তিন মুখ্যমন্ত্রী। পৃথ্বীরাজ চহ্বাণ, নরেন্দ্র মোদী ও শিবরাজ সিংহ চহ্বাণ। ডিসেম্বর ২০১২।
ভারতে ১৯৮৪ সালে শেষ বারের মতো রাজীব গাঁধীর নেতৃত্বে একদলীয় সরকার গঠন হয়েছিল, তার পর ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে আবার এসেছে একদলীয় শাসন। এই ঘটনার অর্থ এবং তাৎপর্য নিয়ে ইতিমধ্যেই নানা আলোচনা হয়েছে। জোট সরকার বনাম একক সরকার এই টানাপড়েনের ভবিষ্যৎ নিয়েও নানা মত, নানা যুক্তি। কিন্তু আর একটা বিষয় তুলনায় কম আলোচিত। সেটা হল, দেশে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ। কেন্দ্রে যখন নানান আঞ্চলিক দলের প্রাধান্য থাকে, তখন বিভিন্ন রাজ্যের স্বার্থ যতটা গুরুত্ব পায়, একদলীয় সরকারের শাসনে সেই গুরুত্ব পাবে কি? প্রশ্নটা স্পষ্টতই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন, জোট রাজনীতি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকেই শক্তিশালী করেছে। জোটধর্মের সঙ্গে বহুত্ববাদী রাজনৈতিক সমাজ বিশেষ ভাবে যুক্ত। এই প্রেক্ষিতেই অনেকে সংশয় প্রকাশ করছেন যে, এ বার নরেন্দ্র মোদীর একদলীয় শাসন কি যুক্তরাষ্ট্রীয়তাকে বিপন্ন করে তুলবে? সংশয়ের কারণ যে নেই, তা বলা চলবে না। প্রাথমিক সংকেতও হয়তো ইতিমধ্যেই পাওয়া গিয়েছে। ‘হিন্দি জাতীয়তাবাদ’ নিয়ে ইতিমধ্যেই তামিলনাড়ুতে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তাকে একটা সংকেত বলে মনে করলে ভুল হবে কি?
কিন্তু আশঙ্কা থাকলেও অন্য দিকে আবার রাজনীতির একটা নিজস্ব বাস্তবতা রয়েছে। দেশ শাসন করার জন্য কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ককে সুষ্ঠু করা যে কতটা জরুরি, তা বুঝতে নরেন্দ্র মোদীর ভুল হওয়া উচিত নয়। কারণ তিনি এক জন ব্যতিক্রমী প্রধানমন্ত্রী। সেই ব্যতিক্রম যুক্তরাষ্ট্রীয়তার অনুকূল। এর আগে দুই প্রধান জাতীয় দলের মধ্যে থেকে কংগ্রেসের নরসিংহ রাও ব্যতিরেকে কোনও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীই প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হননি, এবং রাও যখন এই পদে আসেন তার আগে তিনি কার্যত রাজনৈতিক জীবন থেকে সরে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন। এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতটিও মনে রাখার মতো। স্বাধীনতার পরে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস মোটের ওপর শতকরা ৪৫ ভাগ ভোট পেয়েও লোকসভা আসনের শতকরা ৭০ ভাগ দখল
করে রেখেছিল। কিন্তু রজনী কোঠারি বর্ণিত একদলীয় আধিপত্যের সেই নেহরু জমানাতেও বিধানচন্দ্র রায় থেকে কামরাজ, বিজু পট্টনায়ক থেকে দাদাসাহিব পাটিল নানান জনপ্রিয় আঞ্চলিক কংগ্রেস নেতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন।
১৯৬৭ সালের পর থেকে এক দিকে বিভিন্ন রাজ্যে অকংগ্রেসি সরকার স্থাপিত হয়, অন্য দিকে দলের মধ্যে হাইকম্যান্ড নামক এক নতুন প্রাণীর জন্ম হয়। দলের অভিজাততন্ত্র বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় গাঁধীজির অনেক কষ্টে তৈরি করা আমজনতার সংগঠিত কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপর রাজ্য স্তরের প্রভাবও কমতে থাকে। অন্য দিকে, ভারতীয় জনতা পার্টি এর আগে যখন কেন্দ্রীয় সরকারের গদিতে আসীন হয়েছে, তখন সে দলেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বই ছিল প্রবল। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের যে এককেন্দ্রিক ঝোঁক নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার খাতায় পয়েন্ট সাজাতে হয়, দুই প্রধান দলের অভ্যন্তরে ‘কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক’-এর ঝোঁক যেন তারই প্রতিবিম্ব।
নরেন্দ্র মোদী সে দিক থেকেই সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী, কারণ তিনি সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী হ্যাটট্রিক-করা মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি এক আঞ্চলিক মাসিহা হয়ে ওঠেন, তার পর ধাপে ধাপে নিজেকে এক সর্বভারতীয় নেতায় উন্নীত করেন। মোদী জানেন রাজ্য সরকারের সমস্যা, তাদের অধিকার ও সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা, তাদের বেদনা। জানেন, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের ফাটলগুলি কোথায়। আর তাই তাঁর ব্যক্তিমাহাত্ম্য কীর্তনের পাশাপাশি মোদী ও তাঁর সেনাপতিদের মুখ থেকে বার বার শোনা যাচ্ছে ‘কোঅপারেটিভ ফেডারালিজম’ বা সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রের কথা। খুবই জরুরি সেটা।
কেন জরুরি? মূল কারণ খুব সহজ। রক্ত যদি শুধু মুখমণ্ডলে জমা হয়, গোটা শরীরে সংবাহিত না হয়, তা হলে মানুষ বাঁচতে পারে না। তেমনই ‘নেশন’ ‘নেশন’ করে যতই চিল চিৎকার আমরা করি না কেন, শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন তখনই সম্ভব যখন রাজ্যগুলিও শক্তিশালী হবে। দুর্বল রাজ্য নিয়ে শক্তিশালী মহাজাতি গঠনের চেষ্টা আসলে এক বিরাট এবং বিপজ্জনক ভুল। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সেই ভ্রান্তি থেকে মুক্তির পথ খুঁজছে। মোদী সে পথ চিনে এগিয়ে যেতে পারবেন কি না, বলবে আগামী কয়েক বছর।
পথটা কিন্তু খুব অজানা নয়। কেন্দ্রীভূত শাসনের পরিবর্তে অনেক বেশি ক্ষমতা রাজ্যের হাতেও দিতে হবে। বিশেষত অর্থনৈতিক ক্ষমতা। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সাফল্যের সঙ্গে অর্থনীতির প্রশ্নটি গভীর ভাবে যুক্ত। দীর্ঘমেয়াদি বিচারে সেই সাফল্য নির্ভর করে আর্থিক বিকেন্দ্রীকরণের ওপর। সে সমস্যা আজও খুবই জটিল হয়ে রয়েছে। এই জটিলতার নিরসন প্রয়োজন। সে জন্য প্রয়োজন কেন্দ্রের প্রতি, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি রাজ্যগুলির বিশ্বাস উৎপাদন করা। আর তার জন্য দরকার আর্থিক বঞ্চনার দীর্ঘ ট্র্যাডিশনের অবসান। সরকারিয়া কমিশনের মতো আর একটি নতুন কমিশন গঠন করলেই সে সমস্যার সমাধান হবে না। সবার আগে পরিবর্তন চাই দিল্লির মসনদি মানসিকতায়। হাইকম্যান্ড নামক এক জুজুর মাধ্যমে আঞ্চলিক নেতাদের খর্ব থেকে খর্বতর করলে চলবে না, সিদ্ধান্ত নেওয়ার এবং সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে।
এক দিকে অখণ্ড শক্তিশালী ভারতীয় জাতি গঠনের চেষ্টা, অন্যদিকে এ দেশে নানা ধরনের ক্রমবর্ধমান খণ্ডজাতীয়তাবাদ। এই স্ববিরোধের মধ্যে একটা কথা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। শিথিল যুক্তরাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি বরং এক শক্তিশালী রাষ্ট্রগঠনে সহায়ক। বুলডোজার দিয়ে নানা ধরনের জাতিসত্তা, নানা ধরনের আঞ্চলিক বৈচিত্রকে দূর করে গোটা দেশ ও সমাজকে একটি মনোলিথিক সমাজে পরিণত করার নীতি বাস্তবসম্মত নয়। এমনকী সোভিয়েত ইউনিয়নের লৌহকঠিন রাষ্ট্রও, সাত দশকের চেষ্টার পরেও, তা পারেনি।
অন্য দিকে, ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসানের পরে পৃথিবী জুড়ে আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলন সম্পর্কিত মানসিকতায় বদল এসেছে। অনেক সমাজতাত্ত্বিক বলতে শুরু করেছেন, আত্মনিয়ন্ত্রণের নামে যে সব আন্দোলন হচ্ছে তা যতটা না গঠনমূলক তার থেকে বেশি ধংসাত্মক। তাই চাই সুষ্ঠু ভারসাম্য। এক দিকে কেন্দ্র তার কর্তৃত্বকে শক্তিশালী করবে, অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারত গঠনের প্রক্রিয়াকেও শক্তিশালী করতে হবে।
নতুন কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে এই ভারসাম্যের গুরুত্বটা বোঝা খুবই প্রয়োজনীয়। কেন্দ্রাভিগ রাষ্ট্রব্যবস্থা ভারতের মতো বিশাল দেশে নানা প্রান্তে বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয়, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিতে আন্দোলনকে হিংসাত্মক, নাশকতামূলক জঙ্গি কার্যকলাপে পৌঁছে দেয়। রাজ্যগুলির আঞ্চলিক স্বাধীনতা থাকলে বিচ্ছিন্নতার সম্ভাবনা কমে। ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে অসম বিকাশের সমস্যা প্রবল। সেই অসাম্য দু’দিকেই কাটে সব সময় যে পিছিয়ে পড়া, বঞ্চিত রাজ্যেই ক্ষোভ দেখা দেয় তা নয়, উল্টোটাও আমরা দেখেছি। পঞ্জাবে পুঁজিবাদের অতি-বিকাশ সেখানে খালিস্তানি বিচ্ছিন্নতার জন্ম দিয়েছিল। আবার ঝাড়খণ্ডের সুবিধাভোগী মানুষের সামন্ততান্ত্রিক বিচ্ছিন্নতা আদিবাসী সমাজকে মাওবাদী পথে ঠেলে দেয়। আর্থিক এবং সামাজিক অসাম্য একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। এই অসাম্য দূর করার জন্য প্রতিটি রাজ্যের মধ্যে চাই এক গতিশীল আদানপ্রদানের পদ্ধতি। একটি রাজ্য তার অভিজ্ঞতা অন্য রাজ্যকে জানাবে, মুখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে রাজনীতিনিরপেক্ষ আলোচনার পরিবেশ গড়ে উঠবে, সেটাই কাম্য।
এবং সেখানে কেন্দ্রেরও একটা ভূমিকা আছে। সমন্বয়কারীর ভূমিকা। এই কাজটি করার জন্যও কিন্তু ৭ নম্বর রেসকোর্স রোডে এক শক্তিশালী রাজনৈতিক কর্তৃত্বের প্রয়োজন ছিল। মোদীর মতো ‘স্ট্রংম্যান’ ক্ষমতাসীন হওয়ায় তাই একটা আশা সঞ্চারিত হয়েছে যে, এ বারে রাজ্যগুলির মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংযোগ বাড়বে। কিন্তু একই সঙ্গে এ কথাটাও বলা দরকার যে, রাজ্যগুলির সুষ্ঠু সমন্বয় ও শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের তাগিদে যেন কেন্দ্র দাদাগিরির ভূমিকায় অবতীর্ণ না হয়। কেন্দ্রের ভূমিকা হবে এক প্রোমোটার-এর, কিংবা অ্যাসেসর-এর। গোটা প্রক্রিয়াকে মোদী সরকার নিয়ন্ত্রণ করলেও কেন্দ্রের ভূমিকা হবে পরিষেবা সরবরাহকারীর (সার্ভিস প্রোভাইডার)। অতীতে কেন্দ্র-রাজ্যের ক্ষমতার বিন্যাসে এই লক্ষ্মণরেখা বার বার লঙ্ঘিত হয়েছে। সেই ইতিহাস কি এ বার পালটাবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy