Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
সাক্ষাৎকার

‘খেটে খাই, চুরি করি না,’ এই অহঙ্কারটাই নেই

একটা পরিবারে বাবা জেঠা কাকা যদি দুর্নীতিকে দুর্নীতি বলে মনে না করে, তা হলে ছেলেপুলেরা কী শিখবে? অফিসার থেকে মন্ত্রী থেকে দলে দলে দুর্নীতিতে ডুবে আছে, সেটাই স্বাভাবিক বলে মেনে নিচ্ছে, এর প্রভাব তো পড়বেই। বললেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়একটা পরিবারে বাবা জেঠা কাকা যদি দুর্নীতিকে দুর্নীতি বলে মনে না করে, তা হলে ছেলেপুলেরা কী শিখবে? অফিসার থেকে মন্ত্রী থেকে দলে দলে দুর্নীতিতে ডুবে আছে, সেটাই স্বাভাবিক বলে মেনে নিচ্ছে, এর প্রভাব তো পড়বেই। বললেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

আপনার ‘তৃতীয় অঙ্ক, অতএব’ নাটকে একটি উক্তিতে আপনি শেক্সপিয়রকে ব্যবহার করে বলেছেন, ‘দ্য টাইম ইজ আউট অব জয়েন্ট...’ কথাটা এই মুহূর্তের পশ্চিমবঙ্গে খুব ধাক্কা দেয়। এ-দল, ও-দল, এই সরকার, ওই সরকার, এ-সবের মধ্যে একেবারেই যাচ্ছি না, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির পক্ষে সময়টা সত্যিই খুব ছন্নছাড়া। কেন এমন হল? বাঙালি তার মানসিকতায় সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে বলেই কি তার এই পরিণতি?

বাঙালি কিন্তু দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের বাঙালিরা পৃথিবীর সর্বত্র নিজেদের জায়গা তৈরি করে নিয়েছে। সেখানে, তাদের মধ্যে কোনও সংকীর্ণতা নেই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির ভিউপয়েন্ট কিছুটা সংকীর্ণ হয়ে গেছে, এটা মানতেই হবে। এর মধ্যে হয়তো একটা কূপমণ্ডূকতা আছে। এটা আগেও ছিল, প্রাদেশিকতায় বাঙালি আগেও ফার্স্ট হত। তবে এখন সেটা আরও বেড়েছে বলে মনে হয়।

এর পিছনে কি একটা অহঙ্কার কাজ করে আসছে?

বাঙালি চিরকালই উন্নাসিক। যখন সে নানা দিক থেকে পিছিয়ে পড়ল, তখন ওই উন্নাসিকতাই তার একটা আশ্রয় হয়ে দাঁড়াল। ইতিহাসে দেখেছি, এই যে একটা হেরো জাত, তাদের একটা ভয়ানক পাল্টা অভিমান জন্মায়। আমাদেরও বোধহয় সেই অভিমান থেকে সংকীর্ণতাবাদ আসছে। বাঙালি যেন অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে কতকগুলো ঢালের পিছনে আত্মরক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সবচেয়ে বড় ঢাল হলেন রবীন্দ্রনাথ। যে কোনও বিষয়ে বাঙালি বলে, ‘আমাদের রবীন্দ্রনাথ আছেন।’ আমি বলি, তুমি কী করো? রবীন্দ্রনাথ তো বাঙালিকে বড় করেই ভেবেছিলেন। তুমি কি সে-রকম চেষ্টা করেছ? রবীন্দ্রনাথ সর্ব অর্থেই এক জন ইন্টেলেকচুয়াল। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে পালিয়ে বেড়াতেন, কিন্তু কী বিরাট পড়াশোনা! শুধু জীবনস্মৃতি পড়লে দেখা যাবে, ওই কয়েক বছরের মধ্যে তিনি যা পড়াশোনা করেছেন, লোকে এমএ ক্লাসেও পড়ে না।

জানার স্পৃহাও কমে গেছে। তাই না?

শুধু শিল্প, সংস্কৃতির চর্চার কথা তো নয়, সব কিছুরই তো চর্চা হওয়া দরকার। বিজ্ঞানের চর্চা দরকার। সে চর্চা আসতে দেরি হয়েছে। অনেক দিক থেকে বাধা এসেছে। ঔপনিবেশিক আমলেও বাধা ছিল। গোঁড়ারা পছন্দ করত না। সাহেবরা নিজেরাও অবশ্য পছন্দ করত না, তারা চেয়েছিল কেরানি তৈরি করতে, ব্যস; বাঙালির বিজ্ঞানচর্চায় তারাই বাধা দিয়েছে। পরেও আমরা এ বিষয়ে যথেষ্ট উৎসাহ দিতে পারিনি। বিজ্ঞানের মেধার স্ফূর্তি হয়নি, অথবা অন্যত্র চলে গেছে, কারণ এখানে সুযোগ নেই। বিজ্ঞানচর্চার দুর্বলতা মানসিক সংকীর্ণতা বৃদ্ধির একটা বড় কারণ। এবং তার পাশাপাশি ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সংস্কারের আধিপত্য। সেই আধিপত্য কিন্তু বাঙালির মানসলোকে বরাবরই প্রবল। মনে রাখতে হবে, বিদ্যাসাগরকে বাঙালি ক্ষমা করেনি। ব্রাহ্মণসন্তান, সংস্কৃতজ্ঞ, কিন্তু স্পষ্ট জানালেন, বেদবেদান্ত কলেজে পড়ানোর প্রয়োজন নেই, বেকন পড়া দরকার। এই বৌদ্ধিক প্রাগ্রসরতাকে রক্ষণশীল বাঙালি সমাজ মানবে কী করে? শেষ জীবনে মানুষটিকে সাঁওতাল পরগনায় স্বেচ্ছানির্বাসন নিতে হয়েছিল।

বাঙালির রাজনীতিরও কি একটা বড় দায়িত্ব নেই? বিশেষ করে বামপন্থী রাজনীতির?

বামপন্থী রাজনীতির মধ্যেই যে বড় রকমের অ-বামপন্থী মনোভাব লুকিয়ে ছিল। ক্রমশ পার্টি মধ্যবিত্ত ডমিনেটেড হয়ে গেল। সেই আধিপত্য ক্রমশই বাড়ল। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দূরে সরে গেল। জীবনদর্শনের মধ্যেও একটা বিচ্ছিন্নতা তৈরি হল।

আপনি এক জায়গায় বলেছেন, আমাদের দৈনন্দিন ভাষায় সেই বিচ্ছিন্নতার একটা প্রতিফলন ঘটেছে।

হ্যাঁ, আমি সেটা খুবই মনে করি। ভাষা তো জীবন থেকেই তৈরি হবে। চাষি বা গ্রামের মানুষের কাছে নানা রকম বাংলা শব্দের খবর আছে, তাদের জীবনের বৈচিত্র, নানা ধরনের অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন রকমের মানুষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ, এই সব থেকেই তার ভাষা উঠে আসে। কিন্তু এখন শহরের মানুষ? সকালে ওঠে, চা খায়, বাজার যায়। ‘চা দাও, অফিস যাব’, বাসে উঠে হয় মেসি, নয় মোদী। ভাষা আসবে কোথা থেকে? খবরের কাগজ প্লেটে করে তাকে যেটা ধরে দেওয়া হয়, তার বাইরে কোনও ভাষা নেই, সেটাই তার ভাষা। এই যে ধরা যাক একটা শব্দ— সিংহভাগ। আজকাল খুব শুনি কথাটা। ‘মেসি কিন্তু সিংহভাগ বল পেয়েছে।’ ওই, খবরের কাগজ পড়ে শেখা ভাষা। জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন না হলে এমনটা হত না।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন থেকে এই বিচ্ছিন্নতা তো আরও একটা ক্ষতি করেছে আমাদের। শ্রমের মর্যাদা ব্যাপারটাই আমরা ভুলে গিয়েছি।

গোটা ভারতবর্ষকে ষাট বছর ধরে শেখানো হয়েছে, মাথার ঘাম পায়ে না ফেলে পয়সা রোজগার করতে হবে। আনআর্নড ইনকাম। আমাদের সমাজে পাত্র দেখতে গিয়ে ‘কী করে’ জানতে চাইলে বলা হত, ‘অমুক জায়গায় কেরানি, তবে উপরি আছে।’ এটা যেন একটা বাড়তি গুণ। এটা ভারতের সর্বত্রই চলে এসেছে। এর যে বিপরীত স্রোতটা, সেটা আসত শিক্ষক, ডাক্তার, এই ধরনের বৃত্তিধারীদের কাছ থেকে। আর, হ্যাঁ, খেটে-খাওয়া মানুষ— তাঁদের মধ্যে একটা অদ্ভুত সততা ছিল, পরিশ্রমের প্রতি মর্যাদাবোধ ছিল, ‘আমি খেটে খাই, চুরি করি না’, এর মধ্যে যে একটা প্রাইড ছিল, সেইটে যেন একেবারে তরল হয়ে গিয়েছে। আগে দেখেছি, কেউ ভাল কাজ করেছে বলে দশটা টাকা বেশি দিতে গেলে অনেকেই বলত, ‘না না, ওর দরকার নেই’। এটা তো একটা আত্মসম্মান থেকেই আসত। আর এখন? চিরকাল জেনেছি, ডাক্তার ভগবানের মতো, তাকে দেখলে আদ্ধেক রোগ সেরে যায়। ডাক্তার টাকার জন্যে শুধু শুধু টেস্ট করাবে, মিথ্যে ওষুধ লিখবে, এটা ভাবা যেত না। নিজের পেশার প্রতি একটা সম্মান, আত্মসম্মান...

এটা কেন এ ভাবে কমে গেল?

একটা পরিবারে বাবা জেঠা কাকা, তারা যদি দুর্নীতিকে দুর্নীতি বলে মনে না করে, তা হলে ছেলেপুলেরা কী শিখবে? অফিসার থেকে মন্ত্রী থেকে দলে দলে দুর্নীতিতে ডুবে আছে, সেটাই স্বাভাবিক বলে মেনে নিচ্ছে, এর প্রভাব তো পড়বেই। আগে দেখেছি, আমার আত্মীয়স্বজনের মধ্যেই দেখেছি, হয়তো কেউ হাইকোর্টের জজ, তাঁর কোনও বাড়ির লোক বা বন্ধুবান্ধব জড়িত আছেন এমন কোনও মামলা থাকলে সেটা কিছুতেই নিজের এজলাসে নিতেন না।

এর মূলে তো একটা আত্মসম্মানের প্রশ্ন থাকে, ঠিক যেমন আপনি যে শ্রমিকের কথা বলেন, সে ক্ষেত্রেও। সেই আত্মসম্মানবোধটাই হারিয়ে যাচ্ছে কি?

এর একটা প্রসেস আছে। প্রথমে হয়তো মানুষ কিছুটা বাধ্য হয়ে করে। ধরা যাক এক জন শিক্ষক, তাঁর যা মাইনেপত্র তা দিয়ে সংসার চালানো মুশকিল, তিনি প্রাইভেট টিউশন শুরু করলেন, টিউটোরিয়াল খুললেন। তার পর আস্তে আস্তে সেটার লোভে পড়ে গেলেন, এখন হচ্ছে— ভাল খাব ভাল পরব ভাল গাড়ি চড়ব, ফলে টিউটোরিয়াল থেকে টাকা রোজগারটাই আসল হয়ে দাঁড়াল, ক্লাসের পড়ানোয় আর মন নেই। দুর্নীতি যখন ঢোকে, প্রথমটা চেনা যায় না। তবে একটা জিনিস বোধহয় আমাদের মনে রাখা উচিত। আমি একেবারেই পণ্ডিত নই, কিন্তু আমাদের দেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে মনে হয়, আগেকার আমলে, এমনকী মোগল আমলেও সম্ভবত এতটা দুর্নীতি ছিল না। ভয় ছিল, বাদশার কানে পৌঁছলে গলা কাটা যাবে। কুণ্ঠাহীন লুণ্ঠন বোধহয় সাহেবদের প্রণোদিত করেছে দুর্নীতিতে, তাই তা আমাদের মধ্যে ঢোকাতে তাদের কোনও দ্বিধা হয়নি।

স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে একটা অন্য প্রেরণা ছিল না কি?

অবশ্যই ছিল। সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ ফৌজের কথাই যদি ধরি, সংখ্যায় খুব বেশি নয় হয়তো, কিন্তু সাউথ ইস্ট এশিয়া নিবাসী ভারতীয়দের সর্বত্র তারা বিরাট সমর্থন পেয়েছিল। শুধু মুখে না, মিলিয়নস অব ডলারস দান করেছে তারা। তাঁর কোনও আত্মচিন্তা ছিল না। আত্মোৎসর্গ করতেই তিনি এসেছিলেন। এখন আত্মোৎসর্গের কথা বললে লোকে হাসে, ভাবে— বুড়ো কোন যুগে পড়ে আছে কে জানে, মান্ধাতার আমলের সব ভোকাবুলারি ব্যবহার করে। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের বাহিনীতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের লেখা পড়লে বোঝা যায়, প্রত্যেকটা লোক ওই মানুষটাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তাঁর দ্বারা যিনি ইনস্পায়ার্ড হচ্ছেন, তাঁকেও সৎ হতে হচ্ছে, প্রাণ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হচ্ছে, প্রাণ দিতে হচ্ছে।

স্বাধীনতার পরেও একটা সময় অবধি বলা হত, এবং সেটা সত্যিও বটে, বাঙালি রাজনীতিকদের অনেকের মধ্যেই একটা সততা ছিল, ষাট-সত্তরের দশকেও ছিল।

ছিল, নিশ্চয়ই। বামপন্থীদের মধ্যে ছিল, অন্যদের মধ্যেও, যাঁরা তখন শাসক, তাঁদের অন্তত পুরনো দিনের মানুষের মধ্যেও ছিল। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ওই তখনকার শাসক দলের নতুন প্রজন্মের মধ্যেই দুর্নীতির লক্ষণগুলো প্রথম ফুটে উঠল। প্রথমে স্বজনপোষণ দিয়ে শুরু হয়, হয়তো ছেলে, বা ভাইপো, ভাবে, ‘লেখাপড়া তেমন শেখেনি, আহা, করে খাক’, এই করতে করতেই দুর্নীতির মধ্যে ফেঁসে যায়। ঘুণ যখন ধরে, তখন চন্দনকাঠেও ধরতে পারে।

বার বার বামপন্থীদের কথায় ফিরে আসছি, তার কারণ তিরিশ বছরের বেশি একটা বামপন্থী শাসন এখানে ছিল, বামপন্থীরা, বিশেষ করে স্বাধীনতার পরেও অনেক দিন পর্যন্ত ব্যক্তিগত ভাবে সৎ ছিলেন, হয়তো অন্য অনেকের তুলনায় এখনও অনেকটা আছেন। কিন্তু বামপন্থী রাজনীতি তো বরাবর নতুন মানুষ তৈরির কথা বলেছে, শ্রমের মর্যাদার কথা বলেছে। পশ্চিমবঙ্গে তার বিশেষ কিছুই হল না।

আমরা ধরে নিই, বামপন্থী পতাকার নীচে যারা সমবেত হয়, তারা বামপন্থী। বলতে বাধ্য হচ্ছি, সেটা ঠিক নয়। বামপন্থী বললেই যে বামপন্থার চূড়ান্ত বিকাশ হচ্ছে, তা নয়। তা বলে কি পার্লামেন্টারি রাজনীতি থাকবে না? নিশ্চয়ই থাকবে। যত দিন সেই রাজনীতি মেনে নিচ্ছি, তার শর্ত নিশ্চয়ই মানতে হবে। কিন্তু সেখানেও বামপন্থা বহু বিস্তৃত একটা কথা। আমি নিশ্চয়ই আমেরিকান ইমপিরিয়ালিজমের স্বরূপটা উদ্ঘাটন করব, কিন্তু কী ভাবে করব, সেটা তো আমাকে বাছতে হবে। আমার স্ট্র্যাটেজি, আমার বেসিক পলিটিক্সটা ভাবতে হবে। জনবিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলে তো চলবে না। সেটাই তো হল। যে প্রশ্নে বামপন্থীরা কেন্দ্রীয় সরকার থেকে বেরিয়ে এলেন, সেটার মানে ক’জন বুঝতে পেরেছে ভারতবর্ষে? অথচ তার থেকে ঢের বড় বড় অন্যায় আমেরিকা রোজ করছে। সে দিক থেকে বলা যায়, যারা সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দিয়ছিল তাদের ভিতরে অন্তত ওই রোখটা ছিল। বলত অন্তত বিপ্লবের কথা। এঁরা সেই কথাগুলো বলাই বন্ধ করে দিয়েছেন, পাছে লোকে তাঁদের নকশাল ভাবে কি মাওবাদী ভাবে। কিন্তু তা হলে তো হবে না। সত্য কথা আমায় মাথা উঁচু করে প্রাণ ভরে বলতে হবে। এটাই আমার মনে হয় গোলমাল। তিরিশ বছর টিকল কীসের জন্যে? ওই, কিছুটা সদাচার ছিল, তার পরে খানিকটা ভূমিসংস্কার, এ রকম কতকগুলো কাজ করেছে। সেই কাজ করার ফলস্বরূপ ভোটব্যাঙ্ক এই তিরিশ বছর কাজ দিয়েছে। কিন্তু কাজগুলো তো অর্ধসমাপ্ত। কাজগুলো কি সম্পূর্ণ হয়েছিল? হয়ে থাকলে ওই ব্যাঙ্ক আরও দীর্ঘস্থায়ী হত। সত্যিকারের বামপন্থী দল হলে কতকগুলো জায়গায় আনকমপ্রোমাইজিং হতে হবে, আবার কতকগুলো জায়গায় মানুষের ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে আপস করতে হবে। গণতন্ত্রে থাকলে ভোটের রাজনীতি করতে হবে, সেটা তো কোনও অন্যায় নয়। কিন্তু কী ভাবে ভোটের রাজনীতি করছি, সেটাই তো প্রশ্ন। ভোটের রাজনীতি করছি বলে মুসলমান অধ্যুষিত জায়গায় মুসলমানকে প্রার্থী করব, এটা বামপন্থীদের কাছ থেকে আশা করা যায় না। সে তো বুক ঠুকে বলবে যে, ‘আমরা ওই রাজনীতি করি না।’

যারা নিজেদের কমিউনিস্ট পার্টি বলে, তারা চৌত্রিশ বছর রাজ্য শাসন করল, অথচ সব মানুষের অক্ষরপরিচয় হল না, এমনটাও তো বোধহয় পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও কখনও দেখা যায়নি!

আমার মনে হয় এর কারণ, তারা অত্যন্ত যান্ত্রিক ভাবে কমিউনিস্ট হয়েছে। আবেগ কি ছিল না? হৃদয় কি ছিল না? নিশ্চয়ই ছিল প্রথম দিকে। কিন্তু পরে যান্ত্রিকতা এসেছে। আমার দেশের মতো করে কমিউনিজমকে নিতে হবে, একটা আদর্শ হিসেবে নিতে হবে, এটা হয়নি। সেটা করেছে বলেই তো চিন টিকল। কিউবাও তাই।

চিন তো নিজেকে ক্রমাগত সংশোধন করতে করতে গেছে...

সেদিন একটা লেখা পড়ছিলাম, এই যে ক্রমাগত নিজেকে সংশোধন করেছে চিন, ফান্ডামেন্টালসগুলো কিন্তু ছাড়েনি। বিদেশি পুঁজি আসতে না দিলে আমার দেশের, আমার সমাজেরই ক্ষতি, অতএব লগ্নি ডেকে আনছে। কিন্তু এমন ভেবেচিন্তে তাদের ওপর শর্ত আরোপ করছে যে তারা পালিয়ে যাবে না, দেশেরও ক্ষতি হবে না। দেশের মানুষের জন্যেই রাজনীতি, তাদের বাদ দিয়ে হয় নাকি?

শেষ পর্যন্ত আবারও বলতে হয়, দ্য টাইম ইজ আউট অব জয়েন্ট।

আজকের তরুণ প্রজন্মের সামনে কী আছে? শিক্ষা নেই, কাজ নেই, স্কিল নেই। দুঃখ লাগে। আজকে পশ্চিমবঙ্গের যে ছবি, সেটা তো হওয়ার কথা ছিল না। তবে এরই মধ্যে আশার আলো এখনও বিদুৎচমকের মতো মাঝে মাঝে দেখি— ওই তরুণদের মধ্যেই— তাদের বোধহয় কণ্ঠরোধ হয় না। তারাই হয়তো নতুন কালের সত্যিটাকে খুঁজে আনবে।

সাক্ষাৎকার: অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় ও শিলাদিত্য সেন

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE