Advertisement
E-Paper

বৃথা যায়নি মোদীর উদ্যম, ওবামার চেষ্টা

নরেন্দ্র মোদী জানতেন যে ‘সুপার-পাওয়ার’কে পাশে পেতেই হবে। জানতেন, বৃহত্তর কূটনৈতিক লক্ষ্যটি পূরণের জন্য অন্যান্য ক্ষেত্রেও সহযোগিতার সেতু শক্ত না করলে চলবে না।ভারত সফরকারী প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডোয়াইট আইজেনহাওয়ার। ১৯৫৯ সালের শীতে তিনি দিল্লি পৌঁছবার পর রাস্তার দু’ধারে ভিড় জমে গিয়েছিল তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য। সুসজ্জিত ঘোড়ায়-টানা গাড়িতে চড়ে এলেন তিনি, পাশে ছিলেন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ। অন্যান্য সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ঘুরতেন একটি হুড-খোলা ক্যাডিলাকে।

ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০০

ভারত সফরকারী প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডোয়াইট আইজেনহাওয়ার। ১৯৫৯ সালের শীতে তিনি দিল্লি পৌঁছবার পর রাস্তার দু’ধারে ভিড় জমে গিয়েছিল তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য। সুসজ্জিত ঘোড়ায়-টানা গাড়িতে চড়ে এলেন তিনি, পাশে ছিলেন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ। অন্যান্য সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ঘুরতেন একটি হুড-খোলা ক্যাডিলাকে। মনে রাখতে হবে, সেই সময় ভারতের সঙ্গে মার্কিন দেশের সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ। কাশ্মীরে পাকিস্তানের আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ বিষয়ে একটুও সমালোচনা না করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন দুটি দেশই তখন কাশ্মীরকে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। আর, তার ফলে, আমেরিকার থেকে মুখ ঘুরিয়ে ভারত সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছে আমেরিকার তীব্রতম শত্রু মস্কোর দিকে।

তবু সে দিন ভদ্রতার ত্রুটি রাখেননি ভারতীয়রা। বন্ধুত্বের পতাকা উড়ানো, আইজেনহাওয়ারের সঙ্গে করমর্দনের জন্য হুড়োহুড়ি, ফুলে-মালায় তাঁকে ভরিয়ে দেওয়া, গাঁধীর সমাধিতে নিয়ে গিয়ে তাঁর হাত দিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ: কোনও কিছুতেই ঘাটতি ছিল না। প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার গাঁধী-সমাধিতে একটি গাছের চারাও লাগিয়ে এসেছিলেন।

পঞ্চান্ন বছর পর, আর এক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নয়া দিল্লিতে এসে রাজঘাটে সেই চিরাচরিত প্রথাগুলি পালন করলেন, গাছ রোপণ করলেন, ভিড়ের দিকে ফিরে সহাস্য অভিবাদন জানালেন, রাষ্ট্রপতির বাড়ি গেলেন। অসাধারণ বর্ণময় গার্ড অব অনার অনুষ্ঠিত হল তাঁর জন্য। ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে বহু দিন, আইজেনহাওয়ারের যুগ থেকে আজকের মধ্যে বিশ্বদুনিয়াও কম বদলায়নি, অথচ মার্কিন-ভারত সম্পর্ক প্রায় একই রকম রয়ে গিয়েছে। ওয়াশিংটনের হর্তাকর্তারা আজও ভারতকে সেই পুরনো দিনের আদলেই বিচার করেন। মার্কিন সরকার অন্যান্য মিত্রদেশের মতো ভারতকেও খানিক পদানত হিসেবেই দেখতে চায়। এই নিয়ে দুই দেশের ব্যুরোক্র্যাসির মধ্যে সংঘর্ষও কম লাগে না। ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক স্বার্থ যে ভারত সব সময় আত্মস্থ করে নিতে পারে না, ক্ষণেক্ষণেই তা দুই দেশের মধ্যে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। উল্টো দিকে, ভারতের বিশালবপু ব্যুরোক্র্যাসিও নিশ্চিত করে যাতে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নতির দিকে না এগোয়। তবু, সব কিছুর মধ্যেই, মার্কিন প্রেসিডেন্টের সফর নিয়ে উত্তেজনা উন্মাদনাও একই রকম সতেজ থাকে!

ওবামার এই সফরকে বলা যায় ভারত-মার্কিন সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য তাঁর পক্ষ থেকে একটি অন্তিম প্রচেষ্টা। মোটের উপর সেটা সফল। তবে ওয়াশিংটন যে এ ভাবে তার নিশ্চেষ্টতা আর নির্বিকারত্ব কাটিয়ে উঠতে পারল, তার পিছনে কিন্তু মোদীর উত্‌সাহের ভূমিকা কম নয়।

পরিবর্তনটা শুরু হয়েছিল গত সেপ্টেম্বরে, মোদীর বহু-বিজ্ঞাপিত মার্কিন সফর দিয়ে। মার্কিনদের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল করার জন্য তিনি কতটা উদ্‌গ্রীব, নিজ মুখেই তিনি তা ঘোষণা করেন। তার সঙ্গে, মার্কিন দেশে বসবাসকারী ভারতীয় অভিবাসী সমাজের প্রভাব ও ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের লক্ষ্যে এগোনোর ব্যাপারে তিনি কতটা একাগ্র, সেটাও বুঝিয়ে দেন। মোদী শাসনের প্রথম প্রতিশ্রুতিগুলির মধ্যেই যে দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয়টি ছিল, সেটা বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়।

আসলে, হিন্দুত্ব ছাড়া মোদীর আর তেমন কোনও আদর্শগত বাধ্যবাধকতা নেই। তাঁর মধ্যে একটা গ্লোবাল দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আছে প্রভূত ব্যবহারিক বুদ্ধি। স্বদেশি পরিবর্তন-বিমুখতা তাঁর মধ্যে নেই, ভূ-রাজনৈতিক রক্ষণশীলতাও নেই। তিনি জানেন, তাঁর স্বপ্নের দেশীয় ব্র্যান্ড ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ তৈরি করতে গেলে বিশ্বের একমাত্র ‘সুপারপাওয়ার’কে নিজের পাশে পেতেই হবে। আর তাই, ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে, ছোটখাটো বিষয়গুলি তুচ্ছ করে বড় উদ্দেশ্যের দিকে এগোনোই তাঁর লক্ষ্য। দৃষ্টান্ত: বিদেশি পরমাণু যন্ত্রাংশ রফতানিকারীদের সঙ্গে চুক্তিতে দায়বদ্ধতার ধারাটির নিয়ে তাঁর পুনর্ভাবনা। মনে রাখা দরকার, পরমাণু-শক্তিকেন্দ্রে কোনও দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যন্ত্রাংশ সরবরাহকারীদের দায়বদ্ধতার বিষয়ে ভারতে যে আইন পাশ হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাতে বিশেষ ভাবে ক্রুদ্ধ হয়েছিল। এই আইনের পিছনে ছিল ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার ভয়ানক অভিজ্ঞতা, যেখানে ইউনিয়ন কার্বাইড কোম্পানিকে কোনও ভাবেই দায়িত্ব নিতে বাধ্য করা যায়নি। কিন্তু তাতে ওয়াশিংটনের কী-ই বা যায়-আসে। তারা আজও মনে করে, ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তির ফলে ভারত প্রায় পরমাণু-শক্তিধর দেশে পরিণত হতে পেরেছে, কিন্তু আমেরিকার এক কণাও লাভ হয়নি। বাণিজ্য ও পরিবেশ-সংক্রান্ত আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে ভারতের এই দায়বদ্ধতা আইনগুলিকে মার্কিন সরকার নেহাতই আদর্শবাদী কট্টরপনা বলে মনে করে। একটা নতুন ধরনের পথে গিয়ে মোদী সমাধান বাতলালেন। বললেন, বিদেশি পরমাণু যন্ত্রাংশ সরবরাহকারীদের বদলে দায়বদ্ধতা বর্তাবে সরকার-পরিচালিত বিমা-কোম্পানিগুলির উপর। ভারতীয় অর্থেই সেই খরচ বহন করা হবে, কিন্তু ভারতের আইন পরিবর্তন করা হবে না। বিতর্কিত বাণিজ্য-চুক্তিতেও প্রথমে দৃঢ় অবস্থান নিলেও মোদী ক্রমে ইঙ্গিত দিলেন যে তাঁর পক্ষে আরও এগোনো সম্ভব, তবে একটি শর্তে। শর্তটা হল, ওয়াশিংটনকেও একই ভাবে কিছু ‘ছাড়তে’ হবে। ফলাফল? প্রেসিডেন্ট ওবামা একটা ৫৯-পয়েন্ট লম্বা ‘করণীয়’-তালিকা নিয়ে দেশে ফিরলেন।

সব মিলিয়ে কী দাঁড়াল? ভারতীয় অর্থনীতিতে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি হল, যেমন বিমা, ‘ই’-বাণিজ্য, রিটেল বা খুচরো ব্যবসা। করছাড় এবং নিয়ন্ত্রণ-নীতির ফাঁস থেকে অব্যাহতি পাওয়া গেল। ভারত-মার্কিন সম্পর্ক এত দিন দুই দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কিংবা সামাজিক সংযোগ ইত্যাদি যে সব ক্লিশে-র তলায় চাপা পড়ে ছিল, তা থেকে অনেকাংশে মুক্তি ঘটল।

আর একটা বিষয়ও মনে রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী মোদী ভালই জানেন যে, পাকিস্তান-চিন অক্ষের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জটির মোকাবিলা করতে গেলে ওয়াশিংটনের স্মিত সহায়তা তাঁর লাগবেই। পাকিস্তান বিষয়ে যে অদূর ভবিষ্যতে ওয়াশিংটনের সহজে নরম হওয়ার পথ নেই, মোদী ও তাঁর উপদেষ্টারা সে কথা ভালই জানেন। তবু সাবধানের মার নেই। ভারতের বৃহত্তর কূটনৈতিক লক্ষ্যটি পূরণেক জন্য অন্যান্য ক্ষেত্রেও সহযোগিতার সেতু শক্ত না করলে চলবে না। দুই দেশের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বাঁধন অর্থাত্‌, বলা যেতেই পারে, প্রেসিডেন্ট ওবামার ২০১৫-র সফর বিরাট বা নাটকীয় কোনও পরিবর্তন না আনতে পারলেও এক দিক দিয়ে রীতিমত সুদূরপ্রসারী। কূটনীতির মরো-মরো সূত্রগুলিকে উজ্জীবিত করা গিয়েছে। প্রথম থেকেই মোদী এ ব্যাপারে যে উদ্যম দেখাচ্ছিলেন, তাতে সুফল মিলেছে। জনতার অনন্ত উত্তেজনাই হোক, আর মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে হাত হাত মেলানোর দুর্দমনীয় বাসনাই হোক, এ বার বোধহয় সে সব বৃথা যায়নি!

post editorial indranil banerjee indranil bandopadhay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy