পঞ্জিকার মত, এ বৎসর দেবীর আগমন ঘোটকে, গমন দোলায়। তাহাতে শুভ হইবে কি অশুভ, তাহার বিচার করিবেন পণ্ডিত, আর বিশ্বাসের কাজটি ভক্তের। কিন্তু প্রতি বৎসর মৃত্যুর বাহন রূপে যে প্রাণীটি অবতীর্ণ হইতেছে, সেই মশকটিকে ভুলিবে কে? এ বৎসরও ছাতিম ঝরিবার পূর্বেই কত তরুণ প্রাণ ঝরিয়া গেল। মৃত্যুর সংখ্যা লইয়া বিতর্ক নিরর্থক। কেবল এইটুকু মনে রাখিতে হইবে যে, মৃত্যুগুলি নিবারণ করা সম্ভব ছিল। ডেঙ্গি এ বৎসরও পিতৃপক্ষ, দেবীপক্ষ জুড়িয়া তাণ্ডব নৃত্য করিয়াছে, ছিন্নভিন্ন হইয়াছে বহু পরিবার। ইহাই কি রাজ্যবাসীর ভবিতব্য? মহামারির নিকট বালক-বালিকা, তরুণ-তরুণীর বলি না দিয়া কি এ রাজ্যে অকালবোধনের বাজনা কখনও বাজিবে না? ইহার সম্ভাব্য উত্তর, না। প্রাচীনেরা বলিয়া গিয়াছেন, যাহার যেমন ভাবনা, তাহাদের সিদ্ধিও তদ্রূপই হইবে। যে জাতির ভাবনা আড়ম্বরসর্বস্ব, যাহারা আবর্জনার স্তূপকে রঙিন কাপড়ে আড়াল করিয়া প্রাসাদোপম মণ্ডপ রচনা করে, তাহাদের ভাগ্যে অকালমৃত্যু কে আটকাইতে পারে? পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা সম্পর্কে অধিকাংশ নাগরিকের ধারণা অতি বিচিত্র। তাহারা নিজের ঘরটি দুই বেলা মুছিবেন, দৈনিক তিন বার স্নান করিবেন, কিন্তু বাসস্থানের ঠিক সম্মুখে বাড়ির সকল আবর্জনা ফেলিয়া পুতিগন্ধময় স্তূপ রচনা করিবেন। বহু ব্যয়ে বিচিত্র সজ্জায় বাড়িঘর বানাইবেন, কিন্তু ঘরের সম্মুখে নিকাশি নর্দমাটি উন্মুক্তই রাখিবেন। তাহা কতখানি অশোভন এবং অস্বাস্থ্যকর, সে বোধটি কাহাকেও স্পর্শ করে না। বড় বিচিত্র এই সমাজ, যাহা মানুষকে ‘অশুচি’ বলিয়া দূরে রাখে, কিন্তু ঘৃণিত বর্জ্যকে দূর করিবার প্রয়োজন অনুভব করে না।
শারদোৎসবে সেই বিকৃত মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটে। প্রায় প্রতিটি পাড়াতেই একাধিক পূজামণ্ডপ, এবং একই সঙ্গে একাধিক আবর্জনার স্তূপ। ফলফুল বহিতে, প্রসাদ বিতরণ করিতে ব্যবহার করা হইতেছে প্লাস্টিক ও থার্মোকল, যাহা পরিত্যক্ত হইবামাত্র মশার আধারস্বরূপ হইয়া ওঠে। নাগরিকের কাছে পরিচ্ছন্নতা গুরুত্বপূর্ণ নহে, তাই নেতা-মন্ত্রীরাও তাহা লইয়া মাথা ঘামাইতে নারাজ। তাই বহু আড়ম্বরে, বহু ব্যয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করিতে নামিয়া সরকার ফের লোক হাসাইয়াছে। যে কোনও প্রকল্পের ন্যায়, ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণও কিছু লোকের কিছু বাড়তি রোজগারের ব্যবস্থায় শেষ হইয়াছে। তাহাতে কতটুকু কাজ হইল, কেহ দেখে নাই। দমদম কিংবা দেগঙ্গার মতো যে সকল এলাকা গত বৎসর ডেঙ্গিতে বিপর্যস্ত হইয়াছিল, সেগুলি এ বার ফের আক্রান্ত। সেই সকল এলাকায় সরকারি পরিদর্শক দল কিন্তু ঘুরিয়াছে। কোথাও জানাইয়াছে, দুই জায়গায় জল জমিয়াছে, কোথাও তিন জায়গায়। কোথাও মশার কীট মিলিয়াছে, কোথাও মেলে নাই। এই সব ‘রিপোর্ট’ নিয়মরক্ষার জন্য, জীবনরক্ষার জন্য নহে।
বঙ্গজীবনে আজ অর্থহীন আড়ম্বরের জয়গান। নূতন প্রথা, এ বারও যে প্রথা রাজ্যের সর্বত্র দেখা গেল, দেবীর বোধনের বহু পূর্বেই পূজার মণ্ডপের উদ্বোধন করিয়া ফেলেন নেতা-মন্ত্রীরা, প্রতিমায় প্রাণপ্রতিষ্ঠার পূর্বেই দেবীদর্শন সারিয়া ফেলেন দর্শকদল। দেবীর পূজার কার্যক্রমের সহিত পাড়ার পূজার কার্যক্রমের সম্পর্ক ক্ষীণ হইতে হইতে প্রায় অন্তর্হিত। স্বাস্থ্য দফতর বা পুরসভার কার্যক্রমের সহিত জনস্বাস্থ্যের সম্পর্কও তেমনই ক্ষীণ হইয়া আসিতেছে। তাহা দেখাইবার জন্য, কর্তব্যপূরণের জন্য নহে। এই প্রহসন বন্ধ হউক। জনস্বাস্থ্য বিষয়টি বিভাজিত করিয়া দেখিবার নহে। কখনও ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ, কখনও ডায়ারিয়া প্রতিরোধ, কখনও কালাজ্বর নিরোধক কর্মসূচি, ইহা অর্থহীন। প্রয়োজন সম্বৎসর নিবিড় কর্মসূচি, যাহাতে সকল কলুষ ও রোগভয়ের নাশ হয়। অকালমৃত্যুর দুর্গতি হইতে রক্ষা পাইতে পরিচ্ছন্নতার সাধনা করিতে হইবে বাঙালিকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy