Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

তরুণ ভারত মা-বাপ চায় না, চায় সুযোগ

নরেন্দ্র মোদী উত্তরাধিকার সূত্রে নয়, নিজের চেষ্টায় ধাপে ধাপে উঠে এসে আজ প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে আসীন। এই ক্ষমতায়নে একটা প্রতীক আছে। লগ কেবিন থেকে হোয়াইট হাউস যেমন প্রতীক হিসেবে টিকে গেছে, দাঁড়িয়ে গেছে, মোদী সরকারের ভবিষ্যৎ যেমনই হোক, সাত নম্বর রেসকোর্স রোডে তাঁর প্রবেশও তেমনই ভাবী ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়ে গেল।

জয়ন্ত ঘোষাল
শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৪ ০০:২৮
Share: Save:

নরেন্দ্র মোদী উত্তরাধিকার সূত্রে নয়, নিজের চেষ্টায় ধাপে ধাপে উঠে এসে আজ প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে আসীন। এই ক্ষমতায়নে একটা প্রতীক আছে। লগ কেবিন থেকে হোয়াইট হাউস যেমন প্রতীক হিসেবে টিকে গেছে, দাঁড়িয়ে গেছে, মোদী সরকারের ভবিষ্যৎ যেমনই হোক, সাত নম্বর রেসকোর্স রোডে তাঁর প্রবেশও তেমনই ভাবী ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়ে গেল।

যে সময়ে এই প্রতীকটি রচিত হল, সেটিও কিন্তু কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। সনাতন ভারত এখন আক্ষরিক অর্থেই তরুণ ভারত। এ দেশের সওয়া একশো কোটি মানুষের অর্ধেকের বয়স পঁচিশ থেকে ত্রিশের কোঠায়। এই নতুন প্রজন্ম, আগামী পাঁচ বছরে আরও একটি প্রজন্ম নীতি নির্ধারক সমাজের বিশেষ প্রতিনিধি হয়ে উঠবে। এই প্রজন্মের ভাষা স্বতন্ত্র। সাবেকি রাম মন্দিরের হিন্দুত্ব নিয়ে এদের মাথাব্যথা নেই, অন্তত সেটা এদের প্রাথমিক লক্ষ্য নয়। এরা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে লালিতপালিত পুঁজিবাদকে বাজারনির্ভর পুঁজিবাদে নিয়ে আসতে চায়। আবার এটাও মনে করেন যে শাহি দিল্লির রাজনেতার এক সক্ষম অভিভাবকত্ব থাকবে, অনেকটা মার্কিন সমাজ যেমন তার প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে আশা করে। এরা এক শক্তিশালী ভারত-রাষ্ট্রকে দেখতে চায়। জোরের সঙ্গে সেই রাষ্ট্র নির্মাণের পথে এগিয়ে যেতে চায়। দুর্বল সরকারে এদের অরুচি। এরা খিচুড়ি জোট সংস্কৃতিতে ক্লান্ত।

এ বারের নির্বাচনে এই তরুণ ভারত মোদীর উল্টো দিকে এক তরুণ নেতৃত্বকে দেখেছে। কিন্তু সেই নেতৃত্ব বংশলতিকায় লালিত। বয়সে নবীন, কিন্তু সেই রাজকুমারকে আমজনতা ভবিষ্যৎ আশাআকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন ও প্রত্যাশার তীরে পৌঁছে দিতে সক্ষম বলে মনে করতে পারেনি। সেই তরুণ ২০১৪ সালের অগ্নিপরীক্ষায় ব্যর্থ। গালে টোল পড়া ‘ভাল ছেলে’ রাহুল গাঁধীর পরিচয়, তিনি বড় ঘরের ছেলে। এবং আজও তিনি মায়ের ছেলে। এই বিশাল দেশের আমনাগরিকের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে সক্ষম হননি তিনি। এক দিন দলিত পরিবারে গিয়ে রাত কাটানো হয়তো তাঁর সৎ প্রতীকী উদ্যোগ ছিল, কিন্তু শুধু ওইটুকু দিয়ে এ দেশের গ্রামীণ জনসমাজের সঙ্গে রাহুল গাঁধী নিজেকে যুক্ত করতে পারেননি। তাঁর না-পারার পিছনে অনেক কারণ। হয়তো সবচেয়ে বড় কারণ তাঁর নিজের ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তাঁর বংশলতিকা-নির্ভরতাও শেষ পর্যন্ত তাঁর পথের কাঁটা হয়েছে। ‘চা-ওয়ালা’ নরেন্দ্র মোদী সেই বাস্তবকে দক্ষ ভাবে নিজের কাজে লাগিয়েছেন।

গোধরা-কলঙ্কিত মোদী সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসেছেন উন্নয়ন নামক এক ধারণার মঞ্চে। উপায়ের সঙ্গে লক্ষ্যের বিবাদ হতে পারে। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য, মানুষ সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগকে গুরুত্ব না দিয়ে উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের পথে দারিদ্র দূর হওয়ার প্রত্যাশাকে বেশি মূল্য দিয়েছে। ভোটের ফলই তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

মোদী ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হল, ভারতের উন্নয়নের অভিমুখ কি এ বার বদলাচ্ছে? নরেন্দ্র মোদী আবার এ দেশে একদলীয় গরিষ্ঠতা আনতে সক্ষম হয়েছেন। রাজীব গাঁধী ১৯৮৪ সালে শেষ বারের মতো কংগ্রেসের এই একক গরিষ্ঠতা এনেছিলেন। কিন্তু সে দিনের সাফল্যের পটভূমি ছিল ইন্দিরা গাঁধীর আকস্মিক মৃত্যুর আবেগ। এ বারের ভোটে নাগরিকের প্রধান আবেগ এক নতুন ভারত গড়ার স্বপ্ন ও প্রত্যাশা। এই একদলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে চালকের আসনে বসে এ বার কোন পথে মোদী দেশকে নিয়ে যাবেন? প্রায় সত্তর বছরের ইতিহাসে এক নয়া মোড় আনতে চাইবেন কি তিনি? নেহরুবাদী সমাজতন্ত্রের পথ বদলে কি সত্যিই ডান দিকে ঘুরতে পারবেন? অনেকে টোনি ব্লেয়ারের নিউ লেবার-এর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। কেউ কেউ এমনকী মার্গারেট থ্যাচারের কথাও বলছেন। অন্য দেশের তুলনা থাকুক, মোদী কি স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারবেন?

নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে বহু বার কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তাতে একটা কথা মনে হয়েছে, যে কথা তিনি নিজেও ক্রমাগত বলে চলেছেন। তাঁর প্রধান ভাবনা: কী ভাবে সরকারের ভূমিকা কমিয়ে প্রশাসনিক যোগ্যতাকে বাড়ানো যায়। অগ্রাধিকার দেওয়া যায় সরকারি দক্ষতাকে। এটা কেবল মন্ত্রিসভার আয়তন বা সরকারি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রশ্ন নয়, তার গভীরে আছে একটা মৌলিক মানসিকতার প্রশ্ন। এ বারের ভোটের ফলাফলের সঙ্গে, তার পিছনে কার্যকর তরুণ ভারতের জনাদেশের সঙ্গে এই মানসিকতার প্রশ্নটি বিশেষ ভাবে জড়িত। সেই মানসিকতাকে বোঝার জন্য একটু পিছিয়ে যাওয়া দরকার, তা হলে পরিবর্তনের প্রেক্ষিতটা স্পষ্ট হবে।

সরকার মানেই আমরা বরাবর ভেবে এসেছি হুজুর মা-বাপ। প্রজাবৎসল রাজা দেশের সমস্ত প্রজার সুখস্বাচ্ছন্দ্যের দিকে নজর রাখবেন। স্বাধীনতার পর ধরেই নেওয়া হয়েছিল, সার্বভৌম সরকার যেন দেশবাসীর অভিভাবক। তা থেকে আমরা আর বেরোতে পারিনি। বাম সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা রাষ্ট্রসর্বস্ব আর্থিক নীতিকে মোক্ষলাভের পথ বলে ধরে নিয়ে এই চিন্তায় ইন্ধন জুগিয়েছে। সত্তরের দশকের গোড়ায় ইন্দিরা গাঁধীও গরিবি হটাও স্লোগান দিয়েছিলেন, সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটির প্রবেশ হয়েছিল। গত ৬৭ বছর ধরে এ দেশে এমন এক মানসিকতা তৈরি হয়েছে, যেখানে নাগরিকের মনে এক চরম সরকার-নির্ভরতা কায়েম হয়েছে, যার অর্থ হল, সমস্ত কাজটাই সরকার করে দেবে। নাগরিক পায়ের উপর পা তুলে ভর্তুকি টিএ-ডিএর সংস্কৃতিতে গভীর ভাবে নিমজ্জিত হয়েছে। ভারতের দুর্ভাগ্য, মনমোহন সিংহের যুগেও সেই ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ থেকেছে। সনিয়া গাঁধী ইউপিএ-র প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়েই খাদ্য সুরক্ষা ও সামজিক নিরাপত্তার মতো বিষয়কেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এই নীতি নিয়ে তর্ক থাকতে পারে, কিন্তু যে ভাবে ইউপিএ-র চালকরা এই নীতিকে দেখেছেন, যে ভাবে এর প্রচার করেছেন, তার অন্তর্নিহিত ধারণাটা হল: সব সরকার করে দেবে। সরকার আর নাগরিকের সম্পর্কটা এখানে হুজুর এবং প্রার্থীর সম্পর্ক।

এ বার নির্বাচনী প্রচারের সময় নরেন্দ্র মোদীর কণ্ঠে এই সমাজতন্ত্রের রেটরিকটা কিন্তু আমরা শুনেছি খুবই কম। প্রচার শেষ হয়েছে। আজ তিনি জয়ী। ক্ষমতাসীন। এ বার তাঁকে করে দেখাতে হবে। এই যে প্রায় ৬৭ বছর ধরে বাজতে থাকা ভাঙা রেকর্ড মা-বাপ তার সন্তানকে দেখছে না এই মানসিকতা থেকেই দেশকে মুক্ত করতে হবে। নতুন প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্র ও নাগরিকের পারস্পরিক সম্পর্কের এক নতুন সংজ্ঞা নিরূপণ করতে হবে। সোজা কথাটা এই যে, বাবা-মা সন্তানের বিকাশে পরিষেবা জোগাবেন কিন্তু তাকে নিজের দায়িত্ব নিজেকে পালন করতে হবে। ব্যক্তি-নাগরিক যাতে স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারেন সেটা দেখাই রাষ্ট্রের কাজ হবে। অভিভাবকত্বের নামে সন্তানের জীবন নিয়ন্ত্রণ করা কাম্য নয়।

ভারতের নতুন প্রজন্ম দৃশ্যত এমনটাই চায়। কেবল শহরের শিক্ষিত তরুণরা নয়, মফস্সল আর গ্রামের উঠে-আসা, দ্রুত উঠে-আসতে থাকা তরুণরাও। দেশের অতি দ্রুত নগরায়ণের ফলে এই চাহিদার প্রসার এবং গভীরতা দুইই অভূতপূর্ব গতিতে বেড়ে চলেছে। হিন্দুত্ব আর মতাদর্শগত সাম্যবাদ তো অনেক হল, এ বার তারা আর্থিক উদারবাদের সুযোগ নিতে বেশি আগ্রহী। তারা চাইছে কর্মসংস্থান, তারা চাইছে বৃদ্ধি। নরেন্দ্র মোদীও তাদের সে কথাই বলেছেন। এ বার তাঁর পরীক্ষা। পরীক্ষাটা কঠিন। সাত দশকের মানসিকতা পালটানো সহজ হতে পারে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

jayanta ghoshal probondho
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE