Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

কার গুলিতে মরছে মানুষ

পুলিশ অবশ্য বলছে, তারা গুলি চালায়নি। অজানা কোনও দুষ্কৃতী নাকি গুলি চালিয়েছে। কারা তারা? উত্তর মেলেনি। কখনও মিলবে কি? তৃণমূল আমলে পুলিশ-জনতা সংঘাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নাগরিকের মৃত্যুর বেশ কিছু ঘটনার ‘দুষ্কৃতী’র পরিচয় আজও অজানা।

রঞ্জিত শূর
শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

মানবাধিকার দিবস আসে-যায়, থেকে যায় কিছু প্রশ্ন। বিভিন্ন সময়ে জনবিক্ষোভে সর্বসমক্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন তাঁরা রেখে গিয়েছেন তেমনই কিছু প্রশ্ন। এ বছরেই তেমন ঘটল উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুরে। সেখানে হঠাৎ ছুটে-আসা গুলিতে মৃত্যু হল দুই তরুণের— রাজেশ সরকার ও তাপস বর্মন। কে গুলি চালিয়েছে? রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলে দিয়েছিলেন: পুলিশ গুলি চালায়নি, কে চালিয়েছে দেখা হচ্ছে। অথচ নিহত ও আহতদের বাড়ির লোক, স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা, এলাকার মানুষ, সকলেই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন পুলিশই গুলি চালিয়েছিল। মানবাধিকার সংগঠন গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি (এপিডিআর)–এর পাঁচ সদস্যের দল এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে সিদ্ধান্তে এসেছে, পুলিশের গুলিতেই মৃত্যু হয়েছে দুই তরুণের। পুলিশের গুলিতেই আহত হয়েছে আর এক কিশোর।

পুলিশ অবশ্য বলছে, তারা গুলি চালায়নি। অজানা কোনও দুষ্কৃতী নাকি গুলি চালিয়েছে। কারা তারা? উত্তর মেলেনি। কখনও মিলবে কি? তৃণমূল আমলে পুলিশ-জনতা সংঘাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নাগরিকের মৃত্যুর বেশ কিছু ঘটনার ‘দুষ্কৃতী’র পরিচয় আজও অজানা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্থানীয় মানুষ দায়ী করেছিলেন পুলিশকে।

বিক্ষোভরত নিরস্ত্র মানুষের উপর পুলিশের অমানবিক আক্রমণের ঘটনা বাম আমলেও কম ঘটেনি। নন্দীগ্রাম এবং সিঙ্গুরের ঘটনা তো রাজ্যবাসীর স্মৃতিতে উজ্জ্বল। ১৯৯৩ সালের একুশে জুলাই মমতার মহাকরণ অভিযানের সময় ধর্মতলায় পুলিশের গুলিতে তেরো জন মারা গিয়েছিলেন, পুলিশ যুক্তি দিয়েছিল ‘আত্মরক্ষা’। জ্যোতি বসুর সরকার কোনও অনুসন্ধান করেনি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘মানবাধিকার-ফানবাধিকার’ তিনি বুঝে নেবেন।

ক্ষমতায় দলবদল হল, কিন্তু সেই মানসিকতার পরিবর্তন হল কি? বছরখানেক আগে ভাঙড়ে পাওয়ার গ্রিড বিরোধী আন্দোলনে গুলিতে মারা যান দুই তরুণ, মফিজুল এবং আলমগীর। স্থানীয় মানুষ বলল, গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। পুলিশ ও সরকার বলল, পুলিশ গুলি চালায়নি। কে গুলি চালাল, খুঁজে দেখছে। সে খোঁজ এখনও চলছে। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃতের সংখ্যা চোদ্দো-পনেরো তো বটেই। প্রতিটি ঘটনাতেই পুলিশের দিকে আঙুল তুলেছিল আন্দোলনকারী সংগঠন, অন্যান্য রাজনৈতিক দল, স্থানীয় মানুষ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকার বলেছে, পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়নি। কে মেরেছে খোঁজা হচ্ছে।

একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। ২০১৬ সালের অগস্টে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঢোলার হাট থানার সামনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন স্থানীয় মানুষ। তাঁদের অভিযোগ, স্থানীয় এক গরু ব্যবসায়ীর মৃত্যুর তদন্তে পুলিশ টালবাহানা করছে। জনতা থানায় ঢোকার চেষ্টা করলে গুলি ছুটে আসে। সালাম নস্কর নিহত হন, আহত হন শিবাউদ্দিন হালদার। পুলিশ দায় অস্বীকার করে বলে, গুলি চালিয়েছে অজানা দুষ্কৃতী। দুষ্কৃতী আজও অজানা। ওই বছরই সেপ্টেম্বর মাসে ফরাক্কায় বিদ্যুতের দাবিতে আন্দোলনরত কৃষকদের এক জন (জামাল শেখ, ২৮) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। যথারীতি অজানা দুষ্কৃতীর তত্ত্বে ঢাকা পড়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর অভিযোগ শোনা যাচ্ছে যে, পুলিশ যেন আরও বেশি অধৈর্য হয়ে উঠেছে। এ দিকে পুলিশের কর্তা থেকে মুখ্যমন্ত্রী, প্রত্যেকে তদন্ত করার আগেই বলে দিচ্ছেন, ‘‘পুলিশ গুলি চালায়নি।’’ তবে কার গুলিতে মানুষ মরল? তদন্ত চলতেই থাকে, তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

তৃণমূলের শাসনকালের প্রথম পাঁচ বছরেও পুলিশ গুলি চালিয়েছে বেশ কয়েক বার। আসানসোল, মগরাহাট, শান্তিপুর, লোবায় প্রাণ হারান বেশ কিছু মানুষ। কিন্তু তখনও যেন দোষীকে খুঁজে বার করার, পরিস্থিতি শুধরে নেওয়ার কিছুটা উদ্যোগ ছিল। শান্তিপুরে পুলিশের গুলিতে এক ব্যক্তির মৃত্যুর পর মমতা নির্দেশ দিয়েছিলেন, রাইফেলে সিসার গুলি নিয়ে পুলিশ যেন জনসভা নিয়ন্ত্রণে না যায়। মগরাহাট, লোবাতে গুলিতে মৃত্যুর পর পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কমিশন বসেছিল। তার ফল কিছুই হয়নি, কিন্তু অন্তত পুলিশকে নিয়ন্ত্রণের কিছুটা চেষ্টা ছিল প্রশাসনের শীর্ষব্যক্তিদের। কিন্তু ইদানীং অভিযোগ, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে চটপট খারিজ করে দেন প্রশাসনের মুখপাত্ররা।

পর পর এতগুলি ঘটনায় পুলিশ অভিযুক্ত, এবং দুষ্কৃতীও অধরা, তাই সন্দেহ থেকেই যায়। প্রশ্ন ওঠে, গুলিচালনার আগে উত্তেজিত জনতাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য, ছত্রভঙ্গ করার জন্য, পুলিশের কয়েকটি কাজ করার কথা। মাইকে সতর্ক করা, লাঠিচালনা, জলকামান, কাঁদানে গ্যাস, শূন্যে গুলি, এ সব পর্যায় পার হয়ে তবেই আসে গুলিচালনার প্রশ্ন। জনতার হাতে আক্রান্ত হয়ে জীবনহানির আশঙ্কা দেখা দিলে, কেবল আত্মরক্ষার জন্য, পুলিশ গুলি চালাতে পারে। তা-ও বুক লক্ষ্য করে নয়, গুলি করতে হবে আহত করার জন্য। অথচ সব ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, গুলি চলছে বুক লক্ষ্য করে, যা মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। যদি সত্যিই পুলিশের বন্দুক থেকে গুলি চলে থাকে, তবে তা চিন্তার বিষয় বইকি। পুলিশের প্রশিক্ষণের পাঠ্যসূচিতে নাকি মানবাধিকারের জন্য বরাদ্দ সময় সাকুল্যে এক ঘণ্টা। ফল যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে।

পুলিশ-প্রশাসনের উপর আস্থা রাখা কঠিন হয়, যখন দেখা যায়, গুলিতে মৃতদের ময়না তদন্তের সময়ে নির্দেশিকা কিছুই মানা হয় না। ময়না তদন্তের আগে সুরতহাল-এর (‘ইনকোয়েস্ট’) সময় বাড়ির লোক উপস্থিত থাকার কথা। ময়না তদন্তের সময়ও পরিবারের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করতে হয়। ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ময়না তদন্তের পূর্ণ ভিডিয়োগ্রাফি করার কথা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সব নির্দেশ মানা হয় না। ইসলামপুরের ক্ষেত্রে সেই অভিযোগ উঠেছে— বাড়ির লোকেদের না জানিয়েই নাকি মধ্যরাতে ময়না তদন্ত হয়েছে। বাকি নির্দেশিকার কতটুকু মানা হয়েছে? সরকার নীরব।

বামফ্রন্টের সময় থেকেই অভিযোগ হয়ে আসছে যে, সরকার ডাক্তারদের প্রভাবিত করে ময়না তদন্তের রিপোর্টে কারচুপি করে। ডাক্তারবাবুরা ভয়ে বা ভক্তিতে সম্মত হন। এই আশঙ্কা কতটা গভীর, তা বোঝা যায় রাজেশ ও তাপসের মৃতদেহ সংরক্ষণের ঘটনায়। আদালতের আদেশে ফের ময়না তদন্ত হবে, সেই আশায় মাটির নীচে দেহ সংরক্ষণ করে রেখেছিল পরিবার দু’টি। দায়সারা ময়না তদন্তের অভিযোগ প্রতিনিয়তই শোনা যায়। ২০১১ সালে আমরি হাসপাতালে আগুনে মৃত নব্বই জনের ময়না তদন্ত এক জন ডাক্তার নাকি এক দিনে করে ফেলেছিলেন।

মন্ত্রী-সান্ত্রিরা বলছেন, আদালতে যান, তা হলেই তো সব পরিষ্কার হয়ে যাবে! ক’জন গুলিবিদ্ধ মানুষের পরিবার পারে আদালতে গিয়ে সরকারের সঙ্গে লড়াই করতে? সরকারও সেটা জানে। অন্তত এই সরকারের বিরুদ্ধে একটি ক্ষেত্রেও পুলিশের গুলিতে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। এক জন পুলিশও শাস্তি পায়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE