Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

তালাক বিলে সমানাধিকার কই

মুসলিম মহিলা বিল তৈরি হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে। সুপ্রিম কোর্ট তাৎক্ষণিক তিন তালাককে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে।

আফরোজা খাতুন
শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৬:০০
Share: Save:

মুসলিম মহিলা (বিবাহ সংক্রান্ত অধিকার রক্ষা) বিল লোকসভায় পাশ হয়ে রাজ্যসভায় যাওয়ার আগেই চলে গেল সংসদীয় কমিটির কাছে। কবে আইন পাশ হবে, তা অনিশ্চিত। আইন পাশ হলেও মুসলিম মেয়েদের সমান অধিকারের দাবি কতটুকু মিটবে?

মুসলিম মহিলা বিল তৈরি হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে। সুপ্রিম কোর্ট তাৎক্ষণিক তিন তালাককে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে। বিলে বলা হচ্ছে, একসঙ্গে তিন বার ‘তালাক’ উচ্চারণ করে বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে পাঠালে তা ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে। এ-জন্য সেই স্বামীর তিন বছর জেল হবে, স্ত্রীকে ভরণপোষণও দিতে হবে। বিরোধী কয়েকটি রাজনৈতিক দলের আপত্তি, স্বামী জেলে থাকলে তার পক্ষে ভরণপোষণ দেওয়া সম্ভব নয়। অন্য দিকে, অধিকার আন্দোলনের কর্মীদের প্রশ্ন, বিবাহ এবং বিচ্ছেদে মুসলিম নারী-পুরুষের সমানাধিকার কি নিশ্চিত করবে এই বিল?

মুসলিম বিয়ে একটি চুক্তি, উভয়ের সম্মতি ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। কিন্তু বিচ্ছেদের ব্যাপারেই যত গোল। তালাক উচ্চারণের নিয়ম রয়েছে কোরানে-হাদিশে। কিন্তু একসঙ্গে তিন বার ‘তালাক’ বললে দাম্পত্যে বিচ্ছেদ ঘটে না। কোরানের নির্দেশ তেমনই। তবে যে নিয়মেই তালাক উচ্চারিত হোক, পুরুষই সে অধিকার পায়, নারী নয়। বিয়ের সময় মুসলিম মহিলাকে স্বামীর কাছ থেকে তালাক চাইবার অধিকার অর্জন করতে হয়। স্বামীর লিখিত অনুমতি থাকলে তবেই সেই স্ত্রী তালাক চাইতে পারে।

এই বৈষম্যকে অনেক পুরুষ জন্মসূত্রে পাওয়া অধিকার মনে করেন, এবং সুবিধা বুঝে তা প্রয়োগ করে আসছেন এ-দেশে। রাগের মুখে তালাক বললে, চিঠিতে, ফোনে, ইলেকট্রনিক মাধ্যমে তালাক পাঠালেও বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে। মুসলিম মৌলবাদ এত দিনে তাৎক্ষণিক তিন তালাককে ধর্মবর্হিভূত বলে প্রচার করছে, কিন্তু তার বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে কখনও জোরালো প্রতিবাদ করেনি।

বরং গ্রামে-গঞ্জে দেখেছি, তাৎক্ষণিক তিন তালাক মেনে না নিলে মেয়েপক্ষকে একঘরে করে দেওয়ার ফতোয়া জারি করা হয়েছে (অবশ্য ফতোয়াও অনেক সময় নির্ভর করে অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতের ওপর)। ‘তালাক’ বলে ফেললেই নাকি দাম্পত্য সম্পর্ক আর থাকে না। মুসলিম পিতৃতন্ত্রের এই দাপট থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে মেয়েরা। তাই সম্প্রদায়ের ভিতরেই শুরু হয়েছে সম-অধিকারের আন্দোলন। সুপ্রিম কোর্টে যেতে পেরেছেন পাঁচ জন মহিলা। খবরের আড়ালে আছেন আরও অনেকে।

অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড বলছে, কোনও পুরুষ তাৎক্ষণিক তালাক যাতে না দেয়, তার জন্য প্রচার চালাবে তারাই। কোর্ট যেন হস্তক্ষেপ না করে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের সরকার ও ক্ষমতাসীন দল মুসলিম মেয়েদের অধিকার আন্দোলনকে তাদের ‘অ্যাজেন্ডা’ করে প্রচারে চলে আসে। শুরু হয় মুসলিম মৌলবাদ বনাম হিন্দু মৌলবাদের লড়াই। সম-অধিকারের দাবি চাপা পড়ে যায় মুসলিম আর হিন্দু পিতৃতন্ত্রের দাপটে।

মুসলিম মেয়েরা যেটুকু আশার আলো দেখছেন, তা খুবই ক্ষীণ। কারণ, মৌখিক তালাক কিন্তু রয়েই গেল (তিন মাসে তিন তালাক)। এবং তা পুরুষের অধিকারেই। শুধু এক বারে তিন তালাক দেওয়াকে অবৈধ বলে বাতিল করা হল। এই রায়ের ভিত্তিতেই আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে তালাক বিল তৈরি হয়েছে বটে। কিন্তু তাতে মেয়েদের সম-অধিকার কোথায়? স্ত্রী যদি মনে করে ‘এই স্বামীর সঙ্গে আর থাকব না’, তখন বিচ্ছেদ নেওয়ার আইনটা কী হবে?‌ স্ত্রীকে সেই স্বামীর কাছেই আবেদন জানিয়ে তালাক নিতে হবে। মুসলিম মেয়েদের পক্ষে গেল কি এই তালাক বিল? স্বামীকে জেলে পাঠিয়ে প্রতিশোধ নেওয়া গেল, পিতৃতন্ত্রের প্রতিরোধ কতটা গড়ে উঠল?‌

আইনের সুরক্ষাও সীমিত, যদি না সমাজ তাকে কার্যকর করে। তাৎক্ষণিক তিন তালাক আইনি অপরাধ বলে ঘোষিত হয়েও, যদি ফতোয়া আসে তালাক মানতে হবে, তখন আইনের নিদান কী? স্বামী ফিরে এসে ওই স্ত্রীর সঙ্গে থাকতে চাইলে স্ত্রীকে কি হালালা (আবার অন্য পুরুষকে বিয়ে, সহবাস এবং তালাক নিয়ে পূর্ব স্বামীকে পুনরায় বিয়ে করা) মানতে হবে? অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তাই অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন এই তালাক বিল।

কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশংকর প্রসাদ বলেছেন, জেন্ডার জাস্টিস, সমানাধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নে আনা হয়েছ তালাক বিল, সরকার শরিয়তে হাত দেয়নি। ধর্মবহির্ভূত কাজকে আইন করে বন্ধ করতে চাইছে। মৌলবাদের গাওনা গেয়ে জেন্ডার জাস্টিস? এই বিলে মেয়েদের প্রতি ন্যায় বা সমানাধিকার নেই। আর মেয়েদের মর্যাদা রক্ষার নামেই তো শোষণ, অত্যাচার চলে। প্রশ্নটা অধিকারের। এই বিলে কোথায় বিচ্ছেদের সমান অধিকার?

সরকারের নিজের পিঠ চাপড়ানো, বিরোধী দলের শোরগোল, মুসলিম মৌলবাদীদের ফাঁপা প্রতিশ্রুতির মাঝে আপাতত চাপা পড়ে গেল মুসলিম মেয়েদের সাম্যের দাবি। তবে আইনের শেষ চেহারা যেমনই হোক, মুসলিম মেয়েদের লড়াই জারি থাকবে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে।

সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ফর উইমেন-এ বাংলার শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Triple Talaq Equality
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE