নীতীশ কুমার পাটলিপুত্রের মসনদেই ফিরিলেন। মহাদলিত সতীর্থ জিতনরাম মাঁঝিকে তাঁহার সিংহাসনে বসাইয়া, ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে পর্যুদস্ত হওয়ার গ্লানি ও অস্বস্তি হইতে বাহির হইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, তাহাও আর তত প্রাসঙ্গিক রহিল না। কেননা তিনি ইত্যবসরে স্বাধিকারপ্রমত্ত হইয়া ওঠা মাঁঝির কাছে নিজের গদিই প্রায় হারাইতে বসেন। অনেক কাঠখড় পুড়াইয়া মসনদ পুনর্দখল করিলেন বটে, তবে এই পুনরভিষেকের প্রক্রিয়া, রাজ্যপাল, আদালত, স্পিকার, এমনকী রাষ্ট্রপতি-ভবন পর্যন্ত ঘুরিয়া আবার পটনারই বিধানসভা ভবনে সাঙ্গ হওয়া কুনাট্যটি রাজ্য-রাজনীতিতে নিশ্চিত ভাবে একটি বিস্মরণযোগ্য স্মৃতি রাখিয়া গেল। মুখ্যমন্ত্রী পদে নূতন করিয়া শপথ লওয়ার লগ্নে অবশ্য জিতনরামের সঙ্গে তাঁহার হার্দ্য করমর্দনের আলোকচিত্র গণমাধ্যমে প্রকাশিত। তবে এই করমর্দন রাজ্যের মহাদলিত ভোটদাতাদের উদ্দেশেই নিবেদিত, আর কয়েক মাস পরেই অনুষ্ঠেয় রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে যাহা কুড়ি শতাংশ মতদাতার পছন্দকে প্রভাবিত করিতে চায়।
ইতিমধ্যে অবশ্য বিহারের রাজনৈতিক চিত্রটি মূলত অপরিবর্তিত। যাদব, কুর্মি ও মুসলিম ভোট আকৃষ্ট করিতে গড়িয়া ওঠা আরজেডি (লালুপ্রসাদ), সংযুক্ত জনতা (নীতীশ-শরদ), কংগ্রেস ও সিপিআইয়ের নির্বাচনী জোটও অক্ষত। এই জোট উত্তর ভারতে নির্মীয়মাণ বৃহত্তর ও একান্নবর্তী জনতা পরিবারের পরীক্ষামূলক প্রয়োগেরই একটি প্রাদেশিক সংস্করণ, তবে প্রধানত মুলায়ম সিংহ যাদবের হেঁশেলের চার পাশে একজোট। বিহারে ও উত্তরপ্রদেশে এখনও বিধানসভা নির্বাচনের কয়েক মাস দেরি। আসন-বণ্টন লইয়া দরকষাকষির প্রক্রিয়া এখনও শুরুই হয় নাই। আসন-বণ্টন লইয়া দরাদরিই সেই চূড়ান্ত পরীক্ষা, যেখানে আঞ্চলিক মনসবদাররা প্রত্যেকেই নিজের কোলে ঝোল টানিতে ব্যগ্র হন, ‘ঐক্যবদ্ধ’ দলে নিজ গোষ্ঠীর আধিপত্য ও আনুপাতিক নিয়ন্ত্রণ লইয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হন। ঐক্যবদ্ধ জনতা পরিবার কোনও নীতি, আদর্শ বা কর্মসূচির কারণে খণ্ডবিখণ্ড হয় নাই, নেতাবহুল এই রাজনৈতিক সংগঠনের হেঁশেল নেতাদের অহমিকা, উচ্চাকাঙ্ক্ষার দ্বন্দ্বেই কালক্রমে বারো রাজপুতের তেরো হাঁড়িতে পরিণত হয়। নির্বাচনী রণে নিছক অস্তিত্বরক্ষার স্বার্থেই বিজেপির বিরুদ্ধে একজোট হওয়ার যে তাগিদ সাবেক জনতা পরিবারের ছত্রভঙ্গ গোষ্ঠীগুলিকে কাছাকাছি আনিতেছে, শেষ পর্যন্ত তাহা কত দিন টিকিবে, তাহা লইয়া সংশয় রহিয়াছে।
বিজেপি গত লোকসভা নির্বাচনে দেখাইয়া দিয়াছিল যে, মোদী-হাওয়া অর্থাৎ উন্নয়ন ও বিকাশের স্লোগান বিহারের মতো জাতপাতকণ্টকিত সমাজকেও আত্মপরিচয়ের সংকীর্ণ রাজনীতির বাহিরে পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ করিতে পারে। সে জন্যই নীতীশ কুমার ও লালুপ্রসাদদের প্রথাগত গণভিত্তিতে বিজেপি কিছুটা ফাটল ধরাইতে সমর্থ হয়। তাহার পর নীতীশ-লালুপ্রসাদ ঐক্য অংশত হইলেও বিজেপির অশ্বমেধের ঘোড়ার রাশ টানিয়া ধরিতে পারিয়াছে। কিন্তু জিতনরাম মাঁঝিকে লইয়া যে কাণ্ডটি সংঘটিত হইল, তাহার পরিণাম কী দাঁড়াইবে, অনুমান করা কঠিন। রাজ্য-বিজেপি নেপথ্যে জিতনরামকে সমর্থন করিলেও শেষ পর্যন্ত মহাদলিতদের সমর্থন আদায় করিতে পারিবে কি না, তাহার উপর অনেক কিছুই নির্ভরশীল। উচ্চবর্ণীয়রা তাহার সঙ্গেই আছে, কংগ্রেসের দিকে যাওয়ার প্রশ্ন নাই। অনগ্রসর ভোটব্যাংক স্পষ্টতই দ্বিখণ্ডিত। দলিতরা রামবিলাস পাসোয়ানের সৌজন্যে বিজেপির সমর্থনেই যাইবে। এই অবস্থায় মহাদলিত ভোট জয় করিতে দুই পক্ষের মধ্যে রুদ্ধশ্বাস প্রতিযোগিতা অস্বাভাবিক নয়। জিতনরামকে গণমাধ্যমের সামনে নীতীশ কুমার করমর্দন করিয়াছেন, কিন্তু গত কয় মাসে তাঁহাকে যে ভাবে অপদস্থ করা হইয়াছে, তাহার নিহিত অসম্মান মহাদলিতরা সহজে ভুলিয়া যাইবেন তো?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy