Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

তামিলদের সব কিছু ধুয়েমুছে সাফ

“২৫ বছর আগে আমরা যেমন কোণঠাসা ছিলাম, এখনও ঠিক তেমনই। আমাদের পেটও ভরে না। পিঠও বাঁচে না।” জাফনা ও কিলিনোচ্চিতে তামিলরা এটাই বলছেন। আজ শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন।ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। বার বার ছাতা হাতে গাড়ি থেকে নামছি। কিন্তু কেউই বলতে পারছেন না জায়গাটা ঠিক কোথায়। আমাদের গাইড, বছর পঁচিশের সিংহলি যুবক কাসুন পেরেরা বা তাঁরই সমবয়সি গাড়িচালক কালপা দেশনায়েকের কোনও হেলদোল নেই। কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাঁরা আগেই তা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন।

জবাব। নির্বাচনী পোস্টারে রাজাপক্ষের মুখ ঢেকে দেওয়া হয়েছে। নুয়ারা এলিয়া, শ্রীলঙ্কা। ছবি: লেখক।

জবাব। নির্বাচনী পোস্টারে রাজাপক্ষের মুখ ঢেকে দেওয়া হয়েছে। নুয়ারা এলিয়া, শ্রীলঙ্কা। ছবি: লেখক।

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। বার বার ছাতা হাতে গাড়ি থেকে নামছি। কিন্তু কেউই বলতে পারছেন না জায়গাটা ঠিক কোথায়। আমাদের গাইড, বছর পঁচিশের সিংহলি যুবক কাসুন পেরেরা বা তাঁরই সমবয়সি গাড়িচালক কালপা দেশনায়েকের কোনও হেলদোল নেই। কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাঁরা আগেই তা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন।

শ্রীলঙ্কা যাওয়ার আগেই শুনেছিলাম জাফনার কাছে কোথাও একটা এলটিটিই মেমোরিয়াল রয়েছে। নিহত এলটিটিই কর্মীদের দেহ সেখানে সার সার সমাহিত। বেশ কয়েকটি বইয়ে ওই স্মারকের ছবিও দেখেছিলাম। কিন্তু জাফনায় পৌঁছে বুঝলাম, বিষয়টা তত সহজ নয়। ভ্রূ-তে ভাঁজ ফেলে কাসুন বলেছিলেন, “ওদের কোনও মেমোরিয়াল থাকতে পারে না। কবরখানা ছিল বোধহয় কোনও এক সময়।” কিন্তু কোথায়? পথচলতি জাফনাবাসী প্রশ্ন শুনে কয়েক মুহূর্ত ফ্যালফাল করে তাকিয়ে থেকেছেন। তার পরে মাথা নেড়ে চলে গেছেন। শেষে রাস্তায় সেনাবাহিনীর একটা গাড়ি দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করলাম। তরুণ জওয়ান তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জানালেন, “ছিল। এখন নেই। সব ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়েছি। ও সব রেখে দেওয়ার অর্থ এই তামিলগুলোকে আরও বাড়তে দেওয়া। ওদের কোনও ভাবে বিশ্বাস করা যায় না।”

সব ‘ধুয়েমুছে সাফ’ হয়ে যাওয়ার পরেও অবিশ্বাসের ছবিটা বদলায়নি শ্রীলঙ্কায়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তার অমোঘ ছায়া পড়েছে। বর্তমান রাষ্ট্রপতি, শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টির মাহিন্দা রাজাপক্ষের অভিযোগ: শ্রীলঙ্কা ছেড়ে এলটিটিই-র কিছু সদস্য অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরে পালিয়ে যান। এখন তাঁদের সঙ্গে ফের যোগাযোগ শানাচ্ছে বিরোধীরা। অতএব দেশের সামনে ফের বড় সঙ্কট।

এলটিটিই-র ‘ভূত’ সামনে আনা হচ্ছে, তাই তারই হাত ধরে পুরু হচ্ছে জমে থাকা অবিশ্বাসের আস্তরণ। কাসুন বললেন, “জাফনা জায়গাটা বড় সুন্দর। তামিলরাই এটা নষ্ট করে দিয়েছে। ওরা আমাদের ভাষা জানে, কিন্তু সে ভাষায় কথা বলে না। আমাদের সংস্কৃতি, আচারবিচার সব ওদের জানা, তবু ওরা তা মানে না। এ দেশে থাকার অধিকার ওদের নেই।”

এর ২৪ ঘন্টা পরেই কিলিনোচ্চি-র এক হোটেলের তামিল কর্মী বালাচন্দ্রন বলেছিলেন, “আমাদের আর কিছু অবশিষ্ট নেই। ২৫ বছর আগে আমরা যেমন কোণঠাসা ছিলাম, এখনও ঠিক তেমনই। ‘আশ্রিত’ তকমাটা ঝেড়ে ফেলা যায়নি। আমাদের পেটও ভরে না। পিঠও বাঁচে না।” জাফনা ও কিলিনোচ্চির বহু এলাকা ঘুরে এই বঞ্চনার কথা বার বার শুনেছি। অপরিচয়ের বাধাটুকু কেটে গেলেই তামিলরা বলেছেন, শুধু এলটিটিই নয়, তামিল জনগোষ্ঠীকেই মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে শ্রীলঙ্কা জুড়ে।

এলটিটিই-র সদর দফতর ছিল কিলিনোচ্চি। বেশির ভাগ সময় রক্তে ভিজে থাকত তার মাটি। স্তূপাকৃতি শবদেহ, ভেসে আসা গোঙানি: সে সব দৃশ্য ভেবে বাসিন্দারা এখনও শিউরে ওঠেন। বিস্ফোরণে ছাদ-দেওয়াল উড়ে যাওয়া বাড়ি, বিধ্বস্ত জলের ট্যাঙ্ক, বাড়ির গায়ে বুলেটের দাগ, এখনও মুছে যায়নি সেই সময়। সে সব ঢেকে দিতে টাউনের মাঝখানে অবশ্য শহিদ বেদি হয়েছে। সেনাবাহিনী কী ভাবে রক্ত ঝরিয়ে দেশকে বাঁচিয়েছে, রয়েছে তার নানা বিবরণ লেখা স্মারকস্তম্ভও।

২০০৯ জানুয়ারিতে রাজাপক্ষে কিলিনোচ্চি দখলের সরকারি ঘোষণা করেন। এলটিটিই-র তখনও-জীবিত সদস্যদের হুঁশিয়ারি দেন, হয় অস্ত্র ফেলে আত্মসমপর্ণ, নয়তো মৃত্যু। মাঝামাঝি কিছু নেই। তাঁর হুঁশিয়ারি যে স্রেফ মুখের কথা ছিল না, তা প্রমাণ হয়ে যায় ২০০৯ সালের ১৯ মে। সেনাবাহিনীর গুলিতে মৃত্যু হয় এলটিটিই-র নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরনের। এর আগে-পরে তাঁর দুই ছেলেও মারা যায়। স্ত্রী ও মেয়েও নাকি খুন হন কিছু দিনের মধ্যেই। মেয়েকে নাকি ধর্ষণ করে খুন করা হয়। যদিও অন্য মত: স্ত্রী ও মেয়ে আজও জীবিত।

শ্রীলঙ্কায় তামিল জনসংখ্যা এখন প্রায় ১৬ শতাংশ। এর মধ্যে প্রায় ৫ শতাংশ ভারতীয় তামিল। চা ও রবার বাগানে কাজের জন্য ভারত থেকে যাঁদের নিয়ে গিয়েছিলেন ব্রিটিশরা। এঁরা থাকেন প্রধানত মধ্য শ্রীলঙ্কায়। বাকি তামিলরা থাকেন উত্তর ও উত্তর-পূর্ব প্রদেশে। প্রধানত জাফনা ও কিলিনোচ্চি এলাকায়। গত পাঁচ বছরে কিলিনোচ্চির হাল অনেকটাই ফিরেছে। জাফনারও। নতুন অফিস, চকচকে দোকান, বেসরকারি হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক তৈরি হয়েছে। তামিলদের দীর্ঘশ্বাস থামেনি। তাঁদের কথা: ‘পেট ভরা জরুরি, কিন্তু অন্যান্য অধিকার?’ ব্যাঙ্ককর্মী নাল্লালগন বললেন, “রাস্তায় একসঙ্গে কয়েক জন তামিল জড়ো হলেই কুকুর-বেড়ালের মতো হটিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। সে দিন আমার ভাইকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ওরা। এক সিংহলি সহকর্মী ভাইকে বলেছিল, তামিলরা যে এখনও বেঁচেবর্তে রয়েছে তা স্রেফ ওদের দাক্ষিণ্যে। আমার ভাই মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেনি। একটা চড় মেরেছিল। বহু কষ্টে মুচলেকা দিয়ে ওকে ছাড়িয়ে এনেছি। প্রতি পদে এত অপমান আর সহ্য হয় না।”

জাফনা এক অন্য জগত্‌। বাকি শ্রীলঙ্কা ঘোরার পরে কেউ যদি জাফনা আসেন, তা হলে তাঁর মনে হবে অন্য কোনও দেশে এসেছেন। চার পাশে দোকানে তামিল সাইনবোর্ড, মাইকে বাজতে থাকা তামিল গান, তামিল ভাষায় কথোপকথন, বাকি দেশের থেকে জাফনাকে অনেকটাই আলাদা করেছে। কিন্তু আজও সেখানে যুদ্ধের স্মৃতি। এখনও বহু বাড়ির গায়ে বুলেটের দাগ। জলপথে কোনও রকম সন্দেহজনক কিছু যাতে ঘটতে না পারে, সে জন্য লেকের ধারে সেনাবাহিনীর ২৪ ঘন্টা টহল চলে। সন্ধ্যার মুখে রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়েও কয়েক বার স্বয়ংক্রিয় বন্দুক হাতে টহলরত জওয়ানদের জেরার মুখে পড়তে হয়েছে। শিয়রে ভোট। চার পাশে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। জাফনাবাসীর তা নিয়ে উত্তেজনা তো আছেই, সঙ্গে আছে অমোঘ প্রশ্ন, “যুদ্ধ তো থেমেছে পাঁচ বছর আগে, আমরা কী পেয়েছি?”

তামিলদের ক্ষোভ আর হতাশার প্রভাব যাতে ভোটের ফলে না পড়ে, তা নিশ্চিত করতে সব রকম চেষ্টা চালাচ্ছে শাসকগোষ্ঠী। তামিল এলাকায় পর পর সভা করছেন রাজাপক্ষে। বিরোধীরা অবশ্য বলেছেন, তামিলরা যাতে ভোটকেন্দ্রে পৌঁছতে না পারেন তার চেষ্টা চলছে, সেনাবাহিনীকেও সে কাজে লাগানো হচ্ছে।

সাংবাদিক পরিচয় দেওয়া বারণ ছিল। তা হলেই নাকি হাজার প্রশ্ন-বাধা আসবে। যাওয়ার আগে অগ্রজ সাংবাদিকও সতর্ক করে দিয়েছিলেন। চেন্নাই থেকে শ্রীলঙ্কাগামী উড়ানে পরিচয় সুইটজারল্যান্ডের মার্টিনের সঙ্গে। তাঁর বান্ধবী ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। শ্রীলঙ্কায় তামিলদের মানবাধিকার নিয়ে ফিচার লেখার জন্য ক’মাস জাফনায় আছেন। বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে আসা মার্টিন জানালেন, প্রতি দিন তাঁর ভয় হয়, এই বুঝি কোনও খারাপ খবর এল। সাংবাদিক অপহরণ বা খুনের ঘটনা এখনও জলভাত। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলি এ নিয়ে বহু আপত্তি জানিয়েছে। কাজের কাজ কিছু হয়নি। শ্রীলঙ্কার মানবাধিকার কর্মীরাও বলেন, যুদ্ধ থামানোর কৃতিত্ব রাজাপক্ষেরই, কিন্তু হিংসা, সন্দেহ আর নিষ্ঠুরতার ছবিটা বদলানোর কোনও চেষ্টাই তিনি করেননি। সংখ্যাগুরু সিংহলিদের কাছে আগেও তামিলরা তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির নাগরিক ছিলেন, এখনও তাই।

কিন্তু শুধু তামিলরা নন, সিংহলিদের মনেও রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে। এক্সপ্রেসওয়ে হয়েছে। উড়ালপুলে ভরে গিয়েছে বড় শহর। কিন্তু বেড়েছে ক্যাসিনোর সংখ্যাও। সে নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে বিস্তর। বাজারদর লাগামছাড়া। পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ ক্রমশ তীব্র হচ্ছে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে। তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই সরকারি উচ্চপদে। বাড়ছে তাঁর সম্পত্তির বহরও। তাঁরই ভূতপূর্ব স্বাস্থ্যমন্ত্রী মৈত্রীপাল সিরিসেনা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তাঁর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন। গত নভেম্বরে দল ছাড়া সিরিসেনার কথায়, “দেশের অর্থনীতি এখন একটা পরিবারের কবলে চলে গিয়েছে। এ থেকে মুক্তি দরকার। একনায়কতন্ত্র আর বরদাস্ত করা যাচ্ছে না।”

শ্রীলঙ্কার আইন অনুযায়ী, সেখানে দু’বারের বেশি কেউ রাষ্ট্রপতি পদে থাকতে পারতেন না। সেই আইনের সংশোধনী পাশ করিয়েছেন রাজাপক্ষ। এটা তাঁর তৃতীয় দফার লড়াই। কিন্তু কতটা পূরণ হবে তাঁর স্বপ্ন? সিরিসেনা একা নন, মন্ত্রী ও দলের সর্বোচ্চ স্তরের নেতা মিলিয়ে গত ছ’মাসে মোট ২৫ জন রাজাপক্ষকে ছেড়ে গিয়েছেন। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি চন্দ্রিকা কুমারতুঙ্গা ন’বছর পর সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন, তিনিও এখন সিরিসেনার পাশে। প্রবীণ গাড়িচালক রুমায়েজ খান হাসতে হাসতে বললেন, “ইঁদুরেরা অনেক আগে থেকে ধ্বংসের ইঙ্গিত পায়। মন্ত্রীরাও।”

নুয়ারা এলিয়া’য় সে দিন জনসভা ছিল রাজাপক্ষের। রাস্তার ধারে সার দিয়ে দাঁড়ানো বাস। দোকানে জলের বোতল কিনতে ঢুকলাম, দোকানি বললেন, “যেখান থেকে পেরেছে লোক জোগাড় করে এনেছে।” পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা, লোক ভরানোর এই রাজনীতি বিলক্ষণ চিনি। কিন্তু চমক লাগল অন্য একটা কারণে। রাস্তার ধারে রাজাপক্ষের ছবি দেওয়া যতগুলো ব্যানার, তার অধিকাংশতেই তাঁর ছবি ঢেকে দেওয়া হয়েছে প্লাস্টিকে। পোস্টারে কালি লেপে দেওয়া হয়েছে প্রায় সর্বত্রই। একই ছবি দেখেছি কিলিনোচ্চিতে।

‘সব ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়েছি’। কথাটা কানে বাজছে। এখনও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

post editorial soma mukherjee soma mukhopadhay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE