Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Sabrimala Temple

এ বার সকলের পরশে পবিত্র

এখন প্রশ্ন হল, যে মন্দিরে হিন্দুদের সঙ্গে বৌদ্ধ, এমনকি মুসলিমদেরও স্থান আছে প্রাচীনকাল থেকেই; সেই ‘অল ইনক্লুসিভ’ মন্দিরে জনন-ক্ষমতাসম্পন্ন মহিলাদেরই প্রবেশ নিষেধ কেন? তবে কি আয়াপ্পা মহিলাদের পছন্দ করেন না? তাঁর পুরুষ ভক্তরা চল্লিশ দিন ধরে স্ত্রীসঙ্গ ত্যাগ করে সাধনা করে মকর সংক্রান্তির দিন আয়াপ্পা সন্দর্শনে যান।

নীলোৎপল বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০১৮ ০০:১৫
Share: Save:

কেরলে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার মধ্যে পেরিয়ার টাইগার রিজ়ার্ভ। সেখানে শবরীমালা মন্দিরে পূজিত হচ্ছেন বাঘে চড়া, তিরধনুক হাতে আয়াপ্পা ঠাকুর। তিনি চির ব্রহ্মচারী কিশোর। তাঁকে হরিহরপুত্র বলে ডাকেন ভক্তরা। কেন? ভস্মাসুর বধের কাহিনি মনে করুন। শিবঠাকুরের বর পেয়ে একবগ্‌গা ভস্মাসুরকে বাগে আনতে বিষ্ণুর মোহিনীবেশ ধারণ ও বুদ্ধিবলে ভস্মাসুর নাশ। কিন্তু মোহিনীরূপ দেখে আদিপুরুষ শিব কামাতুর। পরস্পরের মোহনমিলনে জন্ম নিলেন আয়াপ্পা। কেরল, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ পর্যন্ত কোথাও আয়াপ্পা, কোথাও বা আইয়ানার নামে পূজিত হন ইনি, শৌর্যবীর্যের দেবতা হিসেবে। ও দিকে বৌদ্ধরা আয়াপ্পাকে পুজো করেন ধর্মশাস্তা হিসেবে। বৌদ্ধশাস্ত্রেও এঁকে শিব ও বিষ্ণুর সন্তান বলেই মনে করা হয়। বাঘে চড়া হিন্দু দেবতা বৌদ্ধদের সিংহলে গিয়ে হয়ে যান হাতিতে চড়া বীরপুরুষ। তবে কেরলের কিছু মুসলিম এঁকে ভীষণ শ্রদ্ধা করেন। শবরীমালার পাহাড়ে ওঠার মুখেই আছে বাবরস্বামীর মসজিদ। ওপরে উঠে আয়াপ্পা স্বামীর মন্দিরের পাশেও রয়েছে মুসলিম বাবরস্বামীর মন্দির এবং সেখানে অর্চনা করেন এক জন মুসলিম। কথিত এই যে, আরবে মুসলিম ধর্মের প্রচারের ৬০০ বছর পর আরব থেকে বাবর নামে এই সাধু কেরলে আসেন এবং আয়াপ্পা স্বামীর ভক্ত হয়ে যান। কাহিনিতে পাই, পান্তালাম রাজ্যের রাজা ছিলেন নিঃসন্তান। এক সন্ন্যাসীর কথায় জঙ্গলে গিয়ে তিনি আয়াপ্পাকে খুঁজে পান ও মণিকান্ত নাম দিয়ে সন্তান হিসেবে বড় করেন। পরে রাজার এক বিকলাঙ্গ শিশু জন্মায়। মণিকান্ত ওরফে আয়াপ্পার বারো বছর বয়সে তাঁকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করার সময় মন্ত্রীরা বাধা দেন ও রানিকে নিজেদের দলে টানেন। রানি দুরারোগ্য রোগের ভান করে বলেন বাঘের দুধ খাওয়ালে তাঁর রোগ সারবে। মনে রাখতে হবে, রাজ্যটি পেরিয়ার টাইগার রিজ়ার্ভে এবং বারো বছরের কিশোরকে বাঘের দুধ আনতে পাঠালে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, অতএব রানির নিজের গর্ভের সন্তানের সিংহাসনলাভ শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু বীর আয়াপ্পা বাঘিনির পিঠে চেপে দুধ নিয়ে আসেন, এবং ছেলের মধ্যে দিব্যগুণের প্রকাশ পেয়ে বাবা ছেলের এক মন্দির গড়ে তোলার ইচ্ছা প্রকাশ করলে ছেলে দূরে একটি তির নিক্ষেপ করেন এবং সেই স্থানটিতেই বর্তমানে আয়াপ্পার মন্দির বলে ভক্তদের বিশ্বাস। এই ঘটনাটি মকর-সংক্রান্তিতে ঘটেছিল বলে ওই সময়টিতেই এই মন্দিরে এশিয়ার মধ্যে সব চেয়ে বেশি ভক্তের ভিড় হয়ে থাকে। যা-ই হোক, বাঘের দুধ আনার পর আয়াপ্পা আত্মপ্রকাশ করেন এবং ব্রহ্মচারী হয়ে শবরীমালা পাহাড়ে তপস্যার জন্যে চলে যান। ব্রহ্মচর্য নষ্ট হওয়ার ভয়ে সন্তানধারণে সক্ষম মহিলাদের এই মন্দিরে প্রবেশে বাধা থাকলেও কেরলেরই অন্য জায়গায় পরশুরাম-প্রতিষ্ঠিত আয়াপ্পার মন্দিরে তাঁর দুই পাশে দুই স্ত্রী পূর্ণা এবং পুষ্কলা উপবিষ্টা, সঙ্গে আয়াপ্পাপুত্র সত্যক। কিছু কিছু পুরাণে পাওয়া যায় মহিষাসুরকে মা দুর্গা বধ করলেও তার স্ত্রী মহিষীকে জলের মধ্যে বধ করেন ধর্মস্বরূপ আয়াপ্পা। আবার মধ্যযুগের কাহিনিতে দেখা যায়, উদয়নন বলে এক শত্রুকে পরাজিত করতে বাবর নামের মুসলিম রাজার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন আয়াপ্পা। তাঁদের বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ বাবরস্বামী আয়াপ্পার দ্বারদেবতা রূপে পূজিত হন। আবার কেউ কেউ বলেন মণিকান্ত অর্থাৎ আয়াপ্পার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন এই বাবরস্বামী। তাঁদের বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ তাঁরা এক সঙ্গে পূজিত হন। কতখানি ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হলে দু’জন এক জায়গায় পূজিত হন চির-বিবদমান দুই ধর্মের প্রতিনিধি হয়েও?

এখন প্রশ্ন হল, যে মন্দিরে হিন্দুদের সঙ্গে বৌদ্ধ, এমনকি মুসলিমদেরও স্থান আছে প্রাচীনকাল থেকেই; সেই ‘অল ইনক্লুসিভ’ মন্দিরে জনন-ক্ষমতাসম্পন্ন মহিলাদেরই প্রবেশ নিষেধ কেন? তবে কি আয়াপ্পা মহিলাদের পছন্দ করেন না? তাঁর পুরুষ ভক্তরা চল্লিশ দিন ধরে স্ত্রীসঙ্গ ত্যাগ করে সাধনা করে মকর সংক্রান্তির দিন আয়াপ্পা সন্দর্শনে যান। আর এক হরিহরপুত্র হনুমানজিও চির-ব্রহ্মচারী। আর ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দির, ভারতের সব লিঙ্গের রাজা, সে মন্দিরে পূজা হয় বেলপাতা তুলসীপাতা দিয়ে। মঙ্গলবার হনুমানজির পূজাও বেল-তুলসী দু’রকমের পাতা দিয়ে হয়। আয়াপ্পা আর হনুমানজি দু’জনই শৌর্যবীর্যের প্রতীক অথচ ঠিক ‘আলফা মেল’ নন, বেশ একটা পেলবতা রয়েছে দু’জনের মধ্যেই। তবে রহস্য কী? ৩৭৭ ধারা বাতিল হয়েছে। মৌলবাদী হিন্দুরা বলছেন সমকামিতা পাশ্চাত্যের প্রভাব। শিব-মোহিনীর মিলন তবে কী?

যা-ই হোক, এত দিন শবরীমালার আয়াপ্পা মন্দির ভারতের সম্মিলনের, সংশ্লেষের প্রতীক ছিল, কিন্তু সত্যিকারের সবার পরশে পবিত্র হয়ে উঠতে পারেনি। আদালতের রায়ে আয়াপ্পা স্বামীর মন্দির সত্যিকারের মহামানবের সাগরতীরে উপনীত হল। দেবতার পছন্দ যা-ই হোক, ভক্তের প্রেমপথে সব বাধা দূর হল। মানুষের জয় হল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sabrimala Temple Supreme Court
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE