Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
আমরণ অনশন ও নাগরিক সমাজ

দাবি মেটাতে মরণ পণ?

অন্যায় বঞ্চনার প্রতিবাদ করাই তো উচিত। কলেজ-কর্তাদের ত্রুটি কম নয়। যথেষ্ট ঘর নেই, ঘর বিলির নিয়ম মানা হয় না, ভাঙা, নোংরা ঘর। ছাত্রদের অভিযোগে ভুল নেই।

মেডিক্যাল কলেজে অনশন আন্দোলন।

মেডিক্যাল কলেজে অনশন আন্দোলন।

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৮ ০০:১৯
Share: Save:

আন্দোলন মানেই উত্তেজনা। বিশেষত অনশন ধর্মঘট একটা তীব্র অভিঘাত তৈরি করে মানুষের মনে। ‘দাবি মেটাও, প্রাণ বাঁচাও’ এই আকুতি বাড়তেই থাকে। এও ঠিক যে, জাতির মনে যে সব অনশন আন্দোলন গভীর ভাবে দাগ কেটেছে, সেগুলির ন্যায্যতা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। ‘হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বন্ধ হোক’, ‘ব্রিটিশ বন্দির সমান মর্যাদা চাই ভারতীয় বন্দির’, ‘সরকারে দুর্নীতি বন্ধ হোক’। তাই অনশনকে সমর্থনের একটা অভ্যাস তৈরি হয়েই আছে।

মেডিক্যাল কলেজে অনশন আন্দোলন যখন তীব্র আকার নিল, তখন কলকাতা তথা রাজ্যের নাগরিক সমাজ বলল, ‘‘এ ভারী অন্যায়। কেন প্রথম বর্ষের ছাত্ররা ঘর পাবে নতুন হস্টেলে, আর সিনিয়র ছাত্ররা পাবে না?’’

অন্যায় বঞ্চনার প্রতিবাদ করাই তো উচিত। কলেজ-কর্তাদের ত্রুটি কম নয়। যথেষ্ট ঘর নেই, ঘর বিলির নিয়ম মানা হয় না, ভাঙা, নোংরা ঘর। ছাত্রদের অভিযোগে ভুল নেই।

কিন্তু একটি ন্যায্য প্রয়োজনকেও আন্দোলনের দাবি করে তুলতে হলে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যেখানে সকলে যোগ দেয়, নানা পরামর্শ হয়, বিভিন্ন স্বার্থের সংঘাত ও সংশ্লেষ হয়ে তবে কিছু প্রয়োজন, কিছু আক্ষেপ, ‘দাবি’ হয়ে উঠে আসে। যখন তা হয় না, তখন ‘আমাকে না দিয়ে ওকে দিলে না খেয়ে মরে যাব’, এমন বেয়াড়া অভিব্যক্তি হয় দাবির।

মেডিক্যালে এ ভাবে দাবিটা উঠে এল বলে হাজার দেড়েক ছাত্রের সমস্যা, যার সঙ্গে রোগীর ভালমন্দও জড়িত (অন কল ডাক্তার ক্যাম্পাসে ঘর না পেলে ঝুঁকি রোগীরই) তা এমন ‘তুচ্ছ’ মনে হল। লোকে বলল, এত সামান্য কারণে এত ঝামেলা কিসের? ঘর যখন আছে, ওদের দিলেই হয়। ‘ওরা’ যে কারা, কত জন, কারা ‘ওরা’ নয় বলে বাদ পড়তে পারে, তা কিন্তু স্পষ্ট হল না। অথচ সম্পদ (এ ক্ষেত্রে নতুন হস্টেলের ঘর) যখন সীমিত, দাবিদার অনেক, তখন এ প্রশ্নগুলো তোলা দরকার ছিল।

১০ জুলাই বিকেলে যাঁরা অনশন শুরু করেন, দুপুরে তাঁদের কয়েক জনের নেতৃত্বে কিছু সিনিয়র ছাত্র নতুন ভবনে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ছাত্রীদের ঘরগুলিতে তালা দিয়ে দেন। দরজায় রুম নম্বর লেখা কাগজের উপর লিখে দেন, ‘‘যাদের হস্টেল দেননি তারা নিয়ে নিল!’’ সমান অধিকারের ভাষা নয়, জবরদখলের ভাষা। যাদের ঘর ‘দখল’ হল, সেই মেয়েরা কী ভাবছিল? নিরাপত্তা বা স্বাচ্ছন্দ্যের নিরিখে সব চাইতে সমস্যায় যাঁরা, সেই নাগাল্যান্ড বা কেরল থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের কথাও শোনা যায়নি। ভাঙাচোরা, অপরিচ্ছন্ন একটা ঘরও তো তাঁদের অনেকের জোটেনি। তাঁরাও কি ঘরের দাবিতে অনশনে বসার পক্ষপাতী ছিলেন?

‘‘স্বচ্ছ কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে হস্টেল দেওয়া হোক’’, সম্পূর্ণ ন্যায্য দাবি। তা সত্ত্বেও, ডে বোর্ডার তো দূরস্থান, নর্মান বেথুন, গিরিবাবু, বি সি রায়, স্বর্ণময়ী প্রভৃতি হস্টেলের ‘একস্ট্রা বেড’-এর বোর্ডারদের কথা শোনা গেল না। অথচ দলীয় বিভেদ অতিক্রম করে ছাত্র আন্দোলন মেডিক্যাল কলেজে আগে অনেক হয়েছে। ‘‘আমি সবার কথা বলছি’’, এই দাবি যিনি করেন, তাঁকে আগে সবার কথা শুনতে হয়। সবাই কি অনশনকারীদের কাছে নিজের মত জানানোর সুযোগ পেয়েছিলেন?

অনেকে এই আন্দোলনের অন্য এক ন্যায্যতা দেখতে পাচ্ছেন। তা হল গণতন্ত্রে বিরোধীর জায়গা পাওয়ার ন্যায্যতা। কলেজ কাউন্সিলের সদস্যরাও একান্তে বলছেন, তৃণমূল নেতা নির্মল মাজির নির্দেশেই নতুন হস্টেল থেকে দূরে রাখা হয়েছিল সিনিয়রদের। উদ্দেশ্য, প্রথম বর্ষের ছেলেদের উপর দখল কায়েম। ডেমোক্র্যাটিক স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন ছাড়বে কেন? বিরোধীকে এ ভাবেই জায়গা করে নিতে হবে। তোমার পুলিশ, আমার অনশন। যেমন কুকুর, তেমনি মুগুর।

ঠিক কথা। কিন্তু এ রাজনৈতিক বিরোধিতার কথা। নির্বাচনী গণতন্ত্রে বরাবরই প্রবল শাসকের সামনে ক্ষীণবল বিরোধী যুদ্ধ করে, অনেক কষ্ট, নিপীড়ন সহ্য করে জনমত আনে নিজের পক্ষে। সেই তো রাজনীতির লড়াই। ‘‘এই দেখো ওর প্রেশার কমে যাচ্ছে, তোমরা কিছু না বললে ও মরে যাবে’’, এ ভাবে সমর্থন ভিক্ষা করা রাজনীতির লড়াই নয়। দলমত নির্বিশেষে, মানবিকতার নির্দেশে মানুষ যে সমর্থন জানায়, রাজনীতির দানে তাকে তুরুপের তাস করলে সেটা নাগরিকের অপমান। নাগরিক আন্দোলনের অবমূল্যায়ন।

তাই প্রবল অস্বস্তি হয় যখন দেখি যে, আমরণ অনশনকে যে প্রবীণ চিকিৎসকরা ‘যথার্থ পথ’ বলে সমর্থন করলেন, নিজেরা প্রতীকী অনশন করলেন, তাঁদের তিন জন ছিলেন রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের নির্বাচনে নির্মল মাজির বিরোধী প্রার্থী। ধরা যাক, তাঁদের প্রত্যয় অকৃত্রিম। তবু এ-ও সত্য যে, অনশন-প্রসূত নাগরিক উত্তেজনা তাঁদের স্বার্থ পুষ্টি করেছে। অনশনের বিকল্প কেন মিলল না, কেন এত দূর গড়াল অনশন, ভাবতে গেলে এ তথ্যও মাথায় রাখতে হবে।

এ তথ্য জেনেও অনেকে অনশনকারীদের মান্যতা দিয়েছেন। তাঁদের অনেকে রাগে ফুঁসছেন। নেতা-মন্ত্রীদের ‘সবক শেখানো’র ইচ্ছে ষোলো আনা, কিন্তু মুখ খোলার মুরদ নেই। নিজে ঝুঁকি না নিয়ে, ছয় তরুণের প্রাণ বাজি রেখে ‘গরমেন্ট’-কে এক হাত নেওয়া গেল। কী আহ্লাদ!

কিছু নাগরিক কণ্ঠস্বর দাবির ন্যায্যতা নিয়ে নীরব থেকে সবার সুবুদ্ধির কাছে আবেদন করেছে। আলোচনায় সমাধান হোক। কিন্তু তা হয়নি। আলোচনা, শর্তের আদানপ্রদান, কিছুই না। তেরো দিন ধরে যা ছিল ‘না’, এক দিন তা হল ‘হ্যাঁ’।

এটুকুরও মূল্য কম নয়। নাগরিক সমাজ বরাবরই সরকারের প্রতিপক্ষ, রাষ্ট্রক্ষমতার সীমা নির্ণয় করাই তার কাজ। রাষ্ট্র যখন দুর্বিনীত, তখন নাগরিকই তাকে বাধ্য করে কথা শুনতে। কিন্তু সে কাজ করতে গিয়ে যদি নাগরিক কার্যক্রম রাজনীতির খেলার ‘এক্সটেনশন’ হয়ে যায়, সে তো ভয়ানক কথা। একেই রাজনীতিতে শাসক আর বিরোধীর তফাত মুছে যাচ্ছে। ভিন্ন বলতে নেতার নাম। আবেগ খুঁচিয়ে, ভয় দেখিয়ে দলে টানে দু’পক্ষই। এ বার নাগরিকও যদি ‘ইমোশনাল অত্যাচার’-এর চাপ দিয়ে ফল পেতে চায়, তবে তো সর্বনাশ।

নাগরিকের অস্ত্র বিতর্ক। সপক্ষের সমর্থন, বিপক্ষের খণ্ডন, এর মাধ্যমে আবেদনটা করা হয় যুক্তির কাছে। সেই যুক্তি যিনি মানেন, নিজে বঞ্চিত, নির্যাতিত না হলেও তিনি এসে শামিল হন ন্যায্য দাবির আন্দোলনে। এই হল নাগরিক আন্দোলন। মেডিক্যালে দেখা গেল, গোড়ায় চুপচাপ, শেষে ‘গেল গেল’ রব। সন্দেহ হয়, বুঝি পাখিতে খাওয়া পেঁপের মতো, রাজনীতি খেয়ে গিয়েছে নাগরিক বিরোধিতার শাঁসটুকু। তাই দাবির ন্যায্যতা নিয়ে বিতর্কই হল না।

ধরা যাক, প্রথম বর্ষের জন্য আলাদা হস্টেলের প্রশ্নটা। কলেজ কাউন্সিল বলল, মেডিক্যাল কাউন্সিলের তাই নিয়ম। অনশন সমর্থকেরা বললেন, কাউন্সিল বলেছে, ওটা ‘প্রার্থিত’, ‘আবশ্যক’ নয়। মানার দরকার নেই।

কেন? সিনিয়রের পরিচ্ছন্ন থাকার দাবি আছে, আর জুনিয়রের সুরক্ষিত থাকার দাবিটা কিছু নয়? মেডিক্যালে নাকি র‌্যাগিং হয় না। হতে পারে, অশ্লীল নির্যাতন হয় না। কিন্তু রাজনৈতিক দলে টানার কাজটা কি খুব নির্বিষ? মেডিক্যাল কলেজের এক একটা হস্টেল যে এক একটা রাজনৈতিক দলের ‘আন্ডার’-এ তা ওপেন সিক্রেট। ধর্ষকামী আর আনুগত্যকামী, দু’জনেই চায় অন্যে আমায় মানুক, বিনা প্রশ্নে।

অনশনের সমর্থন সেই চাপ-সর্বস্ব সংস্কৃতির সমর্থন হয়ে দাঁড়াল। কী ভাল হল তবে?

‘‘খুব ভাল হয়েছে’’, বললেন মেডিক্যালের তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্র। ‘‘মেন বয়েজ় হস্টেলের পিছনটা আজ সাফ হল। কী নোংরা ছিল!’’

এখানেই ভয়। ভয় এখানেই। এক সময়ে ধর্মঘটও ছিল ব্রহ্মাস্ত্র, যার প্রয়োগে নিরস্ত্র নাগরিক প্রবল রাষ্ট্রকে হার মানিয়েছে। অতি-ব্যবহারে, অপব্যবহারে তা আজ তামাদি হয়েছে। ধর্মঘট ডাকলে লোকে বিরক্ত হয়। আজও অনশন মানুষকে নাড়া দেয়। কিন্তু ‘‘এত বাড়াবাড়ি কেন?’’ কথাটাও শোনা গেল এ বার।

মেডিক্যালে নাকি পাল্টা আন্দোলন করতে অনুগত ছাত্রদের উস্কেছিল তৃণমূল। এ যাত্রা তা হয়নি। কিন্তু সে দিন দূরে নেই। কোনও এক প্রতিষ্ঠানের দুই দল বসবে অনশনে। দু’পক্ষই বলবে, ‘‘ওদের কথা শুনলে আমরা মরব।’’

কী করবে তখন নাগরিক সমাজ?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Hunger Strike Medical College Kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE