Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বিশ্বকাপের লীলা

যিনি সিরিয়াল লইয়া দিব্য আহ্লাদে রহিয়াছেন, তাঁহাকেও চা দিতে আসিয়া সন্তানকে জিজ্ঞাসা করিতে হইতেছে, সাদা রঙের জার্সি পরিয়া হা-রে-রে-রে-রে-রে ওই কাহারা আসিতেছে গোল ছেড়ে?

শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৮ ০০:৫০
Share: Save:

বিশ্বকাপ আসিয়া কত আলোড়ন যে উৎপাদন করিয়াছে! প্রথমত, সমাজে ঝাঁক-মানসিকতার জয়জয়কার চলিতেছে। যাহার কোনও কালে ফুটবলের প্রতি ন্যূনতম উৎসাহ ছিল না, তাহাকেও মুখরক্ষার্থে অহরহ খোঁজ লইতে হইতেছে, আর্জেন্টিনা কী করিল, ব্রাজ়িলেরই বা কী দশা। যিনি সিরিয়াল লইয়া দিব্য আহ্লাদে রহিয়াছেন, তাঁহাকেও চা দিতে আসিয়া সন্তানকে জিজ্ঞাসা করিতে হইতেছে, সাদা রঙের জার্সি পরিয়া হা-রে-রে-রে-রে-রে ওই কাহারা আসিতেছে গোল ছেড়ে? তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ লইয়া থাকিবার অধিকার রহিয়াছে এবং নিজ ইচ্ছা অন্যের উপর চাপাইয়া দিবার অধিকারও কাহারও নাই, কিন্তু বাস্তব প্রায়ই তত্ত্বের ধার ধারে না। স্বতন্ত্র থাকিয়া অধিকাংশ মানুষই স্বস্তি লাভ করে না, কোনও না কোনও স্তরে তাহার স্বীকৃতির প্রয়োজন হয়। তাই ভান করিয়াও দলে মিশিয়া যাইতে পারিলে, সকলের সহিত সমান চিৎকার করিয়া ‘আমি তোমাদেরই লোক’ প্রমাণ করিতে পারিলে, মানুষ সবিশেষ তৃপ্তি পায়। হয়তো তাহার সাধনা অনন্য নহে, নিছক অন্য হইয়া থাকা। ইহার পর আসিতেছে সমর্থনের প্রধান দল বাছিয়া লইবার দায়। কেহ যদি বলে, কে জিতিল তাহা লইয়া কী আসে যায়, খেলা কেমন হইল তাহাই আসল— তবে তাহাকে নিতান্ত বেরসিক ধরা হইবে। বাংলায় আবার ঐতিহ্য রহিয়াছে, ব্রাজ়িল বা আর্জেন্টিনার প্রবল পক্ষ লইবার। এমন একটি ধারণা এই রাজ্যে প্রচলিত, লাতিন আমেরিকার দলগুলির খেলায় শিল্পের স্পর্শ সমধিক, ইউরোপীয় দলগুলি নান্দনিকতা অপেক্ষা কার্যকারিতার প্রতি মনোযোগী। তাই যে জাতি চিরকাল জিতিবার পরিবর্তে সৌকর্য ঝলকাইয়া হারিয়া যাওয়াকে মহিমান্বিত করিয়াছে, সে লাতিন আমেরিকার দলকেই সমর্থনের জন্য বাছিবে, আশ্চর্য কী?

সীমার মাঝে অসীমের ব্যাপারটিও গুরুত্বপূর্ণ। সকলে জানে, ফুটবল দলগত খেলা, এগারোটি খেলোয়াড় মিলিয়া মাঠে যুদ্ধ করিতে হয়, রণকৌশল নির্ণয়ে ভূমিকা থাকে কোচ ও তাঁহার সহকারীগণেরও। কিন্তু কৃতিত্ব বা দোষারোপের ক্ষেত্রে, চিরকাল বাছিয়া লওয়া হয় একটি মুখকেই। সাধারণত যে কোনও বৃহৎ কাণ্ড ফলবতী বা নিষ্ফলা হয় বহু মানুষের অবদানে ও পারস্পরিক সহায়তার ব্যাকরণে। কিন্তু সাধারণ মানুষের নিকট কোনও আন্দোলন, কোনও খেলা, কোনও গোষ্ঠীবদ্ধ প্রয়াসের বিশ্লেষণ ধারণায়ত্ত হয় না, যত ক্ষণ না একটি বা দুইটি ব্যক্তিকে সে গতিবিধির জন্য দায়ী করিতে পারিতেছে। যদি আর্জেন্টিনা পরাজিত হয়, তাহার জন্য একা মেসি দায়ী, যদি বিপ্লব সফল হয় তাহার জন্য একা লেনিন কৃতিত্বাধিকারী। নিঃসন্দেহে একটি বা দুইটি ম্যাচে এক জন ফুটবলার একাই রং ঘুরাইয়া দিতে পারেন, কিন্তু সমগ্র বিশ্বকাপটিকে যখন মারাদোনা বা পেলে বা রুমেনিগের বিশ্বকাপ বলিয়া চিহ্নিত করা হয়, তাহার মূলে থাকে ইচ্ছাকৃত খণ্ডদর্শন। আবার, প্রতিষ্ঠিত মহানায়ককে ছাড়িয়া যখন কেহ অন্যদের অবদান বিষয়ে সরব হন, তিনিও বাছিয়া লন এক জন বা দুই জন ‘কাব্যে উপেক্ষিত’কেই। সচিন-সৌরভের ছটায় ‌ম্লান হইয়া যাওয়া দ্রাবিড়ের নামই বারংবার উচ্চারিত হয়, তাঁহার অপেক্ষা কম গ্ল্যামারদীপ্ত কাহাকেও লইয়া আলোচনা করা হয় না। আসলে, সেতু বাঁধিবার কৃতিত্ব রামেরই হইবে, তাজমহল গড়িবার গৌরব শাহজাহানেরই রহিবে, তন্নিষ্ঠ কাঠবিড়ালি বা নকশাকার কারিগর শ্রমিকদের কথা কেহ মনে রাখিবে না। ইহার নেপথ্যে অবশ্য কোনও চক্রান্ত নাই, এই মনোভাবের মূলে আছে নায়কপূজার প্রকাণ্ড ঈপ্সা, আর সিন্ধু দেখিয়া ঘাবড়াইয়া গিয়া বিন্দুর মধ্য দিয়া তাহাকে বুঝিবার প্রয়াস।

তবে বিশ্বকাপের মূল উপযোগিতা হইল, এই কয়েক দিন সকল দুশ্চিন্তা ভুলাইয়া দেওয়া। এই ধরনের যে কোনও হুজুগই মানুষকে বাস্তব ভুলাইয়া রাখে। তাহার দেশের দুরবস্থা, নিরীহ মানুষকে ছেলেধরা সন্দেহে পিটাইয়া মারিবার ঘটনা, এনজিও-র মহিলাদের গণধর্ষণের আখ্যান, গৃহস্থের ইএমআই শোধ করিবার বিপন্নতা, সকলই ছাইয়া বিশ্বকাপের সানন্দ কলরব কিছু দিনের জন্য আকাশ-বাতাস ভরিয়া রাখিবে। ক্রীড়া ও নানা উৎসবের আরোপিত আনন্দের উদ্দেশ্যই তাহা: নিজেকে চক্ষু ঠারিয়া দৈনন্দিন গ্লানি হইতে মুক্তি। এই বৎসর আইপিএল যাইল, বিশ্বকাপ আসিয়াছে, দুর্গাপূজাও অদূরে। আশা করা যায়, বিবিধ অন্যায়দীর্ণ এই দেশে আরও এই রূপ হুল্লোড় আসিয়া তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাগুলিকে ক্রমান্বয়ে ঢাকিয়া দিতে থাকিবে।

যৎকিঞ্চিৎ

সাধারণত মাঠে বা পার্কে দেখা যায়, কারাটে শিখছে কচিকাঁচার দল। এখন অবশ্য নিগ্রহ থেকে বাঁচতে বহু কিশোরী বা যুবতীও মার্শাল আর্ট শিখছেন। কিন্তু বাংলায় এ জিনিস শেখা সবচেয়ে দরকার বুড়োবুড়িদের। ছেলেমেয়ে নিত্য পেটাবে, খেতে দেবে না, বেড়ালছানার মতো ঘাড় ধরে রাস্তায় স্টেশনে গাছতলায় ফেলে দিয়ে আসবে, তা রোখা যাবে কী করে? বেধড়ক ফিরতি-রদ্দা ও দড়াম লৌহঘুষি কষালে, ছোটবেলার মতোই, সুড়সুড়িয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বাধ্য সন্তান বনে যাবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

World Cup West Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE