ভিডিও বার্তায় জাওয়াহিরি। ছবি: এএফপি।
আল-কায়দার ভারতীয় শাখা স্থাপনের কথা ঘোষণা করলেন জঙ্গি সংগঠনের বর্তমান প্রধান আমন আল জাওয়াহিরি। বুধবার ৫৫ মিনিটের এক ভিডিও বার্তায় তিনি জানান, ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে ‘জিহাদের পতাকা’ তুলে ধরতেই এই শাখার সূচনা। একই সঙ্গে আফগানিস্তানের পলাতক তালিবান নেতা মোল্লা ওমরের প্রতি তাঁর বিশ্বস্ততা বজায় থাকবে বলেও জানিয়েছেন জাওয়াহিরি। বিশেষজ্ঞদের মতে, মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট-এর (আইএস) উত্থানে শঙ্কিত হয়েই জাওয়ারির এই পদক্ষেপ। এই ঘোষণার কথা প্রকাশ্যে আসার পরে ভারতের ইন্টালিজেন্স ব্যুরো (আইবি) দেশের সমস্ত থানাকে সতর্ক করে দিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ গোয়েন্দা বিভাগকে ভিডিওটির সত্যতা যাচাইয়ের পাশাপাশি এর উৎস সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে কথাও বলেছেন।
ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পরে ক্রমেই প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছিল আল-কায়দা। জীবনের শেষ কয়েক বছর মূল সংগঠনের কাজ থেকে দূরে থাকলেও আল-কায়দা ও তাদের ছাতার তলায় থাকা অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলির কাছে ওসামার প্রতীকি ভূমিকা ও অনুপ্রেরণা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আল-কায়দা বা অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলির কাছে ওসামার সহযোগী (দলে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ) মিশরের চিকিৎসক নেতা আল জাওয়ারির ছবি তেমন উজ্জ্বল নয়। বেশ কয়েক বছর যাবত্ পরবর্তী নেতা হিসেবে জাওয়ারির ভূমিকার প্রবল সমালোচনা হচ্ছিল জঙ্গিমহলে। পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে।
ইরাকে মার্কিন সেনার অবস্থানের সময়ে সেখানে আল-কায়দার শাখা তৈরি হয়। এর এক নেতা ছিলেন আবু বকর আল-বাগদাদি। তিনি মার্কিন সেনার হাতে ধরা পড়ে কয়েক বছর গুয়ানতানামো বে-তে বন্দি ছিলেন। ২০০৯-এ মুক্তি পাওয়ার পরে ইরাকে নতুন করে আল-কায়দার সংগঠন গড়ে তুলতে শুরু করেন আল-বাগদাদি। এখানেই তাঁর সঙ্গে আল-কায়দার শীর্ষ নেতৃত্বের বিরোধ শুরু হয়। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে এই বিরোধ প্রবল হয়। আইএস-এর নৃশংস কার্যকলাপে অতিষ্ঠ হয়ে জাওয়াহিরি-সহ আল-কায়দার শীর্ষ নেতৃত্ব তাদের সমালোচনা করতে শুরু করেন। ফলে আইএস-এর সঙ্গে আল-কায়দার সম্পর্কই শুধু ছিন্ন হয় না, সিরিয়ার কয়েকটি জায়গায় দু’দলের জঙ্গিরা সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়েন।
জেহাদের বিষয়ে আল-কায়দার ‘নরম মনোভাব’-এর নিন্দা করে আইএস তাদের থেকে সরে আসে। এর পরে সিরিয়ার পূর্ব ও ইরাকের পশ্চিম দিকের একটি বড় অংশ আইএস-এর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। সেখানে ইসলামিক রাষ্ট্র স্থাপনের কথা ঘোষণা করে নিজেদের নেতা আবু বকর আল-বাগদাদিকে খলিফা পদে মনোনীত করে আইএস। শুধু সিরিয়া ও ইরাক নয়, এর মধ্যেই আফগান জঙ্গিদের একাংশও ইসলামিক স্টেটের মতাদর্শের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছে। এই নিয়ে পাক-আফগান সীমান্তের দুর্গম আদিবাসী অঞ্চলে প্রচারও চলছে বলে জানা গিয়েছে। তা ছাড়া আল-কায়দার থেকে আইএস-যোগ দিলে জঙ্গিদের অনেক বেশি আর্থিক সুযোগ-সুবিধা মিলছে বলে বিশেষজ্ঞদের মত। তাই জঙ্গি মহলে আইএস-এর জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান। আইএস যে আর্থিক ও সামরিক শক্তিতে আগের জঙ্গি সংগঠনগুলির থেকে অনেক এগিযে গিয়েছে তা কিছু দিন আগে মাকির্ন প্রতিরক্ষা সচিব চাক হেগেল স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তাই মার্কিন প্রশাসনও আল-কায়দার থেকে আইএস-কেই এখন প্রধান সমস্যা বলে মনে করছে। এর মধ্যেই আইএস দু’জন মার্কিন সাংবাদিকে হত্যা করেছে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আইএস ধ্বংস করতে সব রকমের ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
এর পরেই আল জাওয়াহিরির ভিডিওটি প্রকাশ্যে আসে। ভিডিওয় মায়ানমার, বাংলাদেশ, অসম, গুজরাত, আমদাবাদ ও কাশ্মীরের মুসলমানদের উপর অবিচার ও শোষণের থেকে মুক্ত করার জন্য ‘আল-কায়দা ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট’ স্থাপনের কথা জানান জাওয়ারি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর মধ্যে ভারত থেকে বেশ কিছু যুবক আইএস যোগ দিয়ে সিরিয়া ও ইরাকে যুদ্ধ করছে। কয়েক জন প্রাণও হারিয়েছে। অসম, গুজরাত, আমদাবাদ ও কাশ্মীরের মতো সাম্প্রদায়িক দিক থেকে উত্তেজনা প্রবণ এলাকার যুবকদের নিজেদের দলে টানতে আল জাওয়াহিরির এই পদক্ষেপ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। জাওয়াহিরির দাবি, জেহাদের পতাকা তুলে এই অঞ্চলগুলিতে নানা রাষ্ট্রের সীমানা মুছে দিয়ে মুসলিমদের এক করার কাজ করবে আল-কায়দার এই নতুন শাখা। মুসলিমরা ভারতের জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ হলেও (প্রায় ১৮ কোটি) তা বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে গুরুত্ব হারালেও পাক-আফগান সীমানায় এখনও আল কায়দার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। ফলে বিষয়টিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সূত্রে খবর, এর মধ্যেই সংবেদনশীল এলাকায় অফিসারদের পাঠানো হয়েছে। ভিডিওটি আল-কায়দার গণমাধ্যম দেখাশোনার দায়িত্বে থাকে ‘আস-সাহাব মিডিয়া ফাউন্ডেশন’ তৈরি করেছে। এটি এর মধ্যেই জেহাদি মহলে ব্যাপক ভাবে প্রচারিত হয়েছে।
ভিডিওটিতে আইএস নেতৃত্বের প্রতি বার্তাও রয়েছে। নিজেদের জেহাদি মনে করলে কোনও জঙ্গি সংগঠনকে রাষ্ট্র স্থাপন ও পরিচালনা করার মতো কাজ থেকে সরে আসা উচিত বলে জানিয়েছেন তিনি। আল-কায়দার নতুন শাখাকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উপরে অত্যাচার চালাতেও তিনি বারণ করেছেন। একই সঙ্গে অন্য জেহাদিদের নিন্দা না করে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনগুলিকে একই সঙ্গে কাজ করার ডাকও দিয়েছেন। এই তিনটি বিষয়ে আইএস-এর বিরুদ্ধে বারে বারে অভিযোগ উঠেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy