সহজ সমাধান। বানতলা, ৩১ জুলাই ২০১৪। ছবি: সনৎ কুমার সিংহ
এনসেফ্যালাইটিস প্রতিরোধের জন্য বরাহ বিতাড়নের উদ্যোগে ত্রস্ত হয়ে পড়লেন বহু দীন-হীন মানুষ, যাঁদের অনিশ্চয় জীবনে শূকর এক প্রকার নিশ্চয়তা আনে। সভ্যতার গোড়া থেকেই প্রাণীটি মানবসঙ্গী। পৌরাণিক রাজা হরিশ্চন্দ্রও জীবিকা নির্বাহ করেছেন বরাহপালনে। হঠাৎ সেটি শত্রু হয়ে উঠল কেন? বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে লোকসংখ্যা পিছু শুয়োরের অনুপাত ভারতের তুলনায় অনেক বেশি। ইউরোপ-আমেরিকা ছেড়েই দিন, চিনের সঙ্গে তুলনাতেই একটা বিরাট তারতম্য দেখা যাচ্ছে। দু’দেশের প্রায় একই রকম লোকসংখা সত্ত্বেও চিনে শুয়োরের সংখ্যা ৪৫ কোটি আর ভারতে পৌনে দু’কোটি। কিন্তু চিনে এনসেফ্যালাইটিস দুরাত্মা যে লোকদের খুব সন্ত্রস্ত করে রেখেছে, এমনটা শোনা যায় না।
দাবি, স্বাস্থ্য প্রশাসন রোগ মোকাবিলায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন। সংবাদমাধ্যমও তৎপর। এটা ছাড়া পশ্চিমবাংলায় আর কী ধরনের অসুখবিসুখ হচ্ছে, সেটা জানতে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে (www.idsp.nic.in) তাকানো যেতে পারে। কোনও রোগ প্রত্যাশিত হারের চেয়ে বড় আকারে দেখা দিলে (‘আউটব্রেক’), তা প্রতি সপ্তাহে জেলা-ভিত্তিতে এই তালিকায় ওঠে। এ বছরের ২৭তম সপ্তাহে (৩০ জুন থেকে ৬ জুলাই) বাঁকুড়া আর নদিয়া জেলায় দেখা দিয়েছে ডায়েরিয়া আর ফুড পয়জনিং, তারও আগের সপ্তাহে ফুড পয়জনিং-এ ১৭০ জন আক্রান্ত উত্তর ২৪ পরগনায়, জলপাইগুড়ি ভুগছে ডায়রিয়ায়। মৃত্যু নেই, তাই খবর হয় না। কিন্তু আক্রান্তদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যে ব্যাহত হয়, আয় কমে, ব্যয় বাড়ে, তা বুঝতে গাণিতিক ধনতত্ত্ব পড়তে হয় না। সংক্রামক রোগগুলির তীব্রতা কমেছে নিঃসন্দেহে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে ২০১২ সালে সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন প্রায় ৪৮ লক্ষ জন আর মারা গিয়েছিলেন ২৩১৮ জন, অর্থাৎ ০.০৫ শতাংশ। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সংক্রামক রোগ হলে তার মোকাবিলা করতে পারে, কিন্তু জনস্বাস্থ্যের শর্ত মেনে রোগ হওয়াটা আটকাতে পারে না। চিকিৎসা আর জনস্বাস্থ্য, দু’টি আলাদা বিষয়কে একত্রিত করে ‘স্বাস্থ্য পরিষেবা’ বলে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু, দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা প্রায় হয়ই না। যখন সংকট বেশ বড় আকার নেয়, তখন আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ঘিরে। সামলাতে সময় লাগলে কাঠগড়ায় দাঁড়ায় স্বাস্থ্য বিভাগ।
দেশ যখন পরাধীন ছিল, বিদেশি শাসকরা তখন নিজেদের স্বার্থেই আলাদা রেখেছিলেন চিকিৎসা আর জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা। চিকিৎসাবিজ্ঞান অনেক পিছিয়ে ছিল তখন। পরিবেশ স্বাস্থ্যকর রাখাই ছিল সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার প্রকৌশল। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে মূলত সৈনিক এবং সাহেবদের সংক্রামক ব্যাধিগুলো থেকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা করার জন্য গঠিত হয়েছিল রয়াল কমিশন। প্রণয়ন করা হয়েছিল বেশ কিছু আইন। কিছু প্রক্রিয়া আবশ্যিক করা হয়েছিল। ডাক্তার ও নার্সের অপ্রতুলতার মোকাবিলা করা হত জনস্বাস্থ্য কর্মীদের কাজে লাগিয়ে। রোগগুলো যাতে না হতে পারে, সেই ব্যবস্থা নিয়ে। সুশিক্ষিত জনস্বাস্থ্য কর্মী তৈরি করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ অ্যান্ড হাইজিন (১৯২৮), স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন (১৯১৪), সেন্ট্রাল ম্যালেরিয়া ইনস্টিটিউট (১৯০৯)। প্রাদেশিক এবং কেন্দ্রীয় স্তরে তৈরি করা হয়েছিল স্যানিটারি বিভাগ। নির্দিষ্ট আধিকারিক এবং কর্মী-বাহিনী নিয়োগ করা হয়েছিল দুই স্তরেই। মিউনিসিপ্যালিটি এবং ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডগুলিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সামগ্রিক ভাবে পরিবেশগত স্বাস্থ্যবিধান ব্যবস্থাপনার। এই ব্যবস্থায় অবশ্য সাহেব ও সেনাবাহিনীর লোকেরা যত ভাল থাকত, জনতা ততটা থাকত না, মূলত স্বায়ত্তশাসন সংস্থাগুলির আর্থিক ও মানবসম্পদগত অপ্রতুলতার জন্য। কিন্তু ভাবনাটা ঠিকঠাক ছিল। সাহেবদের নিজেদের দেশেও সেই ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে এতাবৎ এই আলাদা ব্যবস্থাই বলবৎ ছিল এবং তা ছিল সবার জন্য, স্বাস্থ্যের সূচকগুলির সত্যিই উন্নতি হয়েছিল।
স্বাধীনতার ঠিক আগে-আগে ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কারের প্রথম বড় সুপারিশ ভোর কমিটির রিপোর্ট। সেই সুপারিশ মেনে বর্তমান তামিলনাড়ু বাদে আর সব রাজ্যেই জনস্বাস্থ্য বিভাগটিকে ক্রমে মিলিয়ে দেওয়া হল চিকিৎসা বিভাগের সঙ্গে। জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি যে আলাদা ধরনের দক্ষতা ও প্রকৌশল লাগে, সেই সত্যটাই ভুলতে থাকলেন নীতিনির্ধারকরা। একটা একটা করে রোগ ধরে সেগুলি নির্মূল করার জন্য এক এক করে আলাদা আলাদা কর্মসূচি তৈরি হল, যার সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৫০-এ ম্যালেরিয়া দূরীকরণ কার্যক্রম দিয়ে। রাজ্যের জনস্বাস্থ্য কর্মীরা আর সব দায়িত্ব ভুলে লেগে পড়লেন কেবল কর্মসূচি-নির্দিষ্ট কাজগুলি সামলাতে। যে সব আন্তর্জাতিক সংস্থা আর্থিক সহায়তা দিতেন, তাঁরাও এই ব্যবস্থাকে মদত দিলেন। নির্দিষ্ট রোগ-ভিত্তিক কর্মসূচির নির্ধারিত সূচকের উন্নতির ওপরেই জোর দিতেন তাঁরা। সামগ্রিক জনস্বাস্থ্যের কী হল, তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা ছিল না। জনস্বাস্থ্যের প্রয়োজনেই স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অধীনে গঠিত হয়েছিল জনস্বাস্থ্য কারিগরি বিভাগ। পতঙ্গবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য জলের গুণমান পরীক্ষা ও নিকাশির ব্যবস্থা করা, কঠিন ও তরল বর্জ্যের স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থাপনা, এই সব জনস্বাস্থ্যগত যাবতীয় প্রকৌশল এঁরা দেবেন এবং নিরীক্ষণ করবেন এটাই উদ্দেশ্য ছিল। ১৯৭০-এ এই বিভাগটি স্বতন্ত্র হয়ে যায় স্বাস্থ্য মন্ত্রক থেকে। এঁরা মূলত এখন জল সরবরাহের কারিগরি দিকটা সামলান। টুকরো হতে হতে অবস্থা এমন এমন দাঁড়িয়েছে যে জনস্বাস্থ্যের নানান বিষয়গুলি ঠিক কার দায়িত্বে, সেটাই ঠিক করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এই প্রশাসনিক বিচ্ছিন্নতা যে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটিকে বিপর্যস্ত করছে, সেটা ২০০২ সালে প্রকাশিত জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি কার্যত স্বীকার করে নিয়েছে। এই নীতিতেই বলা হয়েছে যে, সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য পরিবেশগত স্বাস্থ্যবিধান খুবই জরুরি, কিন্তু এটা স্বাস্থ্য মন্ত্রকের আওতাধীন নয়। জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার নানান বিচ্যুতির প্রভাব পড়েছে আমাদের শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের পুষ্টিগত অবস্থানে, টিকা দিয়ে প্রতিরোধসাধ্য রোগগুলির বার বার প্রাদুর্ভাবে, পতঙ্গবাহিত রোগগুলির মহামারির আকার ধারণ করার প্রবণতায়।
এমন নয় যে কী করণীয়, সেটা নীতি-নির্ধারকদের জানা নেই। ১৯৫৫ সালে ভারত সরকার প্রণয়ন করেছিল মডেল পাবলিক হেল্থ অ্যাক্ট। এই মডেল আইনটির সংশোধিত সংস্করণ পুনঃপ্রকাশিত হয় ১৯৮৭-তে। এ রকম একটা আইন জরুরি, কারণ জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য যা-কিছু করণীয়, সেটা আইনত কার দায়িত্ব, তা নিশ্চিত করে ঠিক করা দরকার। এখনও পঞ্চায়েত বা মিউনিসিপ্যালিটির আইনগুলিতে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কিছু দায়িত্ব দেওয়া আছে ঠিকই, কিন্তু কার্যত সেটার খানিকটা পালন করেন কোনও সরকারি বিভাগের কর্মীরা, কোনও কর্মসূচির অংশ হিসেবে; আর কিছুটা করার চেষ্টা করে সেই সংস্থা, তাদের সীমিত সাধ্যের মধ্যে। দ্বিতীয় প্রয়োজন এই যে, যাবতীয় জনস্বাস্থ্যের পরিষেবার মান নির্দিষ্ট হওয়া দরকার। যেমন, কেবল পরিস্রুত পানীয় জল বলে দিলে হবে না, ‘পরিস্রুত’-এর মাপকাঠি কী এবং সরবরাহের দায়িত্ব কার, সেটাও বলতে হবে আইন করে। তৃতীয়ত, জনস্বাস্থ্য আইন না মানলে কী হবে, সেটা স্পষ্ট হওয়া এবং শাস্তির ব্যবস্থাও থাকা দরকার। ফুড পয়জনিং মাঝে মাঝেই গ্রামীণ জীবনকে বিপর্যস্ত করে, সে কথা আগেই বলেছি। সব গ্রামে খাদ্য-ল্যাবরেটরি থাকবে, এমন অবাস্তব দাবি করছি না। কিন্তু খাবার দোকানের লাইসেন্স দেওয়ার সময় প্রক্রিয়াগত কিছু শর্ত চাপাতেই পারে গ্রাম পঞ্চায়েত। মানবস্বাস্থ্যের ওপর কুপ্রভাব এড়ানোর কৌশল পশুপালনবিজ্ঞান আবিষ্কার করে ফেলেছে অনেক দিন। ভারতের অধিকাংশ রাজ্যেই এই আইনটি এখনও চালু হয়নি। একটা বড় কারণ সম্ভবত এই যে, এই কাজগুলি নির্ধারিত মান অনুযায়ী করার আর্থিক সক্ষমতা বা মানবিক দক্ষতা স্থানীয় সরকারগুলির নেই।
এই প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা তৈরি করা অসম্ভব নয়। কিন্তু বহু মন্ত্রক, বিভাগ, কর্মসূচিতে বিভক্ত এ দেশের জনস্বাস্থ্য-উন্নয়ন প্রয়াসে এই দায়িত্ব কে নেবে, সেটাই ঠিক করা যাচ্ছে না। যে মন্ত্রকগুলি স্থানীয় সরকারের বিষয়গুলি দেখে থাকেন, জনস্বাস্থ্য নিয়ে তাঁদের খুব কিছু জানা নেই। জনস্বাস্থ্য কর্মী-বাহিনী লুপ্ত হয়ে গেছে নানান নির্দিষ্ট রোগ-ভিত্তিক কর্মসূচির খিদে মেটাতে। যে সব সমাজবিজ্ঞানী জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের মতে খোদ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকেই জনস্বাস্থ্য বিষয়ক উচ্চপদগুলিতে যাঁরা আছেন, তাঁদের অনেকেই এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন। মন্ত্রকে তাঁদের সামগ্রিক সিনিয়রিটির ভিত্তিতে তাঁরা এই সব পদের অধিকারী। এ দেশে তাই সুস্বাস্থ্যের সন্ধান করা হয় কেবলমাত্র চিকিৎসার পথে। এরই প্রতিফলন দেখা যায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের প্রবণতায়, উচ্চতর বিদ্যালাভের ভিড় জমে চিকিৎসা-কেন্দ্রিক বিষয়গুলিতে, ‘প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন’-এর মতো জনস্বাস্থ্য-কেন্দ্রিক বিষয়গুলো তুলনামূলক কৌলীন্যহীনতায় ভোগে। ‘প্রসপেক্ট কম!’
দেশের অন্যান্য রাজ্যের জনস্বাস্থ্য বিভাগ যখন চিকিৎসা বিভাগের কাছে সমর্পিত হয়েছিল, একমাত্র তামিলনাড়ু সেই ব্যবস্থা মেনে নেয়নি। এখন অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় মাথাপিছু একই হারে স্বাস্থ্য খাতে খরচ করেও তামিলনাড়ুর সূচকগুলি অনেক ভাল। স্বাস্থ্য খাতে আমাদের দেশে সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যয় এমনিতেই লজ্জাকর ভাবে কম। যেটুকু হয়, ভাল জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার অভাবে সেটাও ফুটো পাত্রে জল ঢালার সঙ্গে তুলনীয়। অতএব, ভরসা তৃতীয় অবতার শত্রুভাবে তাঁকে বিতাড়ন, দোষ ঢাকতে তাঁর আবাহন।
রাজ্য সরকারের ভূতপূর্ব সচিব। প্রতীচী ইনস্টিটিউটে কর্মরত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy