Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
‘মানবতা’র হত্যাকাণ্ড

ইয়েমেনের ভয়ঙ্কর সঙ্কট কিন্তু চোখে পড়ছে না বিশ্বের

জামাল খাশোগি প্রাক্তন সৌদি সরকারি সাংবাদিক। অনেকে তাঁকে মহান সংস্কারক বলে চালানোর চেষ্টা করলেও তিনি আসলে রক্ষণশীল সৌদি বাদশাহির খুব কাছের লোক ছিলেন। কিন্তু খাশোগি প্রবল প্রতিপত্তিশালী নব্য ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করতে শুরু করলে রাজকুমারের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ান।

রক্ত-হাতে: সাংবাদিক জামাল খাশোগির নিখোঁজ হওয়ার বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদীরা। ওয়াশিংটন, অক্টোবর, ২০১৮। রয়টার্স

রক্ত-হাতে: সাংবাদিক জামাল খাশোগির নিখোঁজ হওয়ার বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদীরা। ওয়াশিংটন, অক্টোবর, ২০১৮। রয়টার্স

বন্যা আহমেদ
শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৮ ০১:০০
Share: Save:

নাহ্, কোনও কারণেই সৌদি আরবে মারণাস্ত্র বিক্রি বন্ধ করা যাবে না, এটা করে অযথাই নিজেকে শাস্তি দেব নাকি? আমেরিকা না বেচলে পুতিন বা জিনপিং ঠিকই অস্ত্রবিক্রির সুযোগটা হাতিয়ে নেবে...’’

সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে তুরস্কের সৌদি দূতাবাসের ভেতর খুন করে তাঁর শরীর হাড্ডি কাটার করাত দিয়ে কেটে (তুরস্কের সরকারি ভাষ্যমতে) গুম করে ফেলার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সৌদি আরবে আমেরিকার অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করা হবে কি না জানতে চাইলে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যা বলেন তার সারমর্মটা মোটামুটি এ রকমই দাঁড়ায়।

আর এই কারণেই কখনও কখনও ট্রাম্পের কথা শুনলে আমার ভালও লাগে। উনি যে রকম অনায়াসে তিলকে তাল করতে পারেন, ঠিক তেমনই আমেরিকার পেশাদার রাজনীতিকরা যে কথাগুলো মুখে বলার সাহস করেন না, সেগুলোও অনায়াসে বলে দিতে পারেন। তিন মিনিট পরে সেই কথাটাই যে আবার উল্টে যাবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই, কিন্তু মাঝে মাঝে আকাট সত্যিটা বলে যে দেন তাতেই এক ধরনের স্বস্তি হয়। অন্তত আজকের সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের ভিত্তি বা চালিকাশক্তিটা যে কী, সেটা নিয়ে রাখঢাকের চাদরটা খসে পড়ে!

এ জায়গায় বারাক ওবামা হলে কয়েকটি গালভরা আদর্শের কথা বলতেন। সৌদি আরবকে কী ভাবে শাস্তি দেওয়া যায় সেটা নিয়ে সাতকাহন করে আমেরিকার ‘মহান’ বিদেশ নীতির জয়গান করতেন, কয়েক মাস হয়তো হাই প্রোফাইল কিছু মিটিং বন্ধ রাখতেন, কংগ্রেসেও হয়তো একটা নামমাত্র বিল পাশ করিয়ে নিতেন নিন্দা জানিয়ে। আমরাও আধুনিকোত্তর বিবেকের দংশন থেকে মুক্তি পেতাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, ট্রাম্প যা করছেন ওবামাও ঠিক তা-ই করতেন। তাঁদের সব চেয়ে কাছের মিত্র হিসেবে সৌদি আরবের কাছে আমেরিকার শত শত কোটি ডলারের আধুনিক অস্ত্র বিক্রিটা অব্যাহত রাখতেন। ট্রাম্প প্রায়শই এত সবের তোয়াক্কা করেন না। অর্থনৈতিক স্বার্থের উপরে কোনও কথা নেই, টাকা এবং ক্ষমতাই সব, একশো দশ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির চুক্তির সামনে কোনও এক খাশোগি কেন, যে কোনও খুনই যে তুচ্ছ— সাফ সাফ এই কথাগুলো বলে দিতে মোটেও লজ্জিত নন তিনি। কারণ যাঁদের ভোটে উনি ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরাও একই নীতিতে বিশ্বাসী।

জামাল খাশোগি প্রাক্তন সৌদি সরকারি সাংবাদিক। অনেকে তাঁকে মহান সংস্কারক বলে চালানোর চেষ্টা করলেও তিনি আসলে রক্ষণশীল সৌদি বাদশাহির খুব কাছের লোক ছিলেন। কিন্তু খাশোগি প্রবল প্রতিপত্তিশালী নব্য ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করতে শুরু করলে রাজকুমারের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ান। আর, এমবিএস (মোহাম্মদ বিন সালমান) সামান্য কোনও বিরোধিতাও সহ্য করতে পারেন না, পথের কাঁটা তিনি যে কোনও উপায়ে সরিয়েই ছাড়েন। তাই খাশোগি ২০১৭ সালে প্রাণভয়ে সৌদি আরব থেকে আমেরিকায় পালিয়ে যান। তিনি আমেরিকার বড় কাগজে লেখালিখি করতেন, ওয়াশিংটন ডিসি এবং লন্ডনের বহু নাম করা রাজনীতিবিদ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা। ২ অক্টোবর তিনি ইস্তানবুলের সৌদি দূতাবাসে ডিভোর্সের কাগজপত্র আনতে গেলে সেখানেই সৌদি আরব থেকে পাঠানো ১৫ জনের এক স্পেশাল ‘কিলিং স্কোয়াড’ তাঁকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করে।

খাশোগির খুন নিয়ে পশ্চিম দুনিয়ায় রীতিমতো হট্টগোল পড়ে গিয়েছে। খাশোগির হাই প্রোফাইল বন্ধুরা এবং প্রিন্স সালমানের জাতিশত্রু তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান এত হইচই শুরু করেছেন যে, অনেক পণ্ডিতই মনে করছেন সৌদি রাজকুমারের আরশ বুঝি এ বার টলে উঠল। অথচ গত তিন বছর ধরে ইয়েমেনের যত্রতত্র অত্যাধুনিক বোমারু বিমান হামলা এবং কৃত্রিম অর্থনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টির মাধ্যমে সৌদি আরব ইয়েমেনে যে অমানবিক বিভীষিকার জন্ম দিয়েছে, সেটার দিকে আমাদের ‘সভ্য’ বিশ্বের নজর কী ভাবে যেন এড়িয়ে গিয়েছে।

পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতি জটিল। এক দিকে তেলের রাজনীতি; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চিন, ব্রিটেন, ফ্রান্সের প্রভাব বিস্তার এবং অস্ত্র বিক্রির প্রতিযোগিতা; আর অন্য দিকে সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে ক্ষমতা বিস্তারের লড়াই। ঠান্ডা যুদ্ধ-পরবর্তী সাম্রাজ্যবাদী টানাপড়েন তো আছেই; শিয়া, সুন্নি এবং ইহুদিদের তিক্ত জাতিগত দ্বন্দ্ব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল। আর এ সব ক্ষেত্রে ধর্ম ব্যাপারটার উপযোগিতা ঐতিহাসিক ভাবেই খুব কার্যকর। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বা অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের উপর একটা ধর্মীয় তকমা লাগিয়ে দিতে পারলেই ব্যাপারটা খুব সহজে অন্য মাত্রায় নিয়ে যাওয়া যায়।

তবে ইয়েমেনের এই হুথি বিদ্রোহের সারকথাটা হয়তো এ ভাবে বলা যায়— বিশ্বের সব ধনী এবং প্রভাবশালী দেশগুলোর মতোই সৌদি আরবও বহু দিন ধরেই তার দক্ষিণে অবস্থিত আরব বিশ্বের সব চেয়ে গরিব দেশ ইয়েমেনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কলকাঠি নেড়ে আসছে। কিন্তু সংখ্যালঘু শিয়া জায়দিরা নব্বইয়ের দশকে ইয়েমেনের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে, যারাই আবার পরে হুথি বিপ্লবী নামে পরিচিত হয়।

স্থানীয় সুন্নি সরকার এবং সৌদি আরব মূলত একে ইরানের শিয়া প্রভাব বিস্তারের চক্রান্ত এবং শিয়া-সুন্নি ধর্মযুদ্ধ বলে অভিহিত করলেও হুথি বিদ্রোহীদের দাবি, তাঁরা জাতিগত নিপীড়ন, দুর্নীতি, সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র-সহ সব সাম্রাজ্যবাদী চক্র এবং তাঁদের পুতুল সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন। নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু হলেও ২০০৪ সালে এই বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে। ২০১৪ সালে বিদ্রোহীরা ইয়েমেনের তদানীন্তন রাজধানী দখল করে নিলে সৌদি এবং যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত তথাকথিত ‘বৈধ’ সরকার এবং হুথি বিদ্রোহীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে।

এখনও পর্যন্ত হাজার হাজার সাধারণ ইয়েমেনি নাগরিক মৃত্যুবরণ করেছেন সৌদি এবং আরব আমিরাতের যৌথ বোমা হামলায়। লক্ষ লক্ষ ইয়েমেনি তাঁদের বাসস্থান থেকে উৎপাটিত হয়েছেন। এক পুরনো হিসেব অনুযায়ী দশ হাজার ইয়েমেনির মৃত্যু হয়েছে বলে খবর এলেও রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং যুদ্ধবিশেষজ্ঞদের মতে মৃতের সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার ছাড়িয়েছে। বিমান হামলা থেকে হাসপাতাল, জেলখানা, অন্ত্যেষ্টি, বিয়ের অনুষ্ঠান কিছুই বাদ যাচ্ছে না। সৌদি আরব আধুনিক বিশ্বের সব মানবাধিকার আইনকে কলা দেখিয়ে ইচ্ছে করেই এগুলো টার্গেট করছে বলেও খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ সব হামলায় যে যুক্তরাষ্ট্রের এবং বিলাতি অস্ত্র ও ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা নিয়েও সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।

এখানেই শেষ নয়। ইয়েমেনে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ চলছে। আশি লক্ষ মানুষ আপৎকালীন খাদ্য সাহায্যের ভরসায় বেঁচে আছেন। দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সংখ্যা অচিরেই এক কোটি আশি লক্ষ অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার অর্ধেকে পৌঁছতে পারে। কুড়ি লক্ষ শিশু অনাহারে, অপুষ্টিতে ভুগছে। গত বছর কলেরার মহামারি ছড়িয়ে পড়ে দেশব্যাপী, প্রায় এগারো লক্ষের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন।

এই দুর্ভিক্ষের কারণ খাদ্য সঙ্কট নয়। সৌদি আরব এবং তার সুন্নি আরব কোয়ালিশন ইয়েমেনের তথাকথিত ‘বৈধ’ সরকারের সঙ্গে মিলে সর্বাধুনিক বোমা হামলার পাশাপাশি এক কৃত্রিম অর্থনৈতিক যুদ্ধেরও সূচনা করেছে। দেশে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি তৈরি করা হয়েছে, হুথি বিপ্লবীদের অধিকার-করা জায়গাগুলোতে (যেখানে ইয়েমেনের বেশির ভাগ নাগরিক বসবাস করেন) সরকারি চাকুরেদের বেতন দেওয়া বন্ধ হয়েছে। বিশাল জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা প্রায় শূন্যের কোঠায় এসে ঠেকেছে। সঙ্গে যুদ্ধকবলিত সারা দেশে দেখা দিয়েছে চরম দুর্নীতি এবং বিশৃঙ্খলা। ফলে দেশটি খুব সহজেই জঙ্গি তৈরির কারখানাতে পরিণত হয়ে উঠছে।

ইয়েমেনের নির্মম হত্যাকাণ্ড আমাদের বিশ্ব-বিবেকের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে, কারণ সাধারণ ইয়েমেনি জনগণ জামাল খাশোগির মতো নামজাদা নন, পৃথিবীর অভিজাত ও ক্ষমতাবান শ্রেণির সঙ্গে ওঠাবসাও নেই তাঁদের। কারণ, এই সাধারণ মানুষের খুনের মধ্যে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কর্ণধারেরা খাশোগির খুনের মতো নিজেদের জীবননাশের হুমকির অনুরণন শোনেন না, তাই তাঁরা এ নিয়ে সরব হওয়ার তেমন প্রয়োজনও বোধ করেন না। এটাই আমাদের একুশ শতাব্দীর ‘মানবতা’। তাই ট্রাম্প যখন বুক ফুলিয়ে বলেন যে কোনও খুনের চেয়ে কর্পোরেট আমেরিকার অস্ত্রখাতের মুনাফা এবং চাকরি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তখন দীর্ঘশ্বাসমিশ্রিত এক ধরনের স্বস্তি এসে ভর করে।

লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এ গবেষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE