Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

রেলের গতির দায় কেন নিতে হবে বন্যপ্রাণকে, ভাবা জরুরি

জঙ্গলে রেলের গতি কমানোর উদ্দেশ্যই ছিল বন্যপ্রাণের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। গতিবৃদ্ধির ভাবনা তাই ভাবাচ্ছে। লিখছেন অরিন্দম সাহারেল কর্তৃপক্ষকে এই গুরুত্বের কথা আগেও মানতে হয়েছে। খাতায়-কলমে অন্তত।

ডুয়ার্সের জঙ্গল রুটে তৈরি করা রেলপথের ৭৪ কিলোমিটার এলাকাই জাতীয় উদ্যান, অভয়ারণ্য এবং বাঘ-প্রকল্পের এলাকার ভিতরে যা ‘এলিফ্যান্ট করিডর’ নামে পরিচিত।

ডুয়ার্সের জঙ্গল রুটে তৈরি করা রেলপথের ৭৪ কিলোমিটার এলাকাই জাতীয় উদ্যান, অভয়ারণ্য এবং বাঘ-প্রকল্পের এলাকার ভিতরে যা ‘এলিফ্যান্ট করিডর’ নামে পরিচিত।

শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৯ ০৪:০৮
Share: Save:

১৯৭৪ সালে তৈরি ডুয়ার্সের জঙ্গল রুটে ট্রেনের গতিবেগ কত হবে, তা নিয়ে আলোচনা আগেও বহু বার হয়েছে। কারণ, জঙ্গল চিরে তৈরি করা এই রেলপথের ৭৪ কিলোমিটার এলাকাই জাতীয় উদ্যান, অভয়ারণ্য এবং বাঘ-প্রকল্পের এলাকার ভিতরে। ওই রুটের কয়েক কিলোমিটার ব্যবধানেই রয়েছে হাতিদের চলাচলের রাস্তা, যা ‘এলিফ্যান্ট করিডর’ নামে পরিচিত। যার জেরেই গতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও বাড়তি গুরুত্ব পায়।

রেল কর্তৃপক্ষকে এই গুরুত্বের কথা আগেও মানতে হয়েছে। খাতায়-কলমে অন্তত। পরিবেশপ্রেমীদের বক্তব্য, বিকেলের পর থেকে দৃশ্যমানতা ক্রমশ কমতে থাকার কারণে সন্ধের পর থেকে ডুয়ার্সের বনপথে গতি কমানোর বিষয়টি বাড়তি গুরুত্ব পায়। অথচ, ওই রুটেই গতি বাড়ানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে রেল। তা জানাজানি হওয়ার পর থেকেই প্রতিবাদের সুর চড়েছে। পরিবেশপ্রেমীদের অনেকেই রেলের ভাবনার বিরোধিতায় সরব হয়েছেন। যদিও রেলের তরফে যুক্তি দেওয়া হয়, গত দু’বছরের পরিসংখ্যানে ট্রেনের ধাক্কায় বন্যপ্রাণীর মৃত্যুর সংখ্যা কমে গিয়েছে। কিন্তু ধুবরি-শিলিগুড়ি টাউন ট্রেনের ইঞ্জিনের ধাক্কায় হাতিমৃত্যুর ঘটনার পর গতি বাড়ানোর ভাবনা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক দানা বাঁধছে।

পরিবেশপ্রেমীরা বটেই, আমজনতার অনেকেও বলছেন, যে কারণে বনপথে গতি কম রাখা, সেই রুটে ট্রেনের গতি বাড়ালে সমস্যা হবেই, আরও বেশি বিপন্ন হবে বন্যপ্রাণ। কার্যত, বন্যপ্রাণ সুরক্ষার এই সহজপাঠটি রেলকর্তারা যত দ্রুত বোঝেন, ততই মঙ্গল বন্যপ্রাণের। পরিবেশপ্রেমীদের অনেকের দাবি, ওই রুটে রেলের গতিবেগ ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটারের বেশি হওয়া কোনও ভাবেই কাম্য নয়। বিশেষ পরিস্থিতি ও সময়ে কোনও বাফার জোনে তা আরও নিয়ন্ত্রণ করার কথা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘণ্টায় ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও রেল তা মানতে নারাজ। এই চাপানউতোরের মধ্যে ট্রেনের গতি বাড়ানোর ওই প্রস্তাবনা অনেককেই অবাক করেছে।

সব মিলিয়ে তরজাও বেড়েছে রীতিমতো। বন দফতর আগেই জানিয়েছে, গতি বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে আগাম কোনও আলোচনা হয়নি। কিছুদিন আগে অবশ্য রেলের সঙ্গে একটি বৈঠকে ওই ব্যাপারে অবস্থানের কথা বন প্রশাসনের কর্তারা জানিয়ে দেন। সেবক ও গুলমার মধ্যে দু’টি করে স্থান চিহ্নিত করে গতি বাড়ানোর প্রস্তাবও ওই বৈঠকে নাকচ করে দেয় বন দফতর। বন দফতরের দাবি, গত কয়েক বছরে ডুয়ার্সের মরাঘাট থেকে চালসার রেল সেতু, বক্সা থেকে রাজাভাতখাওয়ার জঙ্গলে ট্রেনের ধাক্কায় হাতির মৃত্যুর নানা ঘটনা রয়েছে। পরপর ওই ঘটনার পরে বনপথে ট্রেনের গতি কমানোর দাবি জোরালো হয়েছিল। সে সব বেমালুম ভুলে গেলে কী করে চলবে, সেই প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটাও তাই নানা মহলে উঠছে।

তা ছাড়া, ১৯৭৪ সালে ওই রেলপথ তৈরির সময় ছিল মিটার গেজ লাইন। তখন তা দিয়ে যাতায়াত করত শুধুমাত্র মালগাড়ি। পরে ওই পথে শুরু হয় যাত্রিবাহী গাড়ির চলাচলও। পরিবেশপ্রেমীদের একাংশের দাবি, ১৯৭৪ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে ওই রুটে ট্রেনের ধাক্কায় ২৭টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। ব্রড গেজ লাইন হতেই হাতির মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাই রেলের নয়া পরিকল্পনায় নতুন করে চিন্তিত হয়েছেন পরিবেশপ্রেমীরা।

স্থানীয় মানুষজনও পরিবেশপ্রেমীদের মতোই চাইছেন, বন্যপ্রাণ সুরক্ষা বিশেষ গুরুত্ব পাক। লাইনের উপর ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে থাকা একটিও রক্তাক্ত হাতিকে যেন আর দেখতে না হয়! উত্তরবঙ্গের এক জঙ্গল থেকে অন্য জঙ্গল চষে বেড়ানো পাঁচশোরও বেশি হাতিকে রেলের চাকায় পিষে যাওয়া থেকে, ইঞ্জিনের ধাক্কায় টুকরো হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করা যাবে কী করে, সে ভাবনায় ভাবিত হতেই হবে। তা না হলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ক্ষমা করবে না। দায় এড়িয়ে পার পাওয়াও যাবে না। বন্যেরা বনে সুন্দরই থাকুক, নির্ভয়ে থাকুক অাগের মতো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE