চিকিৎসা পদ্ধতি, ওষুধ, প্রযুক্তির প্রয়োগ, সংখ্যাতত্ত্বের যথার্থতা, বিশেষজ্ঞের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন করার সাহস থাকে না জনসাধারণের। মানুষ তাই অপেক্ষায় থাকেন, কবে চিকিৎসা ব্যবস্থার অন্দর থেকেই এ কথা উঠে আসবে। সে রকমই একটি বই স্থবির দাশগুপ্তের ‘স্বাস্থ্য নিয়ে বাদবিসংবাদ’ (আনন্দ পাবলিশার্স, ২০২০)। স্বল্পালোচিত একটি প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছেন তিনি। আমাদের দেশে যে চিকিৎসকেরা তৈরি হচ্ছেন, তা কি চাহিদা মেনে? বছরে যত মানুষ অসুস্থ হন, তাঁদের মাত্র আড়াই শতাংশের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন থাকে। বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, যা গৃহ-চিকিৎসকেরা পূরণ করতেন। ৯৫ শতাংশেরই সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে যাওয়ার দরকার হত না, যদি স্বাস্থ্যশিক্ষার ফ্যামিলি মেডিসিন শাখাটি আকর্ষণীয় এবং পেশা হিসেবে সম্মানজনক হত। স্থবির জানাচ্ছেন, প্রতি বছর আমাদের দেশে যত স্নাতক ডাক্তার তৈরি হন তাঁদের মাত্র ২৩ শতাংশ থেকে যান গৃহ-চিকিৎসক হিসেবে। এ বছর ভারতের ৫৩২টি মেডিকেল কলেজে প্রায় ৭৭ হাজার ছাত্রছাত্রী ডাক্তারি পড়তে ঢুকবে, যার মধ্যে বড় জোর ১৫,০০০ গ্রামাঞ্চলে যাবে প্রাথমিক পরিষেবা দিতে। পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য বিভাগও ফ্যামিলি মেডিসিনে স্নাতকোত্তর শিক্ষাক্রম চালায়, কিন্তু পারদর্শিতা ও গ্ল্যামারের নিরিখে তা বেশ নিচু।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের শিরোনাম: ‘স্বাস্থ্য — প্রবঞ্চনাশিল্প’। স্বাস্থ্য গবেষণার নামে যা চলছে, প্রবঞ্চনার তালিকায় তা শীর্ষে। ২০১৪ সালে ‘দ্য ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল’-এ ২০৪৭টি গবেষণাপত্র দেখিয়ে বলা হয়েছিল, এর প্রায় ৬৭ শতাংশ সন্দেহজনক, মিথ্যাচার, টুকে দেওয়া এবং এক লেখা নানা পত্রিকায় ছাপানো। প্রবঞ্চনার রকমফেরে আছে নতুন নতুন রোগ আবিষ্কারের প্রয়াস। নতুন রোগী বা ওষুধ না হলে প্রাপ্য বাড়বে না! ২০০২ সালে ওই জার্নালেই লেখায় হয়েছিল, কী ভাবে শরীরের অনেক স্বাভাবিক উত্থান-পতন ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। যেমন টাক পড়া অসুখের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে; ‘অস্টিয়োপোরোসিস’ নামে হাড় ভাঙার আশঙ্কার এক নীরব ব্যাধি ‘আবিষ্কৃত’ হয়েছে; ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোমের মতো সাধারণ অসুবিধে ব্যাধির গৌরব লাভ করেছে।
প্রবঞ্চনা-শিল্পের পিছনে ওষুধ শিল্পের বড় ভূমিকা আছে। জনসাধারণের স্বাস্থ্যখাতে খরচের বড় অংশ ওষুধ, কিন্তু তার সঙ্গে আরোগ্যের সমীকরণটি গোলমেলে। লেখক বলছেন, ১৭,০০০ লোক যদি সারা জীবন রক্তচাপের ওষুধ খান, তা হলে স্ট্রোক এড়াতে পারবেন ৫০ জন। ২৫০ জন যদি পাঁচ বছর ধরে ৩ লক্ষ ৫৭ হাজার কোলেস্টেরল কমানোর বড়ি খান, তা হলে এক জন উপকৃত হবেন।” ২০১৬ সালে ইউরোপের বহু স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলতে বাধ্য হয়েছেন যে অনেক নতুন ওষুধে মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন এবং স্বাস্থ্য বাজেট তৈরির সময় সরকার বুঝে উঠতে পারছে না কোন খাতে কত বরাদ্দ দরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রোগ নির্ণয়-চিকিৎসা-নিরাময়ের যে ছ’টি নির্দিষ্ট ধাপের নিদান থাকে, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রযুক্ত হয় না। যা আধুনিকতম তা-ই সেরা— এই প্রচারের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। ১১১ বছরের পুরনো অ্যাসপিরিন আজও নির্বিকল্প।
সংখ্যাতত্ত্ব আরও জটিল। ১২০/৮০ রক্তচাপ কি সবার ক্ষেত্রেই ‘স্বাভাবিক’? লেখক জানাচ্ছেন, বিমা সংস্থাগুলো সাব্যস্ত করেছিল যে সবচেয়ে নিরাপদ রক্তচাপ হল ১২০/৮০। কী ভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞান এই গড় হিসেব স্বাভাবিক বলে মেনে নিল? গড় আর স্বাভাবিক তো এক কথা নয়। এই বিভ্রান্তির সূত্রেই লেখক পৌঁছন আরোগ্যের দর্শনে। চিকিৎসার কলা ও বিজ্ঞানে খণ্ডবাদী দর্শনের প্রয়োগ চিকিৎসকদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আবিল করেছে। আলোচনায় এসেছেন অস্ট্রিয়ান-ক্রোয়েশিয়ান দার্শনিক ইভান ইলিচ, আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের কার্যকারিতা সম্বন্ধে যিনি সন্দেহ পোষণ করেন। লেখক বিখ্যাত চিকিৎসকদের উদ্ধৃত করে বলেছেন, একশো বছরে ডাক্তারি প্রশিক্ষণ যতটা উন্নত হয়েছে, শিক্ষা ততটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে। ১৯৯৩ সালে ইংল্যান্ডের জেনারেল মেডিক্যাল কাউন্সিল জানায়, শিল্প-সাহিত্যের নানা বিষয় ডাক্তারি শিক্ষায় অবশ্যপাঠ্য না করতে পারলে ডাক্তারেরা অশিক্ষিতই থেকে যাবেন।
শেষ পরিচ্ছেদে ভারতের স্বাস্থ্যনীতিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছেন লেখক। স্বাস্থ্য বিমা পুঁজিকে মদত দেয়, তা তিনি বলেছেন। তবে ১৯৪৬ সালে ভোর কমিটির রিপোর্টকে মান্যতা দিয়েও রাষ্ট্র তাকে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেনি, এটা আর একটু স্পষ্ট করতে পারতেন। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শেষে গ্রামীণ এলাকায় ১,৪০,০০০ জন পিছু এবং নগরাঞ্চলে ৩৬,০০০ জন পিছু একটি প্রাথমিক হাসপাতাল তৈরি হয়েছিল। পঞ্চম পরিকল্পনায় স্থির হল যে ব্লক পিছু (১,২৫,০০০ জন) একটি প্রাথমিক হাসপাতাল হবে। আর ১৯৮৩ সালে প্রথম স্বাস্থ্যনীতিতেই সরকার ঘোষণা করল যে ‘অর্থসঙ্কট’-এর কারণে সব চিকিৎসার দায় নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বেসরকারি পুঁজিকে মদত দিয়ে জনসাধারণের ‘সাধ্যানুরূপ’ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে।
‘সাধ্যানুরূপ’ কথাটা সোনার পাথরবাটি। চিকিৎসা পরিষেবা আজও কেন সাধ্যাতীত, তা বুঝতেই পড়া দরকার এই বই।
ভারতীয় প্রশাসনিক সেবার প্রাক্তন আধিকারিক। প্রতীচী ইনস্টিটিউট
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy