Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
শুজাতের মতো মধ্যবাদীদের সরিয়ে দিলে সব পক্ষেরই বড় সুবিধে

এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ

গত কয়েক বছরে এ ধরনের কথা অনেক বার বলেছেন শুজাত, অনেক এমন ছবি তৈরি হতে দেখেছেন চোখের সামনে। তফাত কেবল এইটুকু যে আজ ছবিটার মধ্যে উনি নিজেই ঢুকে গিয়েছেন।

বিদায়: শুজাত বুখারির অন্ত্যেষ্টিতে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন অগণিত নাগরিক। ক্রিরি, বারামুলা, জম্মু ও কাশ্মীর। ১৪ জুন। ছবি: পিটিআই।

বিদায়: শুজাত বুখারির অন্ত্যেষ্টিতে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন অগণিত নাগরিক। ক্রিরি, বারামুলা, জম্মু ও কাশ্মীর। ১৪ জুন। ছবি: পিটিআই।

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৮ ০০:১০
Share: Save:

এই ছবিটা দেখলে শুজাত বুখারি বলতেই পারতেন: এমন মৃত্যু-মিছিলই আমার দেশ, আমার উপত্যকা। গত কয়েক বছরে এ ধরনের কথা অনেক বার বলেছেন শুজাত, অনেক এমন ছবি তৈরি হতে দেখেছেন চোখের সামনে। তফাত কেবল এইটুকু যে আজ ছবিটার মধ্যে উনি নিজেই ঢুকে গিয়েছেন। কফিনে ঢুকে। মৃত্যু-মিছিলে নিজেকে তিনি সামিল করে নিয়েছেন, বাক্যটি তাই আজ আরও বেশি করে তাঁর নিজের। কোনও দিন নবারুণ ভট্টাচার্যের নাম শোনেননি হয়তো, কিন্তু তাঁর বইয়ের নামটা একটু ঘুরিয়ে নিয়ে বলতেই পারতেন শুজাত।

মৃত্যুর আগে শুজাতের শেষ টুইটগুলির একটি ছিল, ‘‘কাশ্মীরে আমরা সাংবাদিকতা করি পূর্ণ আত্মসম্মানের সঙ্গে, মাটির সঙ্গে প্রতি মুহূর্ত পুরোপুরি যোগ রেখে চলি।’’ শুজাত আমার বন্ধু ছিলেন, পেশাগত ও ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল বেশ নিয়মিত, কিন্তু এই টুইটগুলি দেখলাম তিনি চলে যাওয়ার পরই। দেখে ভারী আশ্চর্য হলাম— এই তো, কেন যে তাঁকে আজ এ ভাবে কফিনে ঢুকতে হল, সেটা তো তবে উনি নিজেই বলে গিয়েছেন পরিষ্কার! গুলিতে ঝাঁজরা হওয়ার ছবি নেট-টিভি-কাগজে দেখে অনেকেই শিউরে উঠে বলছেন, কেন, কেন এক জন সাংবাদিককে এমন ভাবে মারা হল? তাঁদের সকলকে ভাল করে টুইটটা পড়তে বলি। পড়তে পড়তে তাঁরাও দেখবেন, টুইট-চিরকুটের মধ্যে আস্তে আস্তে আলোর মতো ফুটে উঠছে অস্পষ্ট আঁকাবাঁকা কতগুলো রেখা, আমাদের সকলকে অজ্ঞানতার আড়ালে রেখে যে সব রেখা প্রতিনিয়ত নানা ভয়ঙ্কর শক্তিবিন্দুকে সংযুক্ত করে চলে। ওই শক্তিরা চায়, কাশ্মীরের সাংবাদিক জগৎ যেন তাদের (কারও-না-কারও) অধিগত এবং অধীন থাকে, তাদের স্বার্থ অনুযায়ী লেখালিখি করে, সেই মতো তথ্য-তত্ত্ব নির্মাণ, প্রসার ও প্রচার করে। ওরা চায়, কাশ্মীরের মাটির সঙ্গে যেন সমাজের নেতৃস্থানীয় মানুষের যোগ না থাকে। তবেই কেবল মানুষের নাম করে অন্যায়-অনাচার-অত্যাচার ওরা চালিয়ে যেতে পারে। অথচ, শুজাতের মতো সাংবাদিকরা যে তার ঠিক উল্টো কাজটা করেন। ‘সত্যি’টাকে খুঁজে বার করতে চান তাঁরা, বার করতে জানেনও। কেন যেন কিছুতেই মানুষকে তাঁরা দাবা-লুডোর ঘুঁটি ভাবতে পারেন না, রক্তমাংস আনন্দবেদনা মিলনবিরহসঙ্কটে গড়া এক একটা আস্ত জীবন বলে ভাবেন। কী করে তবে শুজাতদের না মেরে থাকবে ওরা? ভয় দেখালেও যাঁরা ভয় পান না, কেন তাঁদের বুক এফোঁড়-ওফোঁড় হবে না?

‘পূর্ণ আত্মসম্মান’-এর সঙ্গে কাজ করেন বলেই ভারত সরকার, তার সেনাবাহিনী, রাজ্য সরকার, আজ়াদ কাশ্মীর সমর্থক, পাকিস্তান, পাক-সমর্থিত উগ্রবাদী এবং গোপন জঙ্গি সংগঠন, কাউকে সমালোচনা করতে ছাড়তেন না শুজাত। বিভিন্ন প্রসঙ্গে প্রাঞ্জল ফুটিয়ে তুলতেন এই প্রত্যেকটি পক্ষের ইচ্ছা বা সঙ্কল্পের ন্যূনতা, সঙ্কীর্ণতা, অসারতা, মানবাধিকার বিষয়ে তাদের চরম ঔদাসীন্য। মানবাধিকার? মানুষের কথা যদি এদের কেউ গুরুত্ব দিয়ে ভাবত, সাত দশক ধরে সাধারণ কাশ্মীরির জীবন কি এমন দুর্বিষহ হয়ে থাকত? কোনও একটা সমাধানের পথ কি বেরোত না? আসলে সমাধানে আসার চেষ্টাটা করলে সঙ্কটটা আর সঙ্কট থাকে না। সঙ্কটের ধুয়ো তুলে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধ করা যায় না। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বিপন্ন, মুসলিম জঁহা বিপন্ন, মানুষকে এই সব বোঝানোটা মুশকিল হয়ে যায়। শুজাত বুখারিরা সমাধানের দিকে এগোতে চেয়ে এই সঙ্কট জিইয়ে রাখার কাজটা কঠিন করে দেন। তাঁদের মডারেট বা মধ্যবাদী কণ্ঠস্বর সমানে প্রমাণ করার চেষ্টা করে— মধ্যবাদ বলেও একটা অবস্থান হয়, ‘মডারেশন’ বা বোঝাপড়া বলেও একটা বস্তু এই দুনিয়ায় আছে। সঙ্কট মিটিয়ে নেওয়া যায় সেই বোঝাপড়া দিয়ে। কেন তাঁদের বাঁচতে দেবে সঙ্কট-পন্থীরা?

২০১৬ সালে জঙ্গি যুবা বুরহান ওয়ানি নিধনকে কেন্দ্র করে সব পক্ষের তাণ্ডব চলল উপত্যকায়, তার মাস কয়েক পর তাঁর অন্যান্য লেখার সঙ্গে এই পত্রিকার উত্তর-সম্পাদকীয় প্রবন্ধেও লিখেছিলেন শুজাত— জঙ্গিরা একটা ভয়ঙ্কর পথ জানে, হত্যা-হিংসা-তাণ্ডব দিয়ে মানুষের জীবনের ধারাটাকে কী ভাবে এলোমেলো করে দেওয়া যায়। যে পথটাকে পরে তিনি নাম দেবেন ‘বুলেট টু বুলেট’। যখন মানুষের মনে শান্তির সুদূর সম্ভাবনা সবে উঁকি মারছে, ঠিক সেই মুহূর্তে সবটাকে ভেঙেচুরে রক্তে-হতাশায় অস্থির করে দিতে পারে তারা। উপত্যকাবাসী মানুষ জঙ্গিদের কখনও ভয় পায়, কখনও সহানুভূতির চোখে দেখে। কিন্তু সব কিছুর মধ্যেও তারা নিজেদের সামলেসুমলে দূরত্ব রেখে চলে। শুজাতের মনে হয়েছিল, এত কাণ্ডের পরও মাঝের সেই জায়গাটা হারায়নি, যেখানে বিপরীত পক্ষের সঙ্গে একটা স্বাভাবিক ‘ডায়লগ’ তৈরি করা সম্ভব, ওই খোলা সামাজিক মনটারই সৌজন্যে। কথাটা নিশ্চয়ই খুশি করেনি রক্তবাদীদের। কেনই বা তারা ক্ষমাসুন্দর হবে শুজাতদের প্রতি?

যতই ডায়লগ-এর অবকাশ থাকুক না কেন, শুজাতরা তো জানতেন, জানেন, যাদের লক্ষ্য করে কথাটা বলা, তারা মোটেই ডায়লগ চায় না। তারা বরং এই মাঝখানের যেটুকু-যা পরিসর, সেটাকে সবলে সমূলে ধ্বংস করে দিয়ে আক্রমণ হানতে চায়, তাঁর পরবর্তী লেখার ভাষায়, ‘বুলেট টু পেলেট’। গত কয়েক বছর ধরে শুজাত অনবরত লিখেছেন এবং বলেছেন যে, দিল্লি যদি কাশ্মীরকে একটা রাজনৈতিক সঙ্কট হিসেবে না দেখে কেবলই সামরিক পথে এগোতে চায়, সর্বনাশ আরও দ্রুত বাড়বে। গত ২০ মে নরেন্দ্র মোদীর কাশ্মীর সফরের রকম দেখে নিজের সম্পাদিত সংবাদপত্র ‘রাইজ়িং কাশ্মীর’-এ ২৫ মে তিনি সম্পাদকীয় মন্তব্য লিখলেন: ‘‘দিল্লি মাস্ট ট্রিট কাশ্মীর অ্যাজ় আ পলিটিক্যাল প্রবলেম’’, এবং মোদী ‘‘এগেন মিসড দ্য পয়েন্ট পলিটিক্যালি।’’ বছরখানেক আগে মোদী বলেছিলেন, কাশ্মীরিদের সামনে মাত্র দুটো পথ খোলা, টুরিজ়ম অথবা টেররিজ়ম। এই ছেলে-ভোলানো ‘মোদী-ইজ়ম’ দিয়ে যে কাশ্মীরের মানুষের এত কালের রাজনৈতিক দাবিদাওয়া উড়িয়ে দেওয়া যাবে না, একটা বোঝাপড়ায় আসতেই হবে— শুজাত বুখারিরাই তো বার বার সে কথা বলেছিলেন। তার পরও তাঁদের বাঁচিয়ে রাখা যায়?

গত এক মাস রমজানের কারণে কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি চলছিল। রাজনৈতিক কারণে তা ঘোষণা করতে হলেও দেশের সামরিক পক্ষ যে তাতে খুশি ছিল না, সেটা জলবৎ স্বচ্ছ। আর, পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিকে কী চোখে দেখে, সেটা তো গত মাসের নিরন্তর জঙ্গি-আক্রমণেই পরিষ্কার, ঠেকাতে চাইলে সীমান্তের ও-দিক থেকে তা অবশ্যই ঠেকানো যেত। এই পরিস্থিতিতে মধ্যবাদটাকে সরিয়ে দিলে সব পক্ষেরই সর্বাঙ্গীণ সুবিধে। ‘যে জন আছে মাঝখানে’, তাঁদের যদি সরিয়ে দেওয়া যায়, কী পড়ে থাকে দুই দিকে? পড়ে থাকে কেবল চরম দুই পক্ষ। অঙ্কটা তখন ভারী সহজ: এ যুদ্ধের কোনও বিরতি সম্ভব নয়, যুদ্ধবিরতির কথা কেউ ভুলেও তুলো না।

আর মধ্যবাদকে ‘ভ্যানিশ’ করতে হলে শুজাতের মতো ভয়ডরহীন যুক্তিবাদী স্পষ্টভাষী সাংবাদিক-সম্পাদকের চেয়ে ভাল লক্ষ্য আর কে-ই বা? শুজাতরাই তো জনমনের সন্ধান করেন। জনমনে প্রভাব ফেলেন। মাটির সঙ্গে যোগ রাখেন।

বিদায় শুজাত। বেঁচে থাকতে যা কিছু বলা-ভাবা-লেখা— মৃত্যু যে কী ভাবে মুহূর্তমধ্যে তাকে অনেক গুণ বেশি অর্থবহ করে তুলতে পারে, আরও এক বার তার উদাহরণ পেলাম আমরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Shujaat Bukhari Journalist Murder Rising Kashmir
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE