Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ

মিথ্যে আর ভুল দিয়ে গরিবের ক্ষতি করা কেন

বিচিত্র সব কুযুক্তি দিয়ে কর্মসংস্থান যোজনা প্রকল্প ছাঁটাইয়ের চেষ্টা চলছে। ‘বাজে খরচ’ বলে পাড়া মাথায় করার আগে এক বার হিসেবনিকেশগুলো একটু দেখে নিলে ভাল হয়।একশো টাকার মধ্যে ত্রিশটা পয়সা খরচ করলে দেশের পঁচিশ কোটি মানুষ যদি আগের তুলনায় খানিক ভাল থাকতে পারেন, তাতে আপত্তি করা কি ঠিক হবে? এটুকু টাকাই খরচা হয় জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনার জন্য। দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উত্‌পাদনের (জিডিপি) ০.৩ শতাংশ।

ভরসা থাকুক। গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনা দরিদ্রতম মানুষের কাছে অতি প্রয়োজনীয়।

ভরসা থাকুক। গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনা দরিদ্রতম মানুষের কাছে অতি প্রয়োজনীয়।

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

একশো টাকার মধ্যে ত্রিশটা পয়সা খরচ করলে দেশের পঁচিশ কোটি মানুষ যদি আগের তুলনায় খানিক ভাল থাকতে পারেন, তাতে আপত্তি করা কি ঠিক হবে? এটুকু টাকাই খরচা হয় জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনার জন্য। দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উত্‌পাদনের (জিডিপি) ০.৩ শতাংশ। সেই খরচের সুফল পায় প্রায় পাঁচ কোটি পরিবার। অর্থাত্‌, কম-বেশি পঁচিশ কোটি মানুষ।

এই ০.৩ শতাংশ খরচ করা নিয়েও আপত্তি অনেক। কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, গোটা দেশে আর নয়, অতঃপর দেশের দরিদ্রতম ২০০টি জেলায় চলবে এই প্রকল্প। প্রকল্পে প্রকৃত মজুরির হার আর বাড়বে না। আগের তুলনায় কম শ্রমিক নিয়োগ করা হবে। অর্থাত্‌, বিভিন্ন দিক থেকে যোজনার ডানা ছাঁটা হচ্ছে।

কেন এই প্রকল্প ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে ক্ষতিকারক, তার কিছু চালু যুক্তি আছে। দিনকয়েক আগে অর্থনীতিবিদ জগদীশ ভগবতী এবং অরবিন্দ পানাগড়িয়া এক লেখায় ফের সেই যুক্তিগুলো সাজিয়েছেন। যুক্তির মূলত দুটো ধারা। এক, এই প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতির ফলে সরকারি খরচের অংশমাত্র গরিবের কাছে পৌঁছচ্ছে। দুই, বিপুল ব্যয় অথচ রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা অতি সামান্য, এমন প্রকল্প চালিয়ে লাভ নেই।

দুর্নীতির অভিযোগ অনস্বীকার্য। কিন্তু, ভারতে কোন ক্ষেত্রে দুর্নীতি নেই? আর পাঁচটা ক্ষেত্রের তুলনায় কর্মসংস্থান যোজনায় দুর্নীতির পরিমাণ অনেক বেশি, এমন কোনও প্রমাণ এই সমালোচকরা দিয়েছেন বলে জানা নেই। কিন্তু নিতান্তই তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই, কর্মসংস্থান প্রকল্প দুর্নীতির আখড়া, তবুও সেটা এই প্রকল্পটিকে কাটছাঁট করা বা তুলে দেওয়ার যুক্তি হতে পারে না। দুর্নীতি থাকলে তা কমানোর রাস্তা খুঁজতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে, আধার কার্ড-নির্ভর নগদ হস্তান্তরের যুগে কাজটা তুলনায় সহজ। বস্তুত, বিশ্বব্যাঙ্কের ২০১১ সালের একটি রিপোর্ট বলছে, স্বাধীন ভারতে অন্যতম সফল সরকারি সমাজকল্যাণ প্রকল্প এই কর্মসংস্থান যোজনা। ছত্তীসগঢ়, অন্ধ্রপ্রদেশ, রাজস্থানের মতো রাজ্য কী ভাবে দুর্নীতি ঠেকিয়ে এই প্রকল্পকে কর্মসংস্থান এবং গরিব মানুষের আয়বৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করেছে, সে কথাও বলেছে রিপোর্টটি।

কিন্তু, মূল প্রশ্ন দুর্নীতির নয়। আদৌ কেন প্রকল্পটি থাকবে, প্রশ্ন সেটাই। তার একটা উত্তর পাওয়া গেছে আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা সংস্থার (আইএফপিআরআই) গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স-এ। ২০০৫-০৬ থেকে ২০১৩-১৪ পর্যন্ত ভারতে বয়সের তুলনায় কম ওজনের শিশুর সংখ্যা কমেছে ১৩ শতাংশ। গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় আর কোথাও এত দ্রুত উন্নতি হয়নি। সংস্থাটি জানিয়েছে, এই উন্নতি ইউপিএ জমানায় বিভিন্ন সামাজিক খাতে সরকারি ব্যয়বৃদ্ধির ফল। বিশেষত, আইসিডিএস এবং জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের প্রত্যক্ষ, আর কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনার পরোক্ষ ফল।

এতগুলো শিশুর ভাল থাকাকে জগদীশ ভগবতীরা ‘লাভ’ বলতে রাজি নন। তাঁরা লাভ মাপেন রাজস্বের অঙ্কে। কোনও খাতে সরকার টাকা খরচ করলে সে ‘বিনিয়োগ’ রাজকোষে কত টাকা ফিরিয়ে আনতে পারবে, সেটাই বিবেচ্য। তাঁদের এই মাপকাঠিকে শিরোধার্য করার কোনও কারণ অবশ্য নেই। বিনিয়োগ আর লাভের এই মাপকাঠিটি বাণিজ্যিক ক্ষেত্রের, তা সরকারের কর্তব্য স্থির করতে পারে না। সরকারের প্রথম কর্তব্য নাগরিকদের সক্ষমতা সৃষ্টি। আর সে জন্য দরিদ্রের আয় বাড়াতেই হবে।

কর্মসংস্থান যোজনা সেটা পেরেছিল। ২০০০-০১ থেকে ২০০৫-০৬ পর্যন্ত, অর্থাত্‌ এই যোজনা শুরুর আগে অবধি গ্রামে বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি ছিল পুরুষ কৃষিশ্রমিকদের ক্ষেত্রে বছরে ০.১ শতাংশ। গ্রামের সব মহিলা শ্রমিকের আয় বছরে বছরে কমছিল। মনে রাখবেন, ঠিক এই সময়টাই ছিল এনডিএ-র ‘ভারত উদয়’-এর পরমলগ্ন। জঁ দ্রেজ ও অমর্ত্য সেন হিসেব কষে দেখিয়েছেন, ২০০৫-০৬ থেকে ২০১০-১১ পর্যন্ত ছবিটা অন্য রকম। সব পুরুষ গ্রামীণ শ্রমিকের মজুরি বছরে প্রায় দুই শতাংশ হারে বেড়েছে, মহিলাদের বেড়েছে প্রায় চার শতাংশ হারে। লক্ষণীয়, এই প্রকল্প যাঁদের জন্য, সেই অদক্ষ অ-কৃষি শ্রমিকের মজুরিই শুধু বাড়েনি, কৃষি শ্রমিকদের মজুরিও বেড়েছে প্রায় তাল মিলিয়ে। অর্থাত্‌, শ্রমিকদের আয়বৃদ্ধিতে যোজনার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ, দুই গোত্রের প্রভাবই পড়েছে। গ্রামীণ শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির হার এই সময়েও জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হারের কাছাকাছি পৌঁছতে পারেনি বটে, কিন্তু যোজনা চালু হওয়ার আগে ফারাকটা যতখানি অশ্লীল রকম বেশি ছিল, তার চেয়ে অনেকটা কমেছে। বিশেষ লাভবান হয়েছেন মহিলারা, অনগ্রসর শ্রেণির মানুষরা।

এই প্রকল্পে গ্রামীণ সম্পদও নির্মিত হয়েছে। ভগবতীরা বলবেন, যত টাকা খরচ হয়েছে, তার তুল্য সম্পদ তৈরি হয়নি। উত্তর সহজ: তা হওয়ার কথাও ছিল না। প্রকল্পটি সম্পদ নির্মাণের নয়, কর্মসংস্থানের। মানুষের আয়বৃদ্ধিতে সহায়তার। সে কাজটা বেশ ভাল ভাবেই হয়েছে।

কর্মসংস্থান যোজনার ওপর ভগবতীদের রাগের একটা বড় কারণ, এই যোজনা এসে মজুরির হার এমনই বাড়িয়ে দিয়েছে যে এক দিকে কৃষি শ্রমিক পাওয়া দুষ্কর হয়েছে, অন্য দিকে শিল্পে শ্রমিকের জোগানে ভাটা পড়েছে। এতে শিল্পে ব্যয় বাড়ছে, বিনিয়োগ তুলনায় অ-লাভজনক হয়ে উঠছে। এই ক্ষোভের জবাবে একটা ছোট্ট হিসেব দিই। যোজনায় দৈনিক মজুরির হার, এ বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, ছিল ১৩০ টাকার কাছাকাছি। পরিবারে পাঁচ জন থাকলে, মাথাপিছু ২৬ টাকা। সরকারি দারিদ্রসীমার চেয়েও কম রোজগার। যাঁদের কাছে সেই মজুরিও আকর্ষণীয়, এত দিন তাঁদের কোন মজুরিতে কাজ করিয়ে এসেছেন বিনিয়োগকারীরা?

জিডিপি’র উপাসকরা কথায় কথায় চিনের সঙ্গে তুলনা টানেন। চিনের দিকে একটু তাকানো যাক। একুশ শতকের প্রথম দশকে চিনে কারখানার শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে বছরে ১২ শতাংশ হারে। ভারতে, আড়াই শতাংশ। অর্থাত্‌, অগণতান্ত্রিক চিনে শিল্পক্ষেত্রে লাভের যতটা শ্রমিকদের পকেটে এসেছে, ভারতে এসেছে তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ। বিনিয়োগকারীদের এমন লাভের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার দায় কি সরকারের? কোনও সরকার সেধে সেই দায় নিতে চাইলে বুঝতে হবে, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতায় তাদের বিশেষ উত্‌সাহ নেই।

আজ যদি সত্যিই সরকার গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনাকে গুটিয়ে আনে, জিডিপির ০.৩ শতাংশও এই খাতে ব্যয় করতে রাজি না হয়, তা হলে টাকাটা যাবে কোথায়? সম্ভবত স্মার্ট সিটি তৈরিতে, উড়ালপুল গড়তে, ব্যবসার জন্য নিবেদিত সড়ক নির্মাণে। তাতে গর গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনার ডানা ছাঁটা এখানেই বিপজ্জনক যে, এটা শুধু একটা প্রকল্পের প্রশ্ন নয়, অধিকারের প্রশ্ন। ইউপিএ আমলের দুটি আইন, কাজের অধিকার আর খাদ্যের অধিকার আইন, উন্নয়ন অর্থনীতির ময়দানে একটা কাজ করেছিল, এই কথাটিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল যে, রাষ্ট্রের সমৃদ্ধিতে গরিব মানুষের যে অধিকার আছে, তাঁরা যে নিছক দয়া বা চুঁইয়ে নামার মুখাপেক্ষী হয়ে বাঁচতে বাধ্য নন। সেই অধিকার কেড়ে নিলে সেটা গরিব মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

post editorial amitabho gupta amitava gupta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE