Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা তবে ফেল করেই চলুক

ক্ষম হে মম দীনতা

ইস্কুলের ‘বড়দি’ হিসেবে খানিক কৃতিত্ব জোটে বইকি— ‘আপনারই তো ছাত্রী’! বাস্তবিক আমার ছাত্রী? আমাদের ছাত্রী? তা যদি হত, তা হলে মালতী কেন ম্লানমুখে দাঁড়িয়ে?

মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৮ ০০:০৩
Share: Save:

বারো মাসে তেরো নয়, অধুনা অগুন্তি পার্বণ। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজ়াল্ট তো মহোৎসবই বটে। মেধাবীর পিতা, এবং অবশ্যই বিপুল সংখ্যক প্রাইভেট শিক্ষক পিতৃব্যদের জয়োল্লাস (প্রাইভেট টিউশনের হাটে মাতৃষ্বসা-রা এখনও গোনাগুনতি)। মাতারাও এগিয়ে আসছেন, তবে মাতৃকুলের অতটা উচ্ছ্বাস প্রদর্শন এখনও বিধিগ্রাহ্য হয়ে ওঠেনি, তাঁদের গর্বের প্রকাশ অবগুণ্ঠিত থাকাই বাঞ্ছনীয়। সমাজ তাই মানে, তাঁরাও। সমাজের এই মানামানিতে ‘রেজ়াল্ট উৎসব’-এ প্রথম দশই আসল। তারা কোন স্কুলের, কলা না বিজ্ঞান, ছেলে না মেয়ে, এ নিয়ে কয়েক দিন মাতোয়ারা থাকা। জ্যৈষ্ঠ শেষের প্রচণ্ড দাবদাহ আর অগ্নিবর্ষী বাজারের যৌথ আক্রমণ থেকে নিস্তার পেতে উৎসব চাই, পেয়েও যাই। চলে নিজস্বী নেওয়ার ধুম, মিষ্টির প্যাকেট হাতে আত্মীয়তা প্রমাণের সুযোগ পাওয়া ইনি-তিনি-মধুবাবু-মিনতিপিসি। পরীক্ষায় ‘নিশ্চিত’ সাফল্য পাওয়ার চাবিকাঠি অমুক সহায়িকা-বই, তমুক কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন আর প্রাইভেট শিক্ষকদের ফিরিস্তি, তাঁদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন।

ইস্কুলের ‘বড়দি’ হিসেবে খানিক কৃতিত্ব জোটে বইকি— ‘আপনারই তো ছাত্রী’! বাস্তবিক আমার ছাত্রী? আমাদের ছাত্রী? তা যদি হত, তা হলে মালতী কেন ম্লানমুখে দাঁড়িয়ে? তারও তো এই ইস্কুলেই নাম লেখানো, সে কেন দূরে সঙ্কোচে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি কাটে? কেন তার পিঠে হাত রাখতে সে ভেঙে পড়ে অঝোর কান্নায়, ‘‘দিদিমণি, কথা রাখতে পারিনি, মাপ করে দিবেন’’? সে তো চেষ্টা কম করেনি, সে পড়বার চেষ্টা করেছে, ক্লাসে বসে বুঝবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ফেল হওয়া আটকাতে পারেনি, যেমন পারেনি ওর পাড়ার আরও আরও মেয়েরা— টুডু, হেমব্রম, বাস্কে, ইত্যাদি।

কিন্তু মাপ করব কাকে? ওকে না নিজেকে? সহজ বুদ্ধি বলে, মাপ চাইবার কথা আমার, কিন্তু সামাজিক নির্মাণে অপরাধী চিহ্নিত হয় সে-ই, যার বিরুদ্ধে অপরাধটা সংঘটিত। লোককথায় পড়েছি, রাজার গোয়ালে প্রজার গরু ঢুকে গেলে প্রজাকে এসে বলতে হত, ‘‘মহারাজ, আপনার গরুর সঙ্গে আপনার গরু মিশে গিয়েছে— হুকুম হয় তো, আলাদা করে দিই?’’ নিজের ধনকে নিজের বলে দাবি করতে পারার, বা ক্ষমতাবানের অন্যায়কে অন্যায় বলে চিহ্নিত করতে পারার অক্ষমতা আমাদের সমাজবৈশিষ্ট্য, এবং তা শিক্ষাক্ষেত্রেও যথাবিহিত প্রভাবশালী। সেই প্রভাবে, অকৃতকার্যরা— সাঁওতাল-কোড়া-মুন্ডা-বাগদি-মুসলমান, জন্মের দুর্ভাগ্য এবং ফেল করার ভাগ্য নিয়ে জন্মানো ছেলেমেয়েরা— কোনও দিন কল্পনাও করতে পারে না যে, তাদের অকৃতকার্যতার জন্য অন্য কেউ দায়ী হতে পারে। বংশপরম্পরায় তারা জেনে এসেছে, তারা ফেলের জন্য সংরক্ষিত। এক দিকে সামাজিক ভাবে সুযোগ বঞ্চিতদের জন্য শিক্ষা ও চাকরিতে সংরক্ষণ নিয়ে বিরূপতার উগ্র রূপ, আর অন্য দিকে তাদের জন্য সমাজের যাবৎ কঠোর দৈহিক শ্রমের ভার সংরক্ষিত করে রাখা। তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের এই দ্বৈত প্রবৃত্তি আরও জোর পায়, যখন নিছক চিরবঞ্চিতদের মধ্যে দু’এক জন আকস্মিক ভাবে ভাল রেজ়াল্ট করে বসে। সামাজিক অন্যায় বৈধতা পায়, বঞ্চিতের পাপবোধ জমাট বাঁধে।

‘মেধা’র জোরে যারা উঠে আসে, তারা জেলাতেই হোক বা মহানগরে, প্রায় সকলেই বিশেষ আর্থসামাজিক সুবিধাভোগী গোষ্ঠীতে জন্মানো। বেশির ভাগেরই পড়াশোনা গৃহশিক্ষক-নির্ভর। মাথা পিছু দুই-তিন থেকে সাত-আট জন গৃহশিক্ষকের ফিরিস্তি শুনে আমাদের কিন্তু প্রশ্ন জাগে না, ইস্কুলের ভূমিকা কী? যেখানে আইনত প্রাইভেট টিউশন নিষিদ্ধ, সেখানে সেটাই ‘মেধা’র একমাত্র নির্ভরযোগ্য নির্মাতা হয় কী ভাবে, তা নিয়ে আমাদের ভাববার অবসর বা মনোবৃত্তি কোনওটাই দৃশ্যমান নয়।

শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে পাঠ্যবইতে অনেক ভাল ভাল কথা লেখা থাকলেও, কার্যত একশোয় একশো, নিদেন তার কাছাকাছি নম্বর পাওয়ার লক্ষ্য শিক্ষার্থীর মনে প্রথম থেকে গেঁথে দেওয়ার তাবৎ ব্যবস্থা আমরা করে রেখেছি। অমর্ত্য সেন লিখেছেন, ফার্স্ট হওয়ার মতো একটা সঙ্কীর্ণ লক্ষ্য যদি মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে শিক্ষার অগ্রাধিকারগুলো বিসদৃশ ভাবে খণ্ডিত হয়ে পড়ে। এমন কথা বলেন বলেই আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক শাসকরা অমর্ত্যর পুজোটা এমন ঢাকঢোল বাজিয়ে করে, যাতে তাঁর কথাগুলো শোনা না যায়। সেই যে এক কবি লিখেছিলেন না, ‘‘মনসার পুজো ঢের বেশি ভাল, কে চায় পূজিতে জ্যান্ত সাপ?’’ আসলে অমর্ত্য যেটা বলছেন সেটা মানতে হলে অধিকারের ব্যাপারটা মানতে হয়। শিক্ষা যদি অধিকার হয় তা হলে নম্বরের হোঁচট খাওয়া ব্যবস্থা চলে না। কিন্তু, ‘‘সরকারি নীতিগুলো খুবই জোরালো ভাবে সেই সব লোকেদের স্বার্থে কেন্দ্রীভূত, যারা সুযোগ ও সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে আগে থেকেই বিশেষ সুবিধা পেয়ে এসেছে।’’

অধিকারের সঙ্গে সুযোগের গভীর সম্পর্ক। যারা ফেল করল, দেখা যাচ্ছে একেবারে গোড়া থেকেই তারা ‘পিছিয়ে থেকেছে’। কারণ এই নয় যে, তাদের বুদ্ধি নেই, বরং কারণটা এই, যে ভাষায় তারা সামাজিক ভাবে শিক্ষিত হয়ে থাকে, প্রচলিত শিক্ষা সে ভাষা জানে না, আবার স্কুল যে সামাজিক ভাষায় পড়াতে চায় সেই ভাষা তাদের অজানা। না, বাংলা-সাঁওতালি-ইংরেজি ভাষার কথা বলছি না, বলছি এক সামাজিক-নৈতিক ভাষার কথা। এক লেখকের অভিজ্ঞতায়, এক সাঁওতাল ছাত্রীকে যখন পাটিগণিতের গোয়ালার দুধে জল মেশানোর অঙ্কটা কষতে দেওয়া হল, সে তো হেসে কুটিপাটি। দুধে কেন জল মেশানো হবে সেটা তার মনোভাবনায় কিছুতেই ধরা পড়ছিল না!

এই যে দুই ভিন্ন নৈতিক জগৎ, যেখানে এক দল শাসক, অন্য দল শাসিত, সেখানে শাসকের মনোজগতে স্থায়ী ভাবে গেড়ে বসে এক ভাবনা, লেখাপড়া ‘ওদের’ জন্য নয়। সেই ভাবনা থেকে ‘ওদের’ জন্য স্কুলের ব্যবস্থা অপ্রতুল, স্কুল থাকে তো মাস্টার নেই, থাকলেও তাঁকে ন্যায়বান ভাবে সক্রিয় হতে দেখা যায় না অনেক জায়গাতেই। তাদের জন্য এত দিন যেটুকু ভেবে আসা হয়েছে, তা হল, রেমেডিয়াল কোচিং। কিন্তু, কখনও এটা ভাবা হয়নি, কেন রেমেডিয়াল দরকার, কেন ব্যবস্থাটা এমন হবে না, যাতে সবাই ক্লাসের মধ্যেই সব শিখতে পারে? খুব কি কঠিন সে কাজ? গোটা উন্নত বিশ্ব, এমনকি আর্থিক ভাবে দুর্বল দেশগুলোও শিক্ষায় বিভাজন দূর করার জন্য নানা নীতি-ভিত্তিক কৃৎকৌশল আবিষ্কার করে চলেছে। এ কথা বললেই অনেকে ‘হাঁ হাঁ’ করে তেড়ে আসেন— প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া নামক যত্নে-লালন-করা জুজুটাকে বার করেন।

শিক্ষা তো প্রশ্ন করতে শেখায়; অথচ বাংলার বা ভারতের উচ্চশিক্ষিত মন এ প্রশ্নটা তোলে না যে, শিক্ষার্থীর পরিচিতি নির্মাণে তার জন্মসূত্রের প্রাসঙ্গিকতা কেন থাকবে? যখন স্কুলে প্রথম ভর্তি হচ্ছে তখন প্রতিটি শিশুই প্রথম শিক্ষার্থী। স্কুল যদি প্রতি শিশুকেই পাঠগ্রহণের সমান সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে, তা হলে তো এই সমস্যা থাকে না। কিন্তু এর জন্য তো স্কুলব্যবস্থা এবং অবশ্যই শিক্ষকদের যে কোনও প্রজন্মের শিক্ষার্থীকে পড়াতে পারার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে, শুধু প্রশিক্ষণের ডিগ্রি থাকলেই হবে না। তার জন্য প্রশ্ন করতে হবে, যে প্রশ্ন সুযোগসাম্যের, মানবিক অধিকারের। কিন্তু, তাতে, হ্যাপা অনেক। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোবে। তার চেয়ে ‘‘যার হবে তার এমনই এমনই হবে, না হলে কিছু করার নেই’’— এই অভ্যাসের নিশ্চিন্তপুরে আমরা দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারব। ‘আমাদের’ তো প্রাইভেট টিউশন আছেই, ‘ওদের’ বর্জনের কথা ভেবে লাভ কী?

আর তা-ই, গোদের উপর বিষফোঁড়া হিসেবে পাশ-ফেল ফিরে আসার কথায় আমাদের দুশ্চিন্তা নয়, ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে। সুযোগবঞ্চিতরা যা-ও বা খানিক স্কুলে আসতে পারছিল, এবং আর কিছু না হোক, অন্তত বহির্জগতের সঙ্গে সংলাপের কিছু প্রশিক্ষণ পেয়ে যাচ্ছিল, এ বার সেটা থেকেও তারা পূর্ণত বর্জিত হবে। মালতীর মার্জনাভিক্ষা থেকে আমাদের যেটুকু বা মনঃপীড়া হচ্ছিল, আমরা তা থেকেও মুক্তি পাব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Government backward class children Education
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE