ট্রাম্প, ট্রাম্পই। সৌদি আরব ও ইজরায়েল ব্যতীত কার্যত গোটা দুনিয়া আকুল উদ্বেগে বারণ করা সত্ত্বেও নিজের মতে অনড় থাকিয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৫ সালে সম্পন্ন ঐতিহাসিক ইরান চুক্তি হইতে বাহির হইয়া আসিতেছেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারপর্বে ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন, ইরান চুক্তি ছাড়িবেন। তিনি কথা রাখিয়াছেন। ইরানকে তাহার পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ন্ত্রণে পাঁচটি পরমাণু শক্তিধর দেশ ও জার্মানির সহিত চুক্তিবদ্ধ করিতে বিস্তর কাঠখড় পুড়াইয়াছিলেন বারাক ওবামা। কিন্তু তাঁহার উত্তরসূরির সাফ কথা: চুক্তিটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনও হিত হয় নাই, হইবেও না। তাঁহার দৃঢ় অভিমত— চুক্তিটি মজ্জায় মজ্জায় দুর্বল। ট্রাম্পের আপত্তি তিনটি কারণে: এক, এই চুক্তি ইরানের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈয়ারির উপর নিয়ন্ত্রণ জারি করে নাই, দুই, ২০২৫ সালের পরে তাহার পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের সম্ভাবনা খোলা রাখিয়াছে এবং তিন, সিরিয়ায় ও ইয়েমেনে ইরানের সামরিক হস্তক্ষেপ সম্পর্কে চুক্তি নীরব। তাহার উপর আছে ইরানের সদিচ্ছা ও শুভবুদ্ধি সম্পর্কে ট্রাম্পের গভীর সন্দেহ। সেই কারণেই তিনি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ হইতে শুরু করিয়া কাহারও সদুপদেশ শুনিতে রাজি নহেন। সন্দেহে মিলায় চুক্তি, তর্কে বহু দূর।
অতঃপর? ইরান বলিয়াছে, সংশ্লিষ্ট অন্য দেশগুলি চুক্তিতে থাকিলে, তাহারাও থাকিবে। ফ্রান্স, জার্মানি, এমনকী ব্রিটেনও বলিতেছে, তাহারা চুক্তি ভাঙিবে না। আশার কথা। কিন্তু সেই আশার আয়ু? কয়েক মাসের মধ্যে আমেরিকা ইরানের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করিবে, এমন সম্ভাবনা প্রবল। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ইরান আপন শক্তিবৃদ্ধির তাগিদে পুনরায় পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণে উদ্যোগী হইতে পারে, তাহার সঙ্কেত ইতিমধ্যেই মিলিয়াছে। পাশাপাশি, সে চাহিবে পশ্চিম এশিয়ায় আপন প্রতিপত্তি আরও জোরদার করিতে। সে ক্ষেত্রে ইজরায়েল চুপ থাকিবে না। লক্ষণীয়, ট্রাম্পের ঘোষণার দুই দিনের মধ্যে ইজরায়েল সিরিয়ায় ‘ইরানের অস্ত্রাগার’ ধ্বংস করিতে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়িয়াছে। উত্তাপ বর্ধমান। মনে রাখা দরকার, পশ্চিম এশিয়ায় বাড়তি অস্থিরতা মানেই জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, বিশ্ব অর্থনীতিতে নূতন অভিঘাত। এই পরিপ্রেক্ষিতেই অধিকাংশ সমালোচকের বক্তব্য, ট্রাম্প বরং চুক্তিটিতে আরও কঠোর কিছু শর্ত যোগ করিতে পারিতেন। কিন্তু ট্রাম্প সেই পথ মাড়াইলেন না। এমন হঠকারী সিদ্ধান্তে কূটনীতির বাজি লড়া কঠিন।
প্রশ্ন উঠিতে পারে, যে পদক্ষেপকে বেহিসাবি ভাবা হইতেছে, তাহার পিছনে গূঢ়তর হিসাব নাই তো? ডোনাল্ড ট্রাম্প চাপ সৃষ্টি করিয়া ইরানকে কঠিনতর চুক্তিতে আবদ্ধ করিতে চাহিতেছেন না তো? তিনি দাবি করিতেই পারেন যে, উত্তর কোরিয়ার মহাবিদ্রোহী কিম জং উন তাঁহার চাপে পড়িয়াই অধুনা সহসা শান্তির গান শুনাইতেছেন, এমনকী মার্কিন বন্দিদের ফেরত পাঠাইতেছেন। ট্রাম্প হয়তো ইরানেও একই ঔষধ প্রয়োগ করিতে চাহিতেছেন। অসম্ভব নহে। এবং তাহাতে কাজ হইবে না, এমন কথাও হলফ করিয়া বলা শক্ত। অর্থনৈতিক সঙ্কটের আশঙ্কা এবং ইউরোপের তাগিদ, দুইয়ে মিলিয়া তেহরানের শাসকরা হয়তো শেষ অবধি কঠোরতর চুক্তিতে রাজি হইতে পারেন। কিন্তু বিপরীত সম্ভাবনাও অতি প্রবল। ইরান উত্তর কোরিয়া নহে। ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত এবং তাহার পরবর্তী নিষেধাজ্ঞার চাপ ইরানের রাজনীতিতে কট্টরপন্থীদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াইতে পারে, তুলনায় উদারপন্থী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির নিয়ন্ত্রণ হইতে লাগাম খসিয়া যাইতে পারে। এক দিকে চরমপন্থী ট্রাম্প এবং তাঁহার দোসর বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু, অন্য দিকে চরমপন্থী তেহরান— পশ্চিম এশিয়ায় আশঙ্কার মেঘ দ্রুত জমিতেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy