বিস্ফোরণে আহত দুষ্কৃতী রাজা দাস। —নিজস্ব চিত্র।
ভোরের প্রথম কৃষ্ণনগরগামী ট্রেন। ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রয়েছেন যাত্রীরা। কেউ বা দাঁড়িয়ে। সেই অর্থে ভিড় নেই। যাঁরা বসে, তাঁদের বেশির ভাগই রাত জাগার ক্লান্তিতে একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছেন। কেউ বা ট্রেনের দুলুনিতে হাল্কা ঘুমে আচ্ছন্ন। সব কামরারই একই ছবি। হঠাত্ই পাঁচ নম্বর কামরায় বীভত্স জোরে আওয়াজ। সেই সঙ্গে চিত্কার। ঝিমুনি-ঘুম-ঢুলুনি কেটে গিয়েছে গোটা কামরার। চতুর্দিক ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছে। তত ক্ষণে বেশ কয়েক জন মারাত্মক ভাবে আহত হয়েছেন। ট্রেনের কামরা ভেসে যাচ্ছে রক্তে। কারও হাত উড়ে গিয়েছে, তো কারও শরীর থেকে ক্রমাগত ঝরছে রক্ত। মঙ্গলবার ভোরে এমন ঘটনারই সাক্ষী হল এ রাজ্য।
রেলপুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এ দিন ভোর ৩টে ২০ নাগাদ শিয়ালদহ থেকে আপ কৃষ্ণনগর লোকালটি ছে়ড়েছিল। সিগন্যালে ত্রুটির জন্য দমদমে কিছু ক্ষণ দাঁড়ানোর পর ট্রেনটি ফের রওনা হয়। ভোর পৌনে চারটে নাগাদ সেটি টিটাগড় পৌঁছয়। সেখান থেকে তিন-চার জন যাত্রী ট্রেনে ওঠেন। প্রাথমিক তদন্তে রেলপুলিশের অনুমান, ওই যাত্রীদের কারও কাছে বোমা ছিল। নিজেদের মধ্যে বচসা বাধায় অসাবধানতাবশত তা কোনও ভাবে ট্রেনের কামরায় পড়ে গিয়ে বিস্ফোরণ হয়।
ট্রেনটি ব্যারাকপুর পৌঁছলে, যাত্রীরাই রেলকর্মীদের খবর দেন। রেলপুলিশ ওই কামরা থেকে আহত যাত্রীদের উদ্ধার করে। পুলিশ জানিয়েছে, আহতদের মধ্যে রাজা দাস নামে স্থানীয় এক দুষ্কৃতী রয়েছে। বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই ছিল যে, তার মাথার একাংশের পাশাপাশি উড়ে গিয়েছে একটি হাতও। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের ধারণা, এই রাজার কাছেই বোমা ছিল। তার দুই সঙ্গীও সেই সময় ট্রেনে ছিল। কিন্তু, বিস্ফোরণের পর তারা পালিয়ে গিয়েছে বলে পুলিশের অনুমান। রেল সূত্রে খবর, এই বিস্ফোরণে মোট ২০ জন আহত হয়েছেন। যাঁদের মধ্যে ছয় জনের আঘাত বেশ গুরুতর। শিয়ালদহের রেল পুলিশ সুপার দেবাশিস বেজ বলেন, ‘‘রাজা ট্রেনে আগে থেকেই ছিল। টিটাগড় থেকে উঠেছিল তার দুই সঙ্গী কানা ভোলা ও বাঁইয়া। তাদের সঙ্গে বচসার পরেই বোমা বিস্ফোরণ হয়। তবে, কার কাছে বোমা ছিল তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’ এই ঘটনার পরেই কানা ভোলা ও বাঁইয়া জখম অবস্থাতেই ট্রেন থেকে লাফিয়ে নেমে পালিয়ে যায়।
রক্তে ভেসে যাচ্ছে কামরা।
পুলিশ সূত্রে খবর, বোমার ঘায়ে আহত হয়েছেন বেশ কয়েক জন যাত্রী। কয়েক জন যাত্রী আবার আতঙ্কে চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। আশপাশের বাসিন্দারা তাঁদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। ট্রেনের কামরায় থাকা আহত যাত্রীদের প্রথমে ব্যারাকপুর বি এন বসু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রাথমিক চিকিত্সার পর ছেড়ে দেওয়া হয় তাঁদের কয়েক জনকে। গুরুতর আহতদের বি আর সিংহ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয় রেলের উদ্যোগে। তাঁদের বিশেষ একটি উদ্ধারকারী ট্রেনে করে শিয়ালদহ নিয়ে আসা হয়। পরে তাঁদের এক জনকে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
বিস্ফোরণের খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে ছুটে যান রেলের উচ্চপদস্থ কর্তারা। ঘটনাস্থলে পৌঁছন পূর্ব রেলের ডিএম আরপি গুপ্ত। তিনি জানান, তদন্ত শুরু হয়েছে। যে ট্রেনে বিস্ফোরণ হয়, সেই রেকটিকে আপাতত ফরেন্সিক তদন্তের জন্য নারকেলডাঙা কারসেডে নিয়ে আসা হয়েছে। পূর্ব রেলের শিয়ালদহ ডিভিশনের ডিআরএম জয়া বর্মা সিংহ বলেন, ‘‘রেকটির ওই কামরাটি কোনও ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তদন্তের সুবিধার্থে সেটিকে কারসেডে নিয়ে আসা হয়েছে।’’ পরে তিনি জানান, ‘‘এই ঘটনায় দু’টি ট্রেন বাতিল হয়েছে। রেলপুলিশের পাশাপাশি পূর্ব রেল প্রশাসনও খতিয়ে দেখছে ট্রেনের মধ্যে কারা বোমা আনল? কী ভাবে সেগুলি ফাটল? এর পিছনে অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
আহত যাত্রী উত্তম চক্রবর্তী।
তবে প্রাথমিক তদন্ত শেষে রেলপুলিশ জানিয়েছে, এই ঘটনার পিছনে কোনও নাশকতার উদ্দেশ্য ছিল না বলেই মনে করা হচ্ছে। রাজা নামে যে দুষ্কৃতীর হাত উড়ে গিয়েছে, তার হাতে একটি ব্যাগ ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশের অনুমান, ওই ব্যাগেই সম্ভবত বোমাটি ছিল। গোলমালের সময় ধস্তাধস্তিতে রাজার হাতে থাকা ব্যাগটি কামরায় পড়ে গিয়ে বোমাটি ফেটে যায়। ওই সময় রাজাও মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল, ফলে তার ডান হাত ও মাথার কিছুটা অংশ উড়ে যায় বলে পুলিশের দাবি।
লোকাল ট্রেনে কী ভাবে দুষ্কৃতীরা বোমা নিয়ে উঠে পড়ল? তবে কি ভোরের ট্রেনে রেলের কোনও নজরদারি নেই?
চিকিত্সাধীন রাজা দাস।
নিত্যযাত্রীদের একাংশ জানাচ্ছেন, শিয়ালদহ বা হাওড়ার মতো বড় স্টেশনে সামান্য নজরদারির ব্যবস্থা থাকলেও অন্য স্টেশনগুলিতে তা নেই। এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, লোকাল ট্রেনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা শিথিল! তবে, রেলের এক আধিকারিক জানান, ছোট স্টেশনগুলিতে এমন নজরদারি চালানোর মতো পরিকাঠামো রেলের তেমন একটা নেই। কে হাত ব্যাগে করে, কী নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লেন, এত ভিড়ের মধ্যে সেই নজরদারি চালানো রেলের পক্ষে কার্যত অসম্ভব বলে জানিয়েছেন ওই আধিকারিক।
ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy