Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
দায় এড়াতে দোষারোপ করলে লাভ হয় না

আত্মসমীক্ষা এখন জরুরি

এটা খুবই সত্যি যে, দুর্ঘটনা কখনও বলে-কয়ে আসে না। অকস্মাৎ এসে ছন্দপতন ঘটায়। কিন্তু অশুভের আশঙ্কা বোঝা গেলে সতর্ক হওয়া যাবে না, এমনটাও নয়। বিপদের আঁচ পেলে তা আটকানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার মধ্যে যা আছে তা হল বাস্তববোধের প্রকাশ।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:৩৯
Share: Save:

পর পর দু’টি বড় অঘটন। প্রথমে মাঝেরহাটে সেতু ভাঙল, তার বারো দিন পরেই জ্বলে খাক হয়ে গেল বড়বাজারের বাগড়ি মার্কেট। সেতুভঙ্গে প্রাণ গিয়েছে কয়েক জনের। বাগড়ি-কাণ্ডে কাউকে জীবনের মাসুল দিতে না হলেও আর্থিক ক্ষতি বিপুল। সেই সঙ্গেই ভাগ্য পুড়েছে সেখানকার ব্যবসায়ীদের, এবং যে সাধারণ কর্মীরা সেখানে কাজ করেন, তাঁদের। ওই কর্মচারীরা কে কী ভাবে পরিবারের মুখে অন্ন জোটাবেন, কে জানে! শারদোৎসব এ বার তাঁদের অনেকের ঘরেই অন্ধকার হয়ে থাকবে। মালিকদেরও অবশ্যই দুর্দিন।

এটা খুবই সত্যি যে, দুর্ঘটনা কখনও বলে-কয়ে আসে না। অকস্মাৎ এসে ছন্দপতন ঘটায়। কিন্তু অশুভের আশঙ্কা বোঝা গেলে সতর্ক হওয়া যাবে না, এমনটাও নয়। বিপদের আঁচ পেলে তা আটকানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার মধ্যে যা আছে তা হল বাস্তববোধের প্রকাশ। অথচ বার বার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে সেখানেই। ফলে সেতু ভেঙে বিপর্যয় হোক, বা আগুন লেগে ছারখার— সবেতেই ঘটনার পরে জানা যাচ্ছে যে, বিপদ সেখানে ওত পেতেই ছিল। শুধু যাঁদের দেখার কথা, তাঁরা চোখ বন্ধ করে ছিলেন! এটা কখনওই বাঞ্ছনীয় পরিস্থিতি হতে পারে না। যাঁরা দায়িত্বের শীর্ষে, দায়ভার তাঁদের নিতেই হবে।

বড়বাজারে আগুনের কথাই ধরুন। এর আগেও বার বার বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়েছে রাজ্যের ব্যস্ততম তথা ঘিঞ্জিতম এই বাণিজ্য-এলাকা। যত বার আগুন লাগে, তত বার দেখতে পাওয়া যায়, বিশাল এই অঞ্চলটি কতটা বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। অগ্নিসুরক্ষা, বাড়িগুলির বাসযোগ্যতা, সব কিছুই ন্যূনতম মাত্রার তলায়। কিন্তু অগ্নিযুদ্ধ মিটলে ভস্মে ঘি ঢালার মতো সেই সব পর্যবেক্ষণ বিফলে যায়। শুধু তা-ই নয়, এখানকার ব্যবসায়ীদের ‘স্বার্থরক্ষা’ করতে গিয়ে বার বার বিভিন্ন অন্যায়, অনিয়মের সঙ্গে কার্যত আপস করার পথ নেন আইন ও প্রশাসনের রক্ষকরা। শাসকদের মুখ বদলায়, রং বদলায়। বড়বাজার বদলায় না। বাগড়ি-কাণ্ড তারই সাম্প্রতিকতম উদাহরণ।

একটু পিছন ফিরে দেখা যাক। বড়বাজারের মনে রাখার মতো অগ্নিকাণ্ডগুলির মধ্যে মনোহরদাস কাটরার ঘটনা অন্যতম। ১৯৯৫ সালের এপ্রিলে এক রবিবারের দুপুরে আগুন লেগেছিল পাইকারি কাপড়ের বৃহত্তম বাজারটিতে। দমকলের পঞ্চাশটি ইঞ্জিন দিনভর আগুন নেভাতে ব্যর্থ হওয়ার পরে রাতে নামানো হয় সেনা। সাহায্যে আসে বিমানবাহিনী। জ্যোতি বসু তখন মুখ্যমন্ত্রী। মেয়র তাঁরই দলের প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায়।

আজকের মতো সে দিনও দেখা গিয়েছিল, গোটা এলাকাটি জতুগৃহ হয়ে আছে। সঙ্কীর্ণ পথ দমকলের অগম্য। বাজারে নিজস্ব অগ্নিসুরক্ষার ব্যবস্থা থাকা তো দূরস্থান, জলাভাব প্রকট। হাইড্র্যান্টও শুকনো। সেই সঙ্গে ওখানেও ছিল মালিকানা নিয়ে নানা গোলমাল, আইনি জটিলতা ইত্যাদি। ফলে ব্যবসা চলত যথেচ্ছাচারে, এবং সব মিলিয়ে যা হওয়ার ছিল, সেই সর্বনাশই হয়েছিল।

খেলা জমল এর পরে। তখনকার পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য ঘটনার দু’দিন পরেই মহাকরণে বসে ঘোষণা করলেন, মাস্টারপ্ল্যান করে বড়বাজারের সব পাইকারি বাজার ও গুদামগুলিকে হাওড়ার কোনায় সরিয়ে নেওয়া হবে। সেখানে ট্রাক টার্মিনাল তৈরি হয়ে গেলে সকল পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে কাজে হাত দেওয়া হবে বলে ঠিক করেছে সরকার।

কিন্তু পর দিনই আলিমুদ্দিনে বসে সিপিএম-এর সেই সময়ের রাজ্য সম্পাদক শৈলেন দাশগুপ্ত তাঁদের সরকারের অভিপ্রায় ফুৎকারে উড়িয়ে বললেন, ‘‘বড়বাজার সরানো অত সোজা কাজ নয়!’’ ভাবনার সেখানেই ইতি। আজ পর্যন্ত।

ঠিক। বড়বাজারকে সরানো হয়তো সহজ কাজ নয়। জতুগৃহে পরিণত হওয়া মহাকরণকে নবান্নে সরিয়ে নেওয়ার দৃঢ়তা দেখাতে পেরেছেন ‘পরিবর্তন’-এর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তা-ও এক অসাধ্যসাধন! কিন্তু বড়বাজারকে সরিয়ে নেওয়া তার চেয়ে ঢের কঠিন। কেন, তা তাঁর থেকে ভাল আর কে জানেন! অতএব সে প্রসঙ্গ থাক।

তা বলে নিরাপত্তার নিয়মগুলি তাঁদের মানতে বাধ্য করাও কি খুব কঠিন কাজ? নিয়ম না মানলে ব্যবসা করা যাবে না— এটা জোর করে বলার হিম্মত শাসকদের থাকবে না কেন? কেন নিয়ম না-মানা পর্যন্ত ব্যবসা চালানোর সুযোগ পাবেন তাঁরা? পরিহাস এই যে, রুজি-রোজগারের মতো ‘মানবিক’ কারণের দোহাই দিয়ে তাঁদের ক্রমাগত ব্যবসা চালিয়ে যেতে দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে।

১৯৯৫-এর পরে বড়বাজারে আরও একটি উল্লেখযোগ্য অগ্নিকাণ্ড ২০০৮-এ নন্দরাম মার্কেটে। তখনও এক বার বড়বাজারের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে দমকল, পুরসভা ও পুলিশ সবাই কাজে নেমেছিল। দমকলের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, আপৎকালীন অগ্নি-সুরক্ষার কিছুমাত্র বন্দোবস্ত বড়বাজারে নেই। দগ্ধ নন্দরামের বারো তলার করিডরে তো একটি ডিজ়েলের ড্রাম পড়ে থাকতেও দেখা গিয়েছিল। সিঁড়ির করিডরগুলি ছিল মালপত্রে ঠাসা। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে সেই নন্দরাম মার্কেট আজ কিছুটা ভুল শুধরেছে। কিন্তু অন্যরা?

স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীই এখন বলছেন, বড়বাজারে একটা দমকল ঢোকার জায়গা পর্যন্ত নেই। মান্ধাতার আমলের বহুতল বাড়িগুলির ভিতরে এবং বাইরে যাতায়াতের পথ মালপত্র রেখে রুদ্ধ। সেই সঙ্গে দাহ্য জিনিসপত্রের অবাধ মজুত। ঘরে-বাইরে দলা পাকিয়ে ঝুলছে তারের কুণ্ডলী। জানতে ইচ্ছে করে, নন্দরামের ঘটনার দশ বছর বাদেও পরিস্থিতি বদলালো না কেন? দমকলের রিপোর্টে তো তখনও এই সব বিপদের দিকগুলি দেখানো ছিল। তা হলে? অর্থ পরিষ্কার— কোনও রিপোর্ট, কোনও সতর্কবার্তা কেউ এত দিন কানেই তোলেননি। প্রশাসনের ভূমিকাও ছিল নির্বিকার।

মুখ্যমন্ত্রী আঙুল তোলার পরে শহরের মেয়র তথা দমকলমন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায়ও এখন বলছেন, এ সব চলতে দেওয়া হবে না। প্রশ্ন সেই একই। চৈতন্যোদয়ে কি এত দিন লাগে? একের পর এক সুপারিশ এবং নির্দেশ কেন পালিত হয়নি?

শোভনবাবুর অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা সুবিদিত। তিনি জানেন, আইনের গণ্ডিতে বেঁধে কাকে কোথায় কী ভাবে ঘাড়ে ধরে নিয়ম মানাতে হয়। তাঁর আমলে বড়বাজারের ক্ষেত্রে দমকল এবং পুরসভার বিধি সর্বদা লঙ্ঘিত হতে থাকলে সেটা শোভন হয় না।

এখানেই শেষ নয়। ২০১০ সালে স্টিফেন কোর্টে ভয়াবহ আগুনের পরে শহরে অগ্নিকাণ্ড-প্রবণ বলে চিহ্নিত একগুচ্ছ বাড়ির ব্যবসায়ীদের লেট ফি মকুব করে ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়াও দৃষ্টিকটু। মানুষের নিরাপত্তা যেখানে ঝুঁকির মুখে, সেখানে শুধু ব্যবসায়ীদের ‘স্বার্থ’ দেখা হবে কেন?

একই ভাবে মাঝেরহাট সেতু ভাঙার পরে রাজ্যের বিভিন্ন সেতুর বেহাল অবস্থা যে ভাবে সামনে আসছে, তা পূর্তমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের পক্ষেও গৌরবের নয়। এমনকি মাঝেরহাট সম্পর্কে আগাম জানা সত্ত্বেও কেন সময়ে ব্যবস্থা হয়নি, কেন এই ঘটনার অন্তত দুই মাস আগেও বিভিন্ন ব্রিজ মেরামতির জন্য খোদ পূর্ত সচিবের জরুরি নোট উপযুক্ত গুরুত্ব পায়নি— এ সবের দায় মন্ত্রী এক কথায় ঝেড়ে ফেলতে পারেন কি? কর্মদক্ষতায় তিনিও কিন্তু কারও চেয়ে কম নন। তাই দফতর জানলেও মন্ত্রী কিছুই জানতেন না— এমন যুক্তি সাধারণ মানুষকে সহজে গেলানো শক্ত।

তবু বলব, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এ সব এঁটে ধরার পরে শোভন-অরূপও নিশ্চয় এ বার শক্ত মুঠিতে লাগাম ধরবেন। যে কোনও দুর্ঘটনার পরেই দোষারোপের পালা চলে। চলুক। তবে সব চেয়ে জরুরি হল আত্মসমীক্ষা। যা এগোনোর সহায়ক।

দায়িত্বশীলদের ভাবতে হবে, তাঁরা সবাই নিজেদের কাজ ঠিকঠাক করছেন তো? দোষ চাপানো বা দায় এড়ানোর পথ ছেড়ে ঠিকঠাক আত্মসমীক্ষাই পারে আর একটি মাঝেরহাট বা বাগড়ি-কাণ্ডের আশঙ্কা নির্মূল করতে। আমরা সেটাই চাইব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Calamities Liability Self Examination
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE