Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

অপবাদের শক্তি

লোকনিন্দার অপার শক্তি। নূতন কথা নহে, চিরকালই নিন্দা-অপবাদ অপরের আচরণ নিয়ন্ত্রণের সেরা অস্ত্র।

—প্রতীকী ছবি।

—প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

লোকনিন্দার অপার শক্তি। নূতন কথা নহে, চিরকালই নিন্দা-অপবাদ অপরের আচরণ নিয়ন্ত্রণের সেরা অস্ত্র। কিন্তু যখন এক ছাত্রী ও তাহার স্কুলের মধ্যে বাধা হইয়া দাঁড়ায় প্রতিবেশীর লোকনিন্দা, তখন সমাজকে সক্রিয় হইতেই হইবে। গড়বেতার স্কুলছাত্রী নিজের বিবাহ রুখিয়া পড়াশোনা চালাইবার সিদ্ধান্ত লইয়াছে। তাহার দরিদ্র মা-ও মেয়েকে পড়াইতে সম্মত হইয়াছেন। কিন্তু একটি মেয়ে নিজের বিবাহ নিজে ভাঙিয়াছে, এই ভয়ানক ঘটনা প্রতিবেশীদের উত্তেজিত করিয়া তুলিয়াছে। তাহাদের বাক্যবাণে মেয়েটি ঘর ছাড়িয়াছে। নূতন আবাসের দূরত্ব স্কুল হইতে তিন কিলোমিটার, তাই পড়াশোনা বন্ধ হইতে বসিয়াছে। মনে হইতে পারে, একটি মেয়ে বিবাহ না করিয়া পড়াশোনা করিবে, তাহাতে কাহার কী ক্ষতি? তলাইয়া দেখিলে স্পষ্ট হয়, ঝুঁকি ভয়ানক। মেয়েরা আপন সিদ্ধান্তে নিজের জীবন নির্ধারণ করিবে, তদপেক্ষা ভয়ঙ্কর আর কী হইতে পারে? মেয়েদের জীবন ও সম্পদ নিয়ন্ত্রিত করিবে পরিবার তথা সমাজ, ইহাই দস্তুর। মেয়েদের স্বাধীন সিদ্ধান্ত তাই সমাজের নিকট স্পর্ধিত বিরোধিতা বলিয়া মনে হয়। বিবাহের পাত্র বা সন্তানধারণের সময় মেয়েরা স্বয়ং স্থির করিতে চাহিলে তাই নিন্দার বন্যা বহিয়া যায়।

প্রতিটি বিষয়ে যেখানে মেয়েদের ইচ্ছাকে প্রতিহত করা হয়, সেখানে এক কিশোরীর বিবাহ না করিবার স্বাধীন সিদ্ধান্ত সম্মান করিবে কেন? রাষ্ট্র বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করিয়া আইন করিয়াছে, কন্যাশিক্ষার প্রকল্প করিয়াছে। পণপ্রথাও নিষিদ্ধ, কন্যাভ্রূণ হত্যা দণ্ডনীয়, বধূনির্যাতন গুরুতর অপরাধ। তাহাতে কী? হিংসা-বিদ্বেষের প্রাবল্যে মেয়েদের প্রতিরোধ খড়কুটার ন্যায় ভাসিয়া যায়। কখনও কখনও সংগঠন গড়িবার প্রয়াস হয়। ‘কন্যাশ্রী যোদ্ধা’ কিংবা ‘মীনা মঞ্চ’ তাহারই উদাহরণ। তাহাতে কিছু সাফল্যও আসে। সংবাদে প্রকাশ, মীনা মঞ্চ নানা জেলায় বেশ কিছু বালিকাবিবাহ প্রতিহত করিয়াছে। কিন্তু স্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদা আদায় করিবার পথ দীর্ঘ ও জটিল, তাই এই সব সংগঠন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বালিকা পাচার রোধে কিশোরীদের সংগঠন বিশেষ ফলপ্রসূ হয় নাই, গার্হস্থ্য হিংসা প্রতিরোধে মহিলা সংগঠনগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যর্থ। তাহার অন্যতম কারণ, ক্ষমতাসীন নেতারা প্রকাশ্যে নারীসুরক্ষার নূতন নূতন প্রকল্প ঘোষণা, এবং গোপনে সাবেকি পুরুষতন্ত্রকে তোয়াজ করিয়া চলেন। পঞ্চায়েত যদি বাস্তবিকই বালিকা বিবাহের বিরোধিতা করিত, তবে পশ্চিমবঙ্গ বাল্যবিবাহমুক্ত হইত। তাহা হয় নাই বলিয়া জেলায় জেলায় কিশোরীদের থানার শরণ লইতে হইতেছে।

তাহাতেও রক্ষা নাই। আইনের চোখে যে নারীহিংসায় অপরাধী, পুরুষতন্ত্রের বিচারে সে নির্দোষ। কারণ পুরুষ নিগ্রহ করিবে, এবং নারী তাহা সহিবে, ইহাই নিয়ম। ধর্ষক জামিনে মুক্তি পাইয়া ঘুরিয়া বেড়াইবে, তাহার হুমকিতে এবং সমাজের অপবাদে ঘর ত্যাগ করিবে ধর্ষিতা। পাচারকারী মুক্ত থাকিবে, যৌনদাসত্বে বন্দি মেয়েটি ঘরে ফিরিতে পারিবে না। গড়বেতায় সেই চিত্রনাট্যেরই পুনরভিনয় হইল। বিবাহ ভাঙিবার নিন্দার তাড়নায় বালিকা ঘর ছাড়িল। বালিকাকে বিবাহেচ্ছু পুরুষটির বিরুদ্ধে একটি বাক্যও কেহ উচ্চারণ করে নাই। কেনই বা করিবে? নারীর কুৎসা রটাইয়া যে সুখ, পুরুষনিন্দায় সে সুখ নাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE