুমাত্র মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের নিরিখে দুঃখ মোচন করেছি। কিন্তু সেখানেও একটা দাঁড়াবার স্থান আমাদের ছিল।

বিকাশচন্দ্র মৈত্র
শেষ আপডেট: ২৭ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ৭২ বছর পরে সাম্প্রতিক কালে রাষ্ট্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয় গোটা দেশকে এক গভীর সঙ্কটের মুখে দাঁড় করিয়েছে আজ। এত দিন আমরা শুধুমাত্র মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের নিরিখে দুঃখ মোচন করেছি। কিন্তু সেখানেও একটা দাঁড়াবার স্থান আমাদের ছিল। কিন্তু সেই অবক্ষয়ের দায় ও দায়িত্ব যখন রাষ্ট্র নেয়, তখন তো আমাদের আর দাঁড়াবার স্থান থাকে না। রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ চাপিয়ে দিচ্ছেন সঙ্কীর্ণতা, স্বার্থপরতা আর ধর্মীয় গোঁড়ামি দিয়ে ঐক্যবোধ ও চেতনাকে ভেঙে দেওয়ার কৌশল নিয়ে যে পরামর্শ সর্বস্তরে দিচ্ছেন তাঁরা, তা ভারতবোধের মূলকেই চৌচির করে দেওয়ার পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।

অথচ টুকরো টুকরো দেশকে জোড়া দেওয়ার কাজটি যে ভারতের মনীষীরা করেছিলেন, সেটা কারও অজানা নয়। উপনিষদ থেকে রবীন্দ্রনাথ, চৈতন্য থেকে বিবেকানন্দ পর্যন্ত যে সুতো দিয়ে ভারতকে জোড়া দেওয়ার কাজ হয়ে এসেছে, তা ছিল মানবতার সুতো। সেটাই মানবিক আত্মা, ভারতাত্মা। ভারতবর্ষকে অনুধাবন করতে হলে রবীন্দ্রনাথের এপিক উপন্যাসের কাছে যেতে হবে। গোরার মুখে রবীন্দ্রনাথ গোটা ভারতকে চিনিয়েছেন— “আজ আমি ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু মুসলমান খৃস্টান কোনো সমাজের কোনো বিরোধ নেই। আজ এই ভারতবর্ষের সকল জাতই আমার জাত, সকল অন্নই আমার অন্ন। দেখুন, আমি বাংলায় অনেক জেলায় ভ্রমণ করেছি, খুব নীচ পল্লীতেও আতিথ্য নিয়েছি— আমি কেবল শহরের সভায় বক্তৃতা করেছি তা মনে করবেন না— কিন্তু কোনোমতেই সকল লোকের পাশে গিয়ে বসতে পারিনি, এতদিন আমি আমার সঙ্গে সঙ্গেই একটা অদৃশ্য ব্যবধান নিয়ে ঘুরেছি, কিছুতেই সেটাকে পেরোতে পারিনি। সেজন্যে আমার মনের ভিতরে খুব একটা শূন্যতা ছিল।” গোরার এই উপলব্ধি গোটা দেশের উপলব্ধিতে এসেছিল বলেই গোটা ভারতকে এক করা গিয়েছিল। এমনকি চরম দারিদ্র, কুসংস্কার, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, অন্ধ সংস্কার থাকা সত্ত্বেও। ভারতবর্ষ হয়ে ওঠার পেছনে ছিল এক সাধনা— “সে অনেক মনীষীর কাজ”।

কিন্তু আজকের ভারতের এই বিভাজন নীতির পিছনে আছে আর এক ইতিহাস। আর সেই ইতিহাস সৃষ্টির কুশীলব ছিলেন সেই সময়ের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও ক্ষমতালাভের লোভের রাজনীতি। দাঙ্গাবিধ্বস্ত কলকাতাকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতার প্রাক্কালে জীবনানন্দ দাশ সেই সত্যকে ১৯৪৬-৪৭ নামে কবিতায় সযতনে তুলে আনলেন— “দিনের আলোয় ওই চারিদিকে মানুষের অস্পষ্ট ব্যস্ততা—/ পথে ঘাটে ট্রাক ট্রাম লাইনে ফুটপাতে,/ কোথাও পরের বাড়ি এখুনি নিলেম হবে—/মনে হয়, জলের মতন দামে।”

দুঃখের কথা, এখনও রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতারা ভারতবর্ষকে পরের বাড়ি বলেই মনে করেন। এবং তাঁদের চলাফেরা গতিবিধি মোটেই আর অস্পষ্ট নয়। এমনকি দিনের আলোতেও আজ ধর্মীয় ভেদাভেদের স্পষ্ট উচ্চারণ। রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার কিংবা ক্ষমতায় আসার স্বার্থচিন্তা এতই প্রবল যে, ভারত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ— সংবিধানের এই নির্দেশটি তাঁরা ভুলে মেরে দিয়েছেন। আর এই কুচিন্তাকে মাথায় রেখেই তাঁরা অম্বেডকরের গলায় মালা দেন আর অশ্রুও বর্ষণ করেন। দেশ, মানুষ, ন্যায় নীতি ন্যায্যতা, এ সব এখন আর দেশব্যবসায়ীরা মনে রাখেন না। এঁদের মুনাফা শুধু দেশের মাথা হয়ে বসায় আর নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করায়। যে বৃহত্তর বোধের কথা আমাদের মনীষীগণ বলেছিলেন ও যার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন, এঁরা তার মূলেই আঘাত হানছেন। ফলে আজ প্রতি মুহূর্তেই আমরা জাতিতে জাতিতে, ধর্মে ধর্মে খণ্ডিত হওয়ার আশঙ্কায় ভুগছি।

ভারত পঞ্চশীলের দেশ, বুদ্ধের বাণী ভারতের আত্মা। সেই দীর্ঘ দিনের অনুশীলনে গঠিত ভারতবোধ এখনও পর্যন্ত যে ভেঙে পড়েনি তার জন্য— “নমি নর দেবতারে”। আর সেই নর— হিন্দু নয় মুসলমান নয় খ্রিস্টান নয় বৌদ্ধ নয়— সে নরনারায়ণ, সে ভারতবর্ষে বসবাসকারী মানুষ। মানুষ এখনও যে দেশব্যবসায়ীদের হাতের ক্রীড়নক হয়ে যায়নি, শত প্ররোচনাকে উপেক্ষা করছে, এটাই ভারতের অন্তরশক্তি, প্রাণের দ্যোতনা।

১৯৪৭ সালে ভারত থেকে ইংরেজ চলে গেছে, অন্তত কাগজে কলমে। কিন্তু ভারত ভাগ আর একে অপরকে রক্তচক্ষু দেখিয়ে রাজত্ব লাভ— এই নিয়েই তো রাজনীতির ইতিহাস নির্ণয় চলছে। বাহাত্তরটা বছর পার করে এই ভারতবর্ষ এখনও ভাবছে— না না, ভাবছে নয়, ভাবাচ্ছে— হিন্দু না ওরা মুসলিম। এখন আর গোঁড়ামিটা শুধু গোঁড়াদের নয়, এখন তা দেশব্যবসায়ীদের। এঁরা মানুষকে নিয়ে বহুদিন ধরে খেলছেন।

চিন্তাশীল লেখক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় “স্বাধীনতার স্বাদ, সাম্প্রদায়িকতার শাস্তি, সংহতির সন্ধান” নামক প্রবন্ধে বলেছেন, “স্বাধীনতা প্রাপ্তির চল্লিশ বছর পরেও যে সাম্প্রদায়িক ও অন্যবিধ বিভেদের কলুষ থেকে মুক্ত হতে পারিনি, এটাই আজ এক বিকট মনস্তাপের কারণ হয়ে রয়েছে।” তিনি এ কথা বলেছিলেন আজ থেকে বত্রিশ বছর আগে। আর আমি এই কথা বলব যে, কলুষ থেকে মুক্ত হতে পারেননি দেশের রাজনৈতিক নেতারা, যাঁরা দেশ নিয়ে ব্যবসা করে ভোট ভোট খেলেন আর ক্ষমতার চূড়ায় উঠে মানুষকে প্রতিনিয়ত ধর্মবিভেদ নিয়ে উত্তেজিত করেন। কিছু মানুষ এতে উত্তেজিত হন ঠিকই, তবে তাঁরাও এই বিভেদের মধ্যে থেকে কিছু লাভালাভের ফন্দিফিকির খোঁজেন।

কিন্তু এর পরে দেখছি ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ একটা বিষয়ে অনেকটাই স্থিতু হয়েছে— সেটা হল এই যে, রাষ্ট্রনেতাদের সব কথায় কিংবা উত্তেজনাকর ব্যবস্থায় তারা নিজেদের অস্তিত্বকে বিসর্জন দেয়নি। বহু বছরের অনুশীলনে এখানে একটা স্থায়িত্ব এনে দিয়েছে। বাহাত্তর বছরের পাওয়া স্বাধীন ভারত নামটা এখনও সম্পূর্ণ নড়বড়ে হয়ে যায়নি; আর যায়নি যে, তার অনেকটাই পূর্বেকার রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সদিচ্ছার ফল। ধর্ম-বর্ণ-জাতিবোধ ছাপিয়ে ভারতীয় বোধ এখনও ভারতেই আছে। সুতরাং “সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ”, আর— মুক্ত করো ভয়, দুরূহ কাজে নিজেরি দিয়ো কঠিন পরিচয়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Democracy Republic Day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE