Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

ভ্রমরকে ঘরে ফিরতে হয় কেন

নিরক্ষর ভ্রমর কোন চিহ্নে ছাপ দিয়ে দেশোদ্ধার করে ফিরবেন? কোন চিহ্নে ছাপ না দিলে ভোটার-তালিকায় তাঁর নাম ঠাঁই পাবে না আর?

শ্রীদীপ
শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৮ ০১:১২
Share: Save:

মাস দেড়েক আগের কথা। দিল্লির মিন্টো রোডের পরিচিত গ্যারাজে গাড়ি সারাতে গিয়ে শুনলাম, কারিগর ভ্রমরভাই বাড়ি গিয়েছেন। দূরপাল্লার ট্রেন ধরে তাঁকে ছুটতে হয়েছে দিনাজপুরে— পঞ্চায়েত নির্বাচনে ছাপ দিতে। না গেলে নাকি ভোটার তালিকা থেকে তাঁর নাম অনায়াসে কাটা যেত। তখন নাকি খুব মুশকিল। তার চাইতে লক্ষ্মী ছেলের মতো সঞ্চয় খসিয়ে, গরমে সেদ্ধ হয়ে, যাওয়া আসার ৪৮ ঘণ্টার ঢুকুর-ঢুকুর ভাল।

নিরক্ষর ভ্রমর কোন চিহ্নে ছাপ দিয়ে দেশোদ্ধার করে ফিরবেন? কোন চিহ্নে ছাপ না দিলে ভোটার-তালিকায় তাঁর নাম ঠাঁই পাবে না আর? কিসের চাপে দায়িত্ববান নাগরিক হওয়ার প্রমাণ পেশ করতে তাঁকে যেতেই হবে অসংরক্ষিত বগির হেনস্থা সহ্য করে? কেনই বা তাঁকে ও তাঁর মতো লক্ষ লক্ষ মানুষকে সপরিবারে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়তে হয় জীবিকার সন্ধানে? গঞ্জ থেকে আসা শ্রমজীবীকে কী চোখে দেখে বড় শহরের দেমাক, দম্ভ ও ব্যস্ততা? কী কাজে লাগায় তাঁর আনাড়ি হাত-পা-শরীরকে?

আবার নির্বাচন আসবে। যাবে। কিছু শিরোনাম, কিছু প্রতিশ্রুতি, কিছু ক্ষোভ, কিছু লাশ, কিছু রক্ত, কিছু গণনা, কিছু কৌশল, কিছু ক্যাপচার, কিছু জট, কিছু জোট— একটা ফলাফল, তার পর খুব তাড়াতাড়ি সব ভুলে যাওয়া। আইপিএল, আইটেম-নাম্বার, ইন্ডিয়ান আইডল-এর মতোই ধারাবাহিকতায় বয়ে যাওয়া সংসদীয় পুতুলনাচ।

ভ্রমর কেন নিরক্ষর? তাঁকে কেনই বা কাজের সন্ধানে দেড় হাজার কিলোমিটার পেরিয়ে দিল্লির বস্তিতে ঠাঁই নিতে হয়? আর কেনই বা তিনি বাধ্য হন আঙ্গুল-ছাপ দেওয়ার জন্য গ্রামে ফিরতে? এই প্রশ্নগুলোর আড়ালে আর একটা প্রশ্নকে আমরা কার্পেট চাপা দিয়ে রাখি— এই ছাপ-মারা ছাপোষা গণতন্ত্র চিহ্ন বাছার স্বাধীনতা ছাড়া আর কোন অধিকার দিয়ে থাকে ভ্রমরের মতো নাগরিককে? না কি ভোটাধিকারই তাঁর নাগরিকত্বের শুরু ও শেষ? তা-ই যদি হয়, তা হলে এ গণতন্ত্র তাঁকে কতটা দেয় আর কতটা তাঁর থেকে নিংড়ে নেয়?

যত দিন না ভ্রমর বুঝছেন যে পাঁচ বছরে এক বার ভোট-উৎসবে প্রার্থী বেছে নেওয়ার লোক-দেখানো স্বাধীনতা, অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক শর্তের মধ্যে মাত্র একটি, তত দিন তাঁর ভোট একটি পরিসংখ্যান মাত্র। যত দিন না তিনি শিখছেন এ ভোটাধিকারের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত বাকি সাংবিধানিক অধিকারগুলি, তত দিন তাঁর ভোটে রাইটার্স-এর রং পাল্টালেও, তাঁর জীবনে পরিবর্তন আসতে পারে না। আর যত দিন না আমরা উপলব্ধি করছি যে, গণতন্ত্র মানে শুধুই নির্বাচন-প্রচার-প্রতিশ্রুতি নয় বরং তা অতিক্রম করে যথাযথ ন্যায়, মর্যাদা, সমতাই গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি, তত দিন এ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অক্ষম ও অসমর্থই থেকে যাবে। ভোটাধিকার সবার কাম্য। কিন্তু, এটাও বোঝা প্রয়োজন দারিদ্র বা নিরক্ষরতা যে কোনও সমাজেই শোষণের অন্যতম ভিত্তি। সার্বিক উন্নয়ন ব্যতীত ভোটের রাজনীতি ও নির্বাচন সর্বস্ব গণতন্ত্র অনেকটা ভিতবিহীন দালান বাড়ির মতো।

বিশ্বের এমন কোনও সফল গণতন্ত্রের উদাহরণ নেই, যেখানে নাগরিকের ন্যূনতম শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, কর্মদক্ষতায় প্রশাসনিক ঘি না ঢেলে সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। আমাদের গণতান্ত্রিক মডেলটা অবশ্য আলাদা— আগে ভোট, পরে ভোট; ভোটেই শুরু; ভোটেই শেষ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সাম্য-চিন্তা হল ইস্তাহারের পাতা ভরানোর শব্দসমষ্টি মাত্র।

যেখানে ভোট চাওয়া, ভোট ভাবনা, ভোট ভোগ, ভোট পরিকল্পনা, জাতি-শ্রেণির ভিত্তিতে ভোটের সমীকরণই গণতন্ত্রের প্রায় সবটা, সেখানে গণতন্ত্রের সময় কোথায় ভোটারকে ভোটাধিকারের থেকে বেশি কিছু পাইয়ে দেওয়ার?

তা-ও আমাদের ভ্রমর ভোট দিতে যান আরও এক বার। তা-ও জুমলায় মজে বোকা মন, সুদিনের কোনও এক দৈব আলো এসে পড়বে আমাদের জীবনে। উৎপীড়নের ইতিহাস বার বার বিভ্রান্ত হয়ে গলে পড়বে সাজানো ইস্তাহারের পাতায়। আস্থা দেখাবে মানুষ নির্বাচনে, ব্যালটে, আশ্বাসে। আবারও মঞ্চে এ রং, ও রং, সে রং ওড়ে। মাচার মাইক থেকে প্রতিশ্রুতির ধ্বনি ভেসে আসে ভ্রমরের উঠোনে। এবাদী-ওবাদী চিহ্নে রঞ্জিত হয় তাঁর ঘুঁটে দেওয়া দেওয়াল। কখনও ভিক্ষার ঝুলি হাতে, কখনও বন্দুক হাতে, কখনও জোড় হাতে ভোটের দাবি পেশ করে গণতন্ত্রের চেলাচামুণ্ডারা। বিনামূল্যে কয়েক রাতের গণতান্ত্রিক নেশা পায় নিরক্ষর; গণতান্ত্রিক খাবার পায় ক্ষুধার্ত; গণতান্ত্রিক বস্ত্র পায় অর্ধ উলঙ্গ; গণতান্ত্রিক হুমকি পায় প্রতিরোধকারী।

দুটো নির্বাচনের মাঝে হতাশা আর পতাকার রং ছাড়া আর কী পাল্টায়? তা-ও, তা-ও ভ্রমর ভোট দিয়ে যাবেন— কী নিশ্চিত এ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা! মন্দির, মণ্ডল, মৌলবাদ, মা, মাটি, মার্ক্স, মজুর, মজদুরি, মদ, মাস্টারকার্ড, ম্যাকডোনাল্ড, মার্সেডিজ়— কোন ভোটারকে কোনটা বেশি আকৃষ্ট করছে তা আমরা দেখে নিই রিমোট হাতে। নাগরিক হয় গণনার বিষয়। বুদ্ধিজীবী পায় প্রবন্ধের কাঠামো; সংবাদমাধ্যম পায় উত্তেজক শিরোনাম। ক্ষমতা-দখলের গণতান্ত্রিক ম্যাচ গণমাধ্যমে দিয়ে যায় একের পর এক নেল-বাইটিং-ফিনিশ। হিংসার বিবরণ জাগায় উত্তেজনা।

গণতান্ত্রিক এ দেশে গোধরা, কাঠুয়া, মুজফ্ফরনগর, নন্দীগ্রাম প্রাইম টাইম-এ মডেলদের মতো মঞ্চে হেঁটে দ্রুত হারিয়ে যায় পরের শিরোনামের ঝলমলানিতে। গণতান্ত্রিক শর্ত মেনেই আসারাম ধর্ষণকে সঙ্গম-অধিকার বলেন।

হাজার কোটি টাকা মেরে ধনবান উধাও হয়ে যান ভিনদেশে আর গরিব বেনামি হওয়ার ভয়ে দেশে ফেরে ভোট দিতে।

শাবাস, গণতন্ত্র!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

common people Election Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE