Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

তাও কেন লেখক লিখবেন

সেই লেখাটিকে সংরক্ষণ করে সমাজের বৃহত্তর অংশে ছড়িয়ে দেওয়ার মানসিক তৃপ্তিজাত আনন্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে কারণটি।

বিপ্লব পাল
শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

দায়িত্ব নিয়েই বলছি, এক জন লেখকের থেকে এক জন দিনমজুরের প্রাসঙ্গিকতা অনেক বেশি।
দিনমজুর তাঁর কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে পরিবারের অন্ন জোগান। অন্য দিকে, এক জন লেখক লেখালিখি করে সংসারের ভরণপোষণ তো দূর, কাগজ-কলমের পয়সাই জোগাড় করতে পারেন না। গাঁটের পয়সা খরচ করে তাঁকে বই ছাপাতে হয়, প্রচার ও বিক্রি নিজেকেই করতে হয়। লেখককে ছোট করার জন্যে বলছি না বা তুলনা করছি না। বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে লেখকের করুণ অবস্থা বোঝাতেই এই বাস্তবতার অবতারণা।
কেন লেখকের আজও এত দৈন্যদশা, বুঝতে গেলে ফিরে তাকাতে হয় ইতিহাসের দিকে। আমাদের আধুনিক ইতিহাস ইংরেজদের গড়ে দেওয়া ইতিহাস। হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা একটি সুসভ্য ভাষাগোষ্ঠীর ধারাবাহিক অগ্রগতির সামাজিক ইতিহাস নয়। সেই ইতিহাস পলাশির আমবাগানে ১৭৫৭ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল। তার পর ইংরেজের স্কুলে অধ্যয়ন করে ইংরেজি মুখস্থ করে ইংরেজের বানানো ডিগ্রি হাশিল করে আমাদের সুসভ্য হয়ে ওঠা। এটাই আধুনিক বাংলা ও বাঙালির সার্বিক ইতিহাস।
ইংরেজি বিদ্যালয়ে ইংরেজি মুখস্থ করে আমরা শিখেছি কী করে মনোমতো একটি সরকারি বা বেসরকারি চাকরি বাগিয়ে নেওয়া যায় এবং সেই পথে রাস্তা সাফ করতে কখন কাদের পায়ে ‘অয়েলিং’ করা জরুরি। আধুনিকতার সার্বিক চেহারা যদি এমন হয়, তবে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে সেই সমাজের উঁকি দেওয়ার অনুরাগ কতটুকু থাকবে, বোঝাই যায়। ডিগ্রি আর মোটা অঙ্কের উপার্জনই যে সমাজের সব কিছু বিচারের মানদণ্ড, সেই সমাজে লেখকের অপ্রাসঙ্গিকতা মোটেই অস্বাভাবিক নয়।
ইংরেজি বিদ্যালয়ে সুসভ্য হয়ে ওঠা বাঙালি আরও একটি প্রয়োজনীয় পাঠ অর্জন করে নিতে পেরেছে অনায়াসে— দেশের অধিকাংশ জনগণ যত বেশি পরিমাণে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে, তত বেশি আরামে দিন কাটবে ইংরেজি বিদ্যালয়ে মুখস্থবিদ ডিগ্রিধারীদের। তাই ইংরেজ চলে যাওয়ার পরও অধিকাংশ বাঙালিকেই আমরা অশিক্ষিত করে রাখতে সক্ষম হয়েছি। সমাজে অশিক্ষিত জনসংখ্যার পরিমাণ যত বেশি, লেখকের লেখার পাঠকও তত কম।
কিন্তু ইউরোপ ও আমেরিকার মতো আমরাও যদি কালের ধারাবাহিকতায় একটি স্বাধীন জাতির স্বাধীন সমাজের মতোই মধ্যযুগীয় অন্ধকার
থেকে দিনে দিনে সমাজ বিবর্তনের স্বাভাবিক ধারাতে বিকশিত হওয়ার সুযোগ ও পরিসর পেতাম, বিশ্বের অন্যান্য উন্নত জাতির সঙ্গে স্বাধীন ভাবে
ভাব বিনিময়ের মধ্য দিয়ে পরিপুষ্ট হয়ে উঠতে পারতাম, তা হলে আমরাও এক দিন আধুনিক যুগে পা রাখতে পারতাম। সেই প্রবেশ ঘটত নিজেদের পায়ের দৃপ্ত পদক্ষেপেই। ইংরেজের ধরিয়ে দেওয়া লাঠিতে ভর দিয়ে নয়। পরিতাপের কথা, ইতিহাসের এই দিকটি ও তার গুরুত্ব সম্বন্ধে আমাদের শিক্ষিত মানুষদেরই কোনও রকম ধ্যানধারণা গড়ে ওঠেনি আজও। তার দামই গুনছি আমরা প্রতি দিনের সমাজ ও জীবনের বাস্তবতায়।
কিন্তু বাঙালির পাঠাভ্যাস ও তার জীবনে বইয়ের প্রকৃত মূল্য, বাঙালি জনমানসে এক জন লেখকের মর্যাদা ও সম্মান, এই সব বিষয়গুলি প্রকাশকমাত্রেই ভাল জানেন। তাই লেখককে একটি সৌজন্য সংখ্যা ধরিয়েই তিনি কোনও রকমে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন একটি সাময়িকী। কিন্তু বই প্রকাশের প্রয়োজন হলেই প্রকাশকের মাথায় হাত। কে কিনবে লেখকের বই? ক’টি সংখ্যা বিক্রি হবে? প্রকাশকের লগ্নিই বা কি করে লাভের মুখ দেখবে? তখন প্রকাশক লেখকের কাছেই তাঁর বই প্রকাশ করে দেওয়ার নানা রকম কৌশলী ফাঁদ পাতেন। লেখক এক বার শুধু ধরা দিলেই হল। প্রকাশকের লাভ নিশ্চিত। তোমারই পয়সা। তোমারই বই। আমি শুধু লাভের পুরোটা রেখে বই ছাপিয়েই ক্ষান্ত। তার পর তোমার বই বিক্রি হোক, না-হোক, মাথাব্যথা আমার নয়।
কিন্তু লেখকেরই বা এত মাথাব্যথা কেন? কী হবে লিখে? কী-ই বা হবে নিজের কষ্টার্জিত অর্থ অপচয় করে? প্রথমত লেখক কেন লেখেন? লেখেন নিজের কথা আমাদের বলার জন্যে। সে তো ঘরের জানলার দিকে মুখ করেও বলা যায়। কিন্তু না। শুধু বলাই তো আর উদ্দেশ্য নয়। মূল উদ্দেশ্য অন্য এক জনকে শোনানো। বেশ তো, বাড়িতে বা বন্ধুবান্ধবের মধ্যে যিনি শুনতে চান, তাঁকে শুনিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। তার জন্যে সময় খরচ করে বই লেখা কেন?
কারণ তো শুধুই লেখার মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করা নয়। সেই লেখাটিকে সংরক্ষণ করে সমাজের বৃহত্তর অংশে ছড়িয়ে দেওয়ার মানসিক তৃপ্তিজাত আনন্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে কারণটি। সেই আনন্দই হল সংযোগের আনন্দ। এক জন লেখক যখন পাঠকের সঙ্গে সংযোগ সূত্রটি গড়ে তুলতে পারেনস তাতেই তাঁর তৃপ্তি। প্রত্যেক লেখকের চিন্তা-চেতনা জুড়ে এই সংযোগেরই সাধনা। লেখক চান তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে বহু জনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন। এই যে নিরন্তর তাগিদ, সেই তাগিদেই এক জন লেখক বাজারের ব্যবসায়িক সব রকম নিয়ম অম্লানবদনে মেনে নিতে বাধ্য হন। বাধ্য হন বিনা পারিশ্রমিকে লিখতে। বাধ্য হন অন্য পেশায় নিযুক্ত হতে লেখালিখি চালিয়ে যেতে। আমাদের সমাজ ও বইয়ের বাজারের কাছে লেখক তাই দাসত্বের শৃঙ্খলেই নিজেকে বেঁধে ফেলেন। না ফেললে যে তাঁর মুক্তি ‌েনই।
তাই লেখক চির কাল লিখবেন, বইও ছাপা হবে। যে ক’জন পাঠক সে বই পড়ে আলোকিত হবেন, তাঁরাই গোটা সমাজকে আলোকিত করবেন। এ ভাবেই চিন্তা-চেতনার বিপ্লব ঘটবে, মুক্ত হবেন লেখক, মুক্ত হবে সমাজ সমস্ত পঙ্কিলতা থেকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Education Academics Writer Writing
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE